ঈদটা সাধারণত বাড়িতেই কাটাতে পছন্দ করেন বেশির ভাগ মানুষ। তবে ঈদের পর পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকে অনেকেরই। আর এই ভ্রমণপ্রেমীদের কথা মাথায় রেখে দেশের কিছু চোখজুড়ানো জায়গার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আজ। তালিকাটি করতে গিয়ে পাহাড়-অরণ্যপ্রেমীদের পাশাপাশি পাহাড়ের জনগোষ্ঠীদের বৈসাবি উৎসব দেখতে যাঁরা আগ্রহী, তাঁদের কথাও মাথায় রাখা হয়েছে।
জল ও অরণ্যের কাপ্তাই
রাঙামাটির একটি উপজেলা কাপ্তাই। বান্দরবানে উত্তেজনা চালায় পাহাড়প্রেমীরা কাপ্তাইয়ে গিয়ে অনায়াসে মনের খোরাক মেটাতে পারবেন। কাপ্তাই এমন এক জায়গা, যেখানে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য মোটামুটি সবকিছুই আছে। অসাধারণ সুন্দর কাপ্তাই হ্রদ কিংবা খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে ভ্রমণ করতে পারবেন। জঙ্গল চাইলে ঘুরে বেড়াতে পারবেন কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে। যদি পাহাড়প্রেমী হন, তবে উঠতে পারেন রাম পাহাড় বা সীতা পাহাড়ে।
কাপ্তাই থেকে রাঙামাটি যাওয়ার সংক্ষিপ্ত রাস্তাটিতে ভ্রমণ করাটাও অবশ্য কর্তব্য। একপাশে হ্রদ, আরেক পাশে পাহাড় মিলিয়ে এমন সুন্দর পথ আছে কমই। পথের পাশে চমৎকার কিছু রেস্তোরাঁয় পাবেন বেম্বু চিকেনসহ পাহাড়ি-বাঙালি নানা পদের খাবার।
কাপ্তাই মারমা অধ্যুষিত এলাকা। তাই এখানে পাহাড়িদের বৈসাবি উৎসবের মধ্যে সাংগ্রাইয়ের প্রভাব বেশি। সাংগ্রাইয়ের পানিখেলা বা জলকেলি উৎসব দেখার জন্য চমৎকার জায়গা কর্ণফুলী নদী পেরিয়ে চিৎমরম। বৌদ্ধদের চমৎকার কিছু মন্দিরও দেখতে পাবেন সেখানে। এ সময় চিৎমরমে সাংগ্রাই উপলক্ষে বড় মেলা হয়।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে শ্যামলী, এস আলমসহ আরও বেশ কয়েকটি পরিবহনের বাসে অনায়াসে চলে যেতে পারবেন কাপ্তাইয়ে।
কাপ্তাই-রাঙামাটি সড়কে কয়েকটি চমৎকার রিসোর্ট আছে রাত কাটানোর জন্য। এ ছাড়া শিলছড়ি, নেভি ক্যাম্পসহ কাপ্তাইয়ের বিভিন্ন এলাকায় সুন্দর সুন্দর কিছু রিসোর্ট গড়ে উঠেছে।
গোয়াইনঘাটের নদী, অরণ্য, পাহাড় আর ঝরনা
সিলেটের দর্শনীয় জায়গার অভাব নেই। তবে সিলেট জেলার মধ্যে উপজেলা বিচার করলে মনে হয় সবচেয়ে বেশি দর্শনীয় জায়গা আছে গোয়াইনঘাটে। পিয়াইন নদীর তীরে ভারতের সীমন্তবর্তী জনপদ জাফলং সব সময়ই পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় ওপরের দিকে আছে। পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জল, ওপাশে ভারতের ডাউকির পাহাড়, সুন্দর এক সেতু আর মায়াবী ঝরনা মুগ্ধ করবে আপনাকে। নদী পেরিয়ে খাসিয়া পল্লি কিংবা সুন্দর এক চা-বাগানও আরাম দেবে দৃষ্টিকে।
তেমনি গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি নদী, পাথর ও সীমান্তের ওপারের পাহাড় মিলিয়ে আকর্ষণ করবে আপনাকে। পানি একটু বেশি থাকলে চলে যেতে পারবেন একেবারে পান্থুমাই পর্যন্ত। পান্থুমাইয়ের মতো সুন্দর গ্রাম খুব বেশি চোখে পড়ে না। পাহাড়-নদীর আশ্চর্য মিতালি এখানে। গ্রামে ঘুরে অনেকটা সময় কাটাতে পারবেন। তবে সবচেয়ে আকর্ষণ করবে পান্থুমাই বা বড়হিল ঝরনাটা। এদিক থেকে সীমান্তের ওপাশের ঝরনা, রাস্তা দিয়ে চলা গাড়ি এবং পাহাড়ে সুপারিগাছের সারি আর বিশাল সব পাথর দেখবেন মুগ্ধ দুই নয়নে।
এ ছাড়া গোয়াইনঘাটের মধ্যেই পড়েছে জলের বন রাতারগুল। নৌকায় করে মিঠাপানির এই অরণ্যে ঘুরতে বেশ লাগবে। গোয়াইনঘাটের সীমানায় না পড়লেও জাফলং ঘুরতে গেলে একই সঙ্গে লালাখালের জন্য হাতে বেশ কিছু সময় রাখবেন। নৌকা নিয়ে চলে যেতে পারবেন জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত। তেমনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় সাদা পাথরও দেখে আসতে পারেন একই ভ্রমণে।
কাজেই শুধু গোয়াইনঘাট উপজেলার এবং এর আশপাশের চমৎকার সব জায়গা দেখার জন্যই অন্তত দুটি রাত কাটাতে হবে আপনাকে।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
সিলেটে যেতে পারবেন বাস, ট্রেন কিংবা প্লেনে। সেখান থেকে গাড়ি বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা রিজার্ভ করে চলে যেতে পারবেন ওপরে উল্লেখ করা জায়গাগুলোতে। আবার বাসেও যেতে পারবেন। তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য এসব জায়গায় ঘোরাঘুরিতে নৌকা লাগবেই।
থাকার জন্য জাফলং এবং এর কাছের জৈয়ন্তিয়ায় কিছু সুন্দর রিসোর্ট আছে। তেমনি লালাখাল ও রাতারগুলের পাশেও রিসোর্ট আছে। তবে সাদা পাথর কিংবা বিছনাকান্দি যেতে হলে থাকতে হবে শহরেই।
পানছড়ির লেক আর বাঘাইছড়ির পাহাড়
খাগড়াছড়ি শহর কিংবা দীঘিনালাকে মানুষ যতটা চেনে, সে তুলনায় পানছড়ির সঙ্গে পরিচয় কম। পানছড়ির বড় আকর্ষণ অরণ্যকুটির। খাগড়াছড়ি শহর থেকে দূরত্ব কমবেশি ২৫ কিলোমিটার। সেখানে পৌঁছার আগেই ভারি সুন্দর একটা পথ পাবেন। সরু পিচঢালাই রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে। ডান পাশে যত দূর চোখ যায়, শুধু ধানখেত। বাঁয়েও কিছুদূর পর্যন্ত ধানখেত। তারপর হঠাৎ করেই পাহাড়সারির শুরু। ধানখেত আর পাহাড়ের এই মিতালি দেখতে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। ছবি তুললাম। গাড়ি ছাড়ার পর কিছুদূর আসতেই আবার থামতে হলো। সামনেই চেঙ্গির ওপর ব্রিজ। নিচে তাকাতেই চোখে পড়বে সুন্দর একটা রাবার ডেম। রাবার ফুলিয়ে পানি ধরে রাখার জন্য নদীর ওপর বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ডান দিকে থইথই পানি। রাবার ডেম উপচে এপাশে পড়ছে পানির একটা ধারা।
তারপর মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাবেন অরণ্যকুটিরের সামনে। বেশ বড় এলাকা নিয়ে বৌদ্ধদের এই তীর্থস্থান। ইন্টারনেট ঘেঁটে জেনেছি, পুরো জায়গাটা ৬৫ একর। মূল আকর্ষণ বিশাল বৌদ্ধ মূর্তিটা। ৫০ ফুট উচ্চতার বসে থাকা বৌদ্ধ মূর্তিটা তৈরি হয়েছে ২০০৯ সালে। সোনালি রঙের বুদ্ধ সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে অনেক বৌদ্ধ মূর্তি চোখে পড়বে। তবে এটার মতো বিশাল, আর সুন্দর আছে কমই। কয়েকটা ছোট মন্দির আছে পাশেই। মেহগনি, আগর, তেজপাতাসহ নানা ধরনের হাজারো গাছে ভর্তি জায়গাটা। ডান পাশে বড় মাঠ। এখানেই অনুষ্ঠান হয়। বিশেষ করে কঠিন চীবর দান উৎসবের সময় নাকি গোটা অরণ্য কুটির এলাকা মানুষে গম গম করে। নিচে পাহাড়ি ছড়ার ওপর একটা সেতু নজর কাড়বে।
অরণ্যকুটির থেকে আধা ঘণ্টা লাগল মায়াবিনী লেকে পৌঁছাতে। পানছড়ির লতিবান ইউনিয়নের কংচাইরীপাড়ায় এর অবস্থান। প্রচুর পর্যটক আসেন হ্রদটিতে। শুনেছি, মোট ৪০ একর জায়গা নিয়ে লেকটা। লেকের এখানে-সেখানে ছোট ছোট দ্বীপের মতো। আবার লেক পেরোনোর জন্য কাঠ-বাঁশের সেতুগুলোও ভারি সুন্দর। কায়াকিংয়ের ভালো ব্যবস্থা আছে।
রাঙামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলির একটি। তবে ঈদের ঠিক পর পর সাজেকে ভিড়-বাট্টা একটু বেশি থাকবে। তাই একটা সপ্তাহ দেরি করে সেখানে যেতে পারেন। আমার মতে শুক্র-শনিবার এড়িয়ে সাজেক যেতে পারলে এখানকার প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগটা থাকবে বেশি।
অবশ্য আপনি যে রিসোর্টে উঠবেন সেটায় যদি একটা খোলা ব্যালকনি থাকে তবে এখানে বসে পাহাড় আর মেঘের খেলা দেখতে দেখতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারবেন। আবার পাহাড়ের কোনো একটি ট্রেইল ধরেও বেরিয়ে পড়তে পারেন। জুমঘর, গাছপালা এসব দেখতে দেখতে হাঁটাটা যে বেশ আনন্দময় হবে সন্দেহ নেই।
আরেকটা কথা এখন পাহাড়ের বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের উৎসব চলছে। বৈসাবির বৈসু, সাংগ্রাই আর বিজু—সবগুলি উপভোগ করতে পারবেন পানছড়িতে। মারমাদের সাংগ্রাইয়ের বড় আকর্ষণ জলকেলি। পানছড়িতে জলকেলি হবে ১৫ এপ্রিল। খাগড়াছড়ি শহরের জলকেলি উৎসবও উপভোগ করতে পারেন।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে শ্যামলী, এস আলম, ইউনিক, হানিফ কিংবা শান্তি পরিবহনের বাসে খাগড়াছড়ি যেতে পারেন। আছে এসি বাস সেন্ট মার্টিন পরিবহন। খাগড়াছড়ি শহর থেকে অটোরিকশা কিংবা চাঁদের গাড়িতে শান্তিকুটির আর মায়াবিনী লেক চলে যেতে পারবেন। খাগড়াছড়ি শহর ও আশপাশে পর্যটন মোটেলসহ বেশ কিছু হোটেল-রিসোর্ট আছে। এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের জন্য বেশ ভালো সিস্টেম রেস্তোরাঁ। সাজেক গেলে আগে থেকে কথা বলে দরদাম করে ও পেজে ছবি দেখে রিসোর্ট বুকিং দেবেন।
জুড়ী আর কমলগঞ্জে চা বাগানে, অরণ্যে
মৌলভীবাজারের দুই উপজেলা কমলগঞ্জ আর জুড়ী। এর মধ্যে কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গলে পর্যটকদের বেশ যাতায়াত থাকলেও জুড়ি তুলনামূলক অচেনা পর্যটকদের কাছে। চা-বাগানের জন্য কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গলের নাম থাকলেও জুড়ীতেও চোখ জুড়িয়ে দেওয়া কিছু চা-বাগান আছে। এগুলোর মধ্যে সাগরনাল, ফুলতলা, দিলকুশা, রাজকী উল্লেখযোগ্য।
অরণ্যপ্রেমীদের জন্য জুড়ী হওয়া উচিত অটো চয়েজ। আমার মতে, সিলেট বিভাগের সবচেয়ে সুন্দর বনগুলোর একটি লাঠিটিলা। এটিও পড়েছে জুড়ীতে। লাঠিটিলা যাওয়ার পথে পাহাড় আর চা-বাগানের মনোরম দৃশ্যও মুগ্ধ করবে আপনাকে। ঘুরে আসতে পারেন সাগরনাল কিংবা রাগনার জঙ্গলেও।
কমলগঞ্জের মাধবপুর লেক আর চা-বাগান রাজ্য সব সময়ই মুগ্ধ করে পর্যটকদের। যেমন আকৃষ্ট করে লাউয়াছড়ার অরণ্য। তবে লাউয়াছড়ায় মানুষের ভিড় বেশি থাকায় অরণ্যপ্রেমীদের জন্য আদর্শ হতে পারে রাজকান্দি রেঞ্জের আদমপুর কিংবা কুরমার জঙ্গল। কুরমা বিটেই বিখ্যাত হামহাম জলপ্রপাতের অবস্থান। আবার কমলগঞ্জ থেকে শ্রীমঙ্গলে এসে তারপর পাহাড়-জঙ্গল মাঝের পথ দিয়ে চলে যেতে পারেন চুনারুঘাটের কালেঙ্গার জঙ্গলেও।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
শ্যামলী, হানিফসহ নামী সব পরিবহন সার্ভিসের বাস যায় মৌলভীবাজার। পথে শ্রীমঙ্গলে নেমে সেখান থেকে কমলগঞ্জ যেতে পারবেন অনায়াসে। আবার কুলাউড়া বাসে গিয়ে সেখান থেকে যেতে পারবেন জুড়ীতে। ট্রেনে গেলে কমলগঞ্জের জন্য ভানুগাছ আর জুড়ীর জন্য কুলাউড়া স্টেশনে নামাটাই ভালো।
কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে থাকার জন্য চমৎকার কিছু হোটেল-রিসোর্ট আছে। জুড়ীতে থাকার জন্য সেরকম ভালো রিসোর্ট-হোটেলের সংখ্যা কম। কুলাউড়ার কোনো হোটেলে রাত কাটাতে পারেন। অবশ্য পরিচিত থাকলে জুড়ীর কোনো চা-বাগানে থাকতে পারলে সেটা হবে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা।