শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন

ইলিশ মাছ আর মুড়ি আপ্যায়নে মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণ

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৪

বৃহস্প‌তিবার আমার অফ ডে। বা‌ড়ি‌তে দুপু‌রে খাবার খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নি‌চ্ছি। আমার দুই ছে‌লে রা‌হিদ (১৪) আর রা‌ফিন (৯)। আমি বা‌ড়ি থাক‌লে তারা আমার মোবাইল দখলে নেয়। নি‌য়ে গেম খেলে। দুপু‌রে ভাত খাওয়ার পর চো‌খে তন্দ্রা লে‌গে আস‌ছে। এমন সময় ছোট ছে‌লে রা‌ফিন ফোন হা‌তে নি‌য়ে এসে ব‌লে, বাবা অফিস থে‌কে ফোন। আমি ফোন রি‌সিভ ক‌রলাম। অপর প্রান্ত থেকে কথা বললেন আমা‌দের জয়েন্ট নিউজ এডিটর প্রশান্ত দাদা। বল‌লেন, ইব্রা‌হিম ভাই ফকরু‌দ্দিন জু‌য়েল ভাই আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। জুয়েল ভাইকে আমি সালাম দিলাম। ভাই বলল ইব্রা‌হিম ভাই আমরা ভোলা যা‌চ্ছি। আপ‌নি আমা‌দের সঙ্গে যা‌চ্ছেন। কোনো সমস্যা নেই তো? জবাব দিলাম, না ভাই। ভাই বললেন, তাহ‌লে ভাবি‌কে ব‌লে তিন দি‌নের ছু‌টি নি‌য়ে নেন। আমরা ২২ সেপ্টেম্বর ভোলা যা‌চ্ছি। পরে বললাম ওকে ভাই। রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) জুয়েল ভাইয়ের ফোন। বললেন ইব্রা‌হিম ভাই আপনি কোথায়?  অফিসে থা‌কেন আমি আস‌ছি। আপনি আমার সঙ্গে সদরঘাট যা‌বেন।

আমরা ছয়জ‌নের মধ্যে চারজন অফিস থেকে যাবো। এর ম‌ধ্যে একজন আমাদের রিপোর্টার ফখরুল শাহীন। তার বাড়ি ভোলা চর ফ্যাশনে। ইতিমধ্যে শাহীন ভাইকে লঞ্চের কেবিন নেওয়ার জন্য সদরঘাট পা‌ঠি‌য়ে‌ছেন জুয়েল ভাই। আমরা অফিস থে‌কে বিকেল সাড়ে ৫টায় সদরঘাটের উদ্দেশে রওনা হই। এর ম‌ধ্যে শাহীন ভাই ফোন করে বলেন ‘ফারান ১৪’ লঞ্চের তিন তলায় তিন‌টি ডাবল কে‌বিন নেওয়া হ‌য়ে‌ছে। আপনারা ভিআইপি টার্মিনালে আসেন। আমি আপনা‌দের জন্য অপেক্ষা কর‌ছি। আমরা সন্ধ্যা ৭টার দিকে সদরঘাট পৌঁছালাম। আমা‌দের রি‌সিভ ক‌রেন শাহীন ভাই।

চার জন এক‌ত্রিত হলাম। বা‌কি রইল দুজন। তাদের একজন আমাদের সহকর্মী এহসান ভাই। তার বা‌ড়ি পুরান ঢাকার সূত্রাপুর। লঞ্চঘাটে সরাসরি আসবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনিও এলেন। আরেকজন সহকর্মী সো‌হেল ভাই এখনও আসেননি। লঞ্চ ছাড়তে আর মাত্র ২০ মি‌নিট বা‌কি। আমরা খুব টেনশ‌নে আছি। তার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ কর‌ছি। শাহীন ভাই জানা‌লেন, আহসান ম‌ঞ্জিলের সাম‌নে আছেন সোহেল ভাই। আমরা লঞ্চের কে‌বি‌নের সামনে বারান্দায় দাঁ‌ড়ি‌য়ে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি সো‌হেল ভাইয়ের দেখা পাই কি না। কিন্তু তাকে দেখা গেলো না। শেষ পর্যন্ত লঞ্চ ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছে। আমাদের ম‌নে একটু কষ্ট লগছে। সো‌হেল ভাই ম‌নে হয়, আমা‌দের সঙ্গে যে‌তে পারলেন না। মনে হয় লঞ্চ মিস করলেন। হটাৎ সো‌হেল ভাই! আমা‌দের কেবি‌নের সাম‌নে। তাকে দে‌খে ম‌নের ম‌ধ্যে আনন্দ অনুভু‌তি প্রতিফ‌লিত হলো। যাক তাহ‌লে সো‌হেল ভাই আমা‌দের সঙ্গে যাচ্ছেন।

রা‌তের আধা‌রে ব‌রিশালগা‌মী লঞ্চ বা‌তি জ্বা‌লি‌য়ে চল‌ছে। দূর থে‌কে দেখ‌লে ম‌নে হয় নদীর মাঝে কোনো আধু‌নিক শহরের বিল্ডিং দা‌ড়ি‌য়ে আছে। কে‌বি‌নের বারান্দায় ব‌সে  শীতল বাতাস। নদীর ঢেউয়ের কলকল শব্দ। রা‌তের আকাশ উপ‌ভোগ করতে করতে কখন যেন চোখ লেগে গেল। সকাল  ৬টায় চর ফ্যাশনের বেতুয়া লঞ্চঘা‌টে পৌঁছালাম। আগে থে‌কে আমা‌দের জন্য একটা মাইক্রোবাস প্রস্তুত ছিল। আমরা চ‌লে গেলাম কচ্ছ‌পিয়া ঘাটে। সেখান থে‌কে স্পিডবোট ক‌রে আমরা রওনা দিলাম চর কুক‌রি মুক‌রির দি‌কে।

চর কুক‌রি মুক‌রি মেঘনা নদীর মোহনায়। বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেষে অবস্থিত। আমা‌দের স্পিডবোটটি বঙ্গোপসাগর দি‌য়ে কুক‌রি মুক‌রি যাত্রা ক‌রে। যাওয়ার প‌থে চারদিকে অথৈ পা‌নি। যে দি‌কে তাকাই শুধু পা‌নি আর পা‌নি। জে‌লে নৌকা ছাড়া আর কিছুই চো‌খে পরে না। নৌকাগুলো থেকে জেলেরা সাগ‌রে ইলিশ মাছ ধর‌ছে। আমরা স্পিডবোট থামি‌য়ে তাদের  সঙ্গে কুশল বি‌নিময় করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম কি মাছ ধরছে, ইলিশ নাকি? সাগ‌রে মাছ কেমন? প্রশ্নের জবা‌বে বললেন ইলিশ মাছ। সাগ‌রে এবার প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পর‌ছে। প্রশ্ন করলাম, জাল তুলবেন না? বললেন দুই ঘণ্টা প‌র তুলবেন। সাগ‌রে ইলিশ মাছ ধরার দৃশ্য তা জীব‌নে প্রথম দেখলাম। তারপর আবার সাম‌নের দিকে ছুটে চললাম।

কিছুক্ষণ পর মেঘনা মোহনার কাছে। দেখলাম এক‌টি নৌকায় ক‌য়েকজন মি‌লে মাছ ধর‌ছে। সাম‌নে গি‌য়ে দেখি এক‌টি প‌রিবার। পাঁচজন মাছ ধর‌ছে। তা‌দের ম‌ধ্যে আট-নয় বছরের দুই শিশু। তা‌দের জিজ্ঞাসা করলাম ভয় ক‌রে না এত বড় নদীতে মাছ ধর‌তে? তারা বলল আমরাতো নদী‌তেই থা‌কি।  ভয় কর‌বে কেন। আমরা চ‌লে আসলাম কুক‌রি মুক‌রি চ‌রে। গি‌য়ে উঠলাম কুক‌রি মুক‌রির চ‌রের রেস্ট হাইজে।‌ আগে থে‌কে রেস্ট হাউজ বু‌কিং ছিল। তাই থাকার কোনো সমস্যা হয়নি। দুপু‌রের খাওয়া শে‌ষে একটু রেস্ট নি‌য়ে অটো নি‌য়ে বের হলাম। এক অটো‌তে ছয়জন।

হ‌রিণ দেখ‌তে ব‌নের ম‌ধ্যদি‌য়ে পাকা রাস্তায় আমরা চল‌ছি। কিন্তু হ‌রিণের দেখা পেলাম না। সবসময় হ‌রিণ দেখা যায় না। তাই আমরা চ‌লে আসলাম স্থা‌নীয় বাজা‌রে। ম‌হিষের দুধের চা পান ক‌রে তৃপ্তি পেলাম। এরপর অটোতে করে শাহীন ভাই আমাদের নিয়ে গে‌লেন মা‌ছের আড়তে। তাজা ইলিশ। দেড় কে‌জি ওজ‌নের দুইটা  ডিমওয়ালা ইলিশ কি‌নে আন‌লেন। আমা‌দের ভাইয়ের ইলিশের ডিম খুব পছন্দ। তাই আমা‌দের খাবা‌রে সবসময় ইলিশ মাছ থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। আমরা আস‌ছি ইলিশ ধরার সিজ‌নে। ইলিশ মাছ খাওয়ার জন্য। এখন আমাদের সকালে ইলিশ, দুপু‌রে ইলিশ রা‌তেও  ইলিশ। খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকা‌লে ইলিশ মাছ ধর‌তে জে‌লেদের সঙ্গে নৌকায় যাওয়ার কথা। দু‌র্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে যাওয়া হ‌লো না। সাগ‌রে তিন নম্বর সতর্ক সং‌কেত। আমা‌দের চর কুক‌রি মুক‌রির ট্যুর সংক্ষিপ্ত ক‌রে মনপুরা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা করলাম। স্পিডবোটে চ‌ড়ে ব‌নের ভেতর খাল দি‌য়ে আমরা চ‌লে আসলাম বেতুয়া ঘাট। আবহাওয়া খারাপ। এখান দি‌য়ে আসার কারণ মেঘনার মোহনায় প্রচুর ডেউ। বেতুয়া ঘা‌টে নির্ধারিত মাইক্রোবাস আমা‌দের নিয়ে চল‌ছে মাদ্রাজ নতুন সুলিজ লঞ্চ ঘাটের দি‌কে। সেখান থে‌কে স্পিডবোটে ক‌রে মনপুরা দ্বী‌পে যাব। পথিমধ্যে চর ফ্যাশনের জ্যাকব টাওয়ার ও ম‌ডেল মস‌জিদ দেখলাম। জ্যাকব টাওয়ারে উঠার ইচ্ছা ছিল। বন্ধ থাকায় উঠা ‌গেল না। জ্যাকব টাউয়ার ওপর থে‌কে চর ফ্যাশনের পুরো এলাকা দেখা যায়।

তাই আমরা রওনা দিলাম নতুন সু‌লিজ লঞ্চ ঘাটে। লঞ্চ ঘাট‌টি একটু খা‌লের ভেতর থাকায় লঘুচাপের কারণে সাগ‌রে তিন নম্বর সর্তক সং‌কেত টের পেলাম না। খাল‌ থে‌কে বের হ‌য়ে যখন মেঘনা মোহনায় এলাম, তখন টের পেলাম কত ধা‌নে কত চাল! ঢেউয়ের কারণে আমা‌দের স্পিডবোটটি নদীর চর থেকে পাঁচ ফুট ওপরে উঠে যায়। আবার ঝপাস করে নদীতে পরে। হৃদপিন্ড ধুক ধুক করছে, কলিজা শুকিয়ে গেছে ভয়ে। আমাদের এক কলিগ এহসান ভাই। তার হার্টে তিনটি রিং পরানো। তার অক্সিজেন লেবেল কমে যাওয়ায় Eco Aspirin. Nidocard Spray নিচ্ছেন। আর বলছে ভাই কিছুইতো দেখা যাচ্ছে না । নদীর ঢেউয়ের ঝাঁপটায় আমরা সবাই ভিজে গেছি।

‘ভাই আমার ক্যামেরার ব্যাগ রক্ষার জন্য একটু পলিথিন দেন, ক্যামেরা ভিজে যাচ্ছে’ আমি বললাম। তখন আমাদের ফকরুল শাহীন বললেন, ‘রাখেন আপনার ক্যামেরা, মানুষ মরে যাচ্ছে। আপনি আছেন আপনার ক্যামেরা নিয়ে। ভয়ে কাতর ভীতসন্ত্রস্ত মন কাকভেজা অবস্থায় আমরা যখন চর মুনপুরার জনতা ঘাটে এসে পৌঁছালাম, দেখলাম নিন্মচাপের কারণে মাছ ধরার ট্রলারগুলো নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করছে। আমাদের দেখে তাকিয়ে আছে। মনে হলো আমরা অন্য কোনো গ্রহের মানুষ। এর কারণ হয়তো আমাদের ভেজা শরীর। অথবা ভয়ে ক্ষত-বিক্ষত চেহারা দেখে হয়তো। তীরে উঠলে একজনের প্রশ্ন, আপনারা এখানে কেন? প্রশ্ন শুনে বুঝতে পারলাম সাগরের তিন নম্বর সতর্ক সংকেত, উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করে মুনপুরা দ্বীপ ঘুরতে আসা। তাই তারা ফেলফেল করে তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। এখন অফসিজন। এই সময় সাগর উত্তাল থাকে। যেকোনো সময় ঝর-বৃষ্টি হতে পারে। তাই এই সময় পর্যটক আসেন না।

জনতা ঘাট থে‌কে অটো নি‌য়ে আমরা চলে গেলাম হো‌টে‌লে। গি‌য়ে ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে। হোটে‌লের বারান্দায় শুকাতে দিলাম। গোসল ক‌রে দুপু‌রের থাবার খে‌য়ে একটু রেস্ট নি‌য়ে বিকে‌লের দি‌কে তিন‌টি মোটরসাইকেলে বের হলাম। গেলাম দ্বী‌পের সৌন্দর্য উপ‌ভোগ কর‌তে। বেড়িবাধ দি‌য়ে  চরের সৌন্দর্য উপ‌ভোগ কর‌তে করতে সন্ধ্যা হ‌য়ে গে‌ল। আমরা চলে গেলাম মেনপুরা দ্বী‌পের ল্যান্ডিং স্টেশনে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ থেকে চলে আসছি। এইসময় আমাদের মোটরসাইকেল চালকের মোবাইলে ফোন এলো। তিনি বললেন, আমাদের মধ্যে শাহীন ভাই কে? শাহীন বলল আমি। তিনি বললেন, এনাম হাওলাদার ভাই আপনাকে নিয়ে যেতে বলছে। আপনার নাম্বার না থাকায় আমাকে ফোন দিয়েছে। আপনাদের নিয়ে আসার সময় আপনাকে মোটরসাইকেলে দেখেছে। তাকে বললাম, তোমার নাম্বার জানলো কীভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলল এখানে আমরা সবাই সবাইকে চিনি।

আমরা চলে গেলাম জনতা ঘাটে। শাহীন ভাইয়ের বন্ধুর কাছে। জনতা ঘাটের ইলিশ মাছের আড়তদার আমাদের দেখে দুইটা ইলিশ মাছ ভাজতে পাঠালেন। সাথে মুড়ি আর কোমল পানীয়। মাছ বাজারে এই ফাঁকে ইলিশ মাছ কেনা-বেচার দৃশ্য দেখলাম। কীভাবে ইলিশ মাছ আড়তে বেচা-কেনা হয়। আমাদের জন্য ইলিশ মুড়ি তৈরি হলো। ইলিশ মুড়ি খেয়ে তৃপ্তি পেলাম। ইলিশ মুড়ি এখানকার ভিআইপি আপ্যায়ন। ভুলে গেলাম কলিজায় পানি শুকানো উত্তাল মেঘনায় চল্লিশ মিনিটের ভয়াবহ স্পিটবোটের সময়টা।

জীবনে স্মরনীয় হয়ে থাকবে চর কুকরি মুকরি ও মনপুরা দ্বীপের ভ্রমণ। ধন্যবাদ আমাদের এনটিভি অনলাইনের সম্পাদক ফকরুদ্দিন জুয়েল ভাইকে। আমাকে ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে নেওয়ার জন্য। আর ধন্যবাদ জানাই ছয়জনের সবাইকে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com