অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নয়নাভিরাম সমুদ্রসৈকত, প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত মন্দির আর অসংখ্য দ্বীপপুঞ্জে ভরা ইন্দোনেশিয়া সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছেই যেন এক স্বপ্নময় জগৎ! তাছাড়া বিশ্বের এই বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জটিতে রয়েছে ছোট, বড়মাপের অসংখ্য আগ্নেয়গিরি। ঠিক যে কারণে সাধারণের কাছে এটি ‘আগ্নেয়গিরির দেশ’ নামেও পরিচিত। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেও ইন্দোনেশিয়ার খ্যাতি আজ জগৎজোড়া। আটদিনের এক ছোট্ট সফরসূচি নিয়ে এই দ্বীপপুঞ্জের দু’টি উল্লেখযোগ্য দ্বীপ, জাভা ও বালি ঘুরে দেখার জন্য পাড়ি দিলাম আমরা।
কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে রাতের ফ্লাইট ধরে চার ঘণ্টায় সিঙ্গাপুর। তারপর আরও দু’ঘণ্টা ওড়ার পর যখন জাভার যোগ জাকার্তায় ‘আদিসূতজিপ্তো’ এয়ারপোর্ট পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন সকাল দশটা। ছোট্ট ছিমছাম এয়ারপোর্ট। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে জাভানিজ় তরুণ একো। ওর সঙ্গে হোটেলে পৌঁছে, স্নান-খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম শহর দর্শনে। যেতে যেতে একো জানায়, সন্ধে পর্যন্ত শহরটি দেখে আমরা ডিনার সারব। তারপর থিয়েটারে রামায়ণ ব্যালে দেখে ফিরে আসব হোটেলে। ব্যালে শুরু হওয়ার কথা রাত আটটায়। হাতে অনেকটাই সময়। শহর ঘুরতে গিয়ে দেখি, সুপ্রাচীন এই শহরটিতে ঝাঁ-চকচকে শপিং মল, হোটেল যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে জাভানিজ় স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠা ঘরবাড়িও।
অধিকাংশই একতলা, মাথার দু’দিকে ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে লাল টালির চাল। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম নির্ধারিত জায়গায়। জায়গাটির নাম ‘পুরাউইসাতা’। প্রশস্ত প্রাঙ্গণে রেস্তরাঁ ও থিয়েটার হলটি একই জায়গায় অবস্থিত। আমরা ডিনার সেরে নিয়ে ঢুকে পড়লাম অডিটোরিয়ামে। তিনদিক খোলা মঞ্চে ঠিক রাত আটটায় শুরু হল অনুষ্ঠান। রাম-সীতার বনবাসপর্বে মারীচ-বধ থেকে শুরু করে সীতাহরণ, জটায়ু-বধ, হনুমানের লঙ্কাদহন, রাবণ-বধ এবং সবশেষে সীতা উদ্ধারের পর রাম-সীতার অযোধ্যা-গমন ও সীতার অগ্নিপরীক্ষার পর শ্রীরামচন্দ্রের সিংহাসনে আরোহণ পর্যন্ত ঘটনাবলী মাত্র দেড় ঘণ্টার এক বর্ণময় অনুষ্ঠানে ফুটিয়ে তুললেন শিল্পীরা। ইন্দোনেশিয়ায় রামায়ণ ও মহাভারত দুটিই খুব জনপ্রিয়। বিভিন্ন জায়গায় নিয়মিত মঞ্চস্থও হয়।
অনুষ্ঠান শেষে রাতের শহর দেখতে দেখতে ফিরে আসি হোটেলে। একো জানিয়ে দেয় পরদিন আমরা যাব বিশ্বের বৃহত্তম বুদ্ধমন্দির ‘বোরোবুদুর’-দর্শনে। পথে দেখে নেব ‘পাওন’ ও ‘মেনদূত’ নামে আরও দু’টি প্রাচীন মন্দিরও। পরদিন খুব সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। বেশ কিছুটা পথ চলার পর দূরে তাকাতেই দেখলাম আগ্নেয় পাহাড়। আরও কিছুটা এগোনোর পর আমরা পৌঁছে যাই নবম শতাব্দীর মধ্যভাগে শৈলেন্দ্র রাজবংশের আমলে প্রতিষ্ঠিত ‘পাওন’ মন্দিরে। এটি মধ্য জাভার অন্যতম বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দির। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সবুজ গাছ-গাছালিতে ছাওয়া প্রান্তরের মাঝে কালো পাথরে গড়া মন্দির। মন্দিরের ভিতরে একটি প্রায়ান্ধকার কক্ষে রয়েছে তথাগত বুদ্ধের আসনে উপবিষ্ট মূর্তি। প্রবেশপথের দু’ধারে সারিবদ্ধ দোকান। সেখানে বিক্রি হচ্ছে নানাধরনের স্মারক। পাওন মন্দিরটি দেখে আমরা চলে এলাম ‘মেনদূত’ মন্দিরদর্শন। দূরত্ব সামান্যই। এটিও বুদ্ধমন্দির, তবে আকারে একটু ছোট।
মাত্র কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়েই ওঠা যায় মন্দিরটিতে। দর্শন সেরে রওনা দিলাম বহুখ্যাত বোরোবুদুরের পথে। পরিচ্ছন্ন পথের দু’ধারে দোকানপাট, ঘন জনবসতি। একো জানায়, নবম শতাব্দীতে শৈলেন্দ্র রাজবংশের শাসনকালেই তৈরি হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী এই মন্দিরটি। চোদ্দশ শতাব্দীতে হিন্দু রাজ্যগুলির পতন হলে এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা ইসলামধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সেইসময় দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বোরোবুদুর পড়ে থাকে অবহেলায়। ঘন ঝোপ-জঙ্গলে এবং নিকটবর্তী আগ্নেয়গিরিটি থেকে বেরিয়ে আসা ছাইয়ে ঢেকে যায় মন্দিরের সিংহভাগ। একসময় বোরোবুদুর চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। পরবর্তীকালে ১৮১৪ সালে ব্রিটিশ শাসক স্যর টমাস স্ট্যামফোর্ড রাফেলস্ ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করে মন্দিরটিকে আবার প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। অসাধারণ স্থাপত্যটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। মন্দিরের সামনে বহুদূর থেকেই চোখে পড়ে পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা বোরোবুদুর মন্দিরের শীর্ষ গম্বুজটি। এমনকি শীর্ষ গম্বুজের দু’পাশে থাকা ছোট-ছোট গম্বুজগুলিও। কাছে গিয়ে দেখি ঘন সবুজ অরণ্যবেষ্টিত সুবিশাল প্রান্তরের মাঝে অবস্থিত মন্দিরটি। মাঝখান দিয়ে বাঁধানো পথ চলে গিয়েছে মন্দির অবধি। মন্দিরের পূর্বদিকে একটা খাড়াই পাথরের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে উপরের দিকে। সেই সিঁড়ি বেয়েই আমরা পৌঁছলাম প্রথম ধাপটিতে। দেখি দিগন্তবিস্তৃত সবুজের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে আগ্নেয়গিরিটি। মাথায় কালো মেঘ। দেখে মনে হচ্ছে যেন ধুম উদ্গীরণ করছে!
পুরো মন্দিরটিই বড় বড় কালো পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি। প্রতিটি পাথরের গায়েই খোদাই করা রয়েছে তথাগত বুদ্ধের জীবনী। কালের বিবর্তনে বেশ কয়েকটি পাথর ক্ষয়ে গেলেও বেশিরভাগই অটুট। মোট ন’টি ধাপের উপর অবস্থিত এই মন্দিরটির নীচের ছ’টি ধাপ চারকোণ বিশিষ্ট ও উপরের তিনটি গোলাকার। দেখতে দেখতে উঠে গেলাম একদম উপরের ধাপটিতে। শীর্ষে পৌঁছে দেখি মূল গম্বুজটির নীচে রয়েছে অনেকগুলি ছোট ছোট ঘণ্টা আকৃতির গম্বুজ। এখানে মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে রয়েছে জমজমাট দোকানপাট। ইন্দোনেশিয়ায় ডাবের ফলন খুব। আকারেও বেশ বড় এক একটি ডাবের দাম ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় পঁচাত্তর টাকা। বেশ কিছুক্ষণ এলাকাটি ঘুরে দেখে বেলা একটু গড়াতেই রওনা দিই হোটেলের দিকে।ফেরার পথে একো জানিয়ে দেয়, পরদিন সকাল আটটায় আমরা রওনা দেব ঐতিহাসিক ‘প্রাম্বানান’ মন্দিরের পথে। যেখানে একই চত্বরে বিরাজ করছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও দেবাদিদেব মহাদেব।
পরদিন প্রাম্বানান মন্দিরের পথে দু’ধারেই চোখে পড়ল আম, কাঁঠাল, ডাব আর কলাগাছের সারি। প্রকৃতির অকৃপণ রূপ দেখতে দেখতে চলে আসি ইন্দোনেশীয় রাজাদের বাসগৃহ সুলতান রয়্যাল প্যালেসে। এখানে রাজবাড়ির ভিতরে বিশাল প্রাঙ্গণে রয়েছে প্রাক্তন রাজাদের ঘর, বিবাহ বাসর, আলোচনাকক্ষ এমনকি বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া উপহার সামগ্রীও। রাজপ্রাসাদ দেখে বেরিয়ে এসে একটা সুদৃশ্য তোরণ পেরিয়ে ঢুকে পড়ি পাশের ওয়াটার ক্যাসল্-এ। চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এই অঞ্চলটিতে পাশাপাশি রয়েছে তিনটি বাঁধানো জলাশয়। একটি রাজপরিবারের মহিলাদের, একটি পুরুষদের ও অবশিষ্টটি সাধারণের ব্যবহারের জন্য। ওয়াটার ক্যাসল্ দেখে বেরিয়ে রওনা দিই যোগ জাকার্তা শহরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মন্দির প্রাম্বানান-এর পথে। বিশাল এলাকাজুড়ে মন্দিরগুলি। ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু সঞ্জয় রাজবংশের রাজত্বকালে তৈরি হয়েছিল মন্দিরগুলি। কথিত আছে, বৌদ্ধদের জন্য নির্মিত বোরোবুদুর মন্দিরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে প্রায় একই সময়ে হিন্দুদের জন্য প্রাম্বানান মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয়। সব মন্দিরগুলিতেই অনুসৃত হয়েছে হিন্দু স্থাপত্যরীতি। এখানে একই চত্বরে রয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেবের মন্দির। ১৯৯১ সালে ইউনেস্কো এই মন্দিরটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম বলে ঘোষণা করে। মূল ফটক থেকে অনেকটা ভিতরে মন্দিরগুলির অবস্থান। একসময় ছোট-বড় মিলিয়ে এখানে মন্দির ছিল দুশো চল্লিশটি। বর্তমানে অধিকাংশই ধ্বংসস্তূপ। বোরোবুদুরের মতো এগুলিও কালো পাথরের ব্লক সাজিয়ে তৈরি। একো জানায়, প্রতি পূর্ণিমা রাতে এই মন্দির চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণাঢ্য রামায়ণ ব্যালে। প্রাম্বানান দেখা সাঙ্গ করে বেরিয়ে এসে দেখি পর্যটকদের মূল ফটকের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে চারদিক খোলা ছোট্ট দুকামরার গাড়ি।
ফেরার পথেই পড়ে ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধমন্দির ‘মঞ্জুশ্রী’। মূল মন্দিরটি অক্ষত থাকলেও সামনের দিকটি ভগ্নপ্রায়। দেখতে দেখতে গাড়ি এসে দাঁড়ায় মূল ফটকের সামনে।
এখানে বেশ বড়সড় শৌখিন দ্রব্যাদির বাজার রয়েছে। বাজারটি ঘুরে দেখে ফিরে আসি হোটেলে। যোগ জাকার্তায় এটাই আমাদের শেষ রাত। পরদিন সকালেই পাড়ি দেব বালিদ্বীপের পথে।
ভোরে ঘুম ভাঙে জাভাকন্যার ‘ওয়েক আপ’ কলে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়েই বেরিয়ে পড়ি বিমানবন্দরের পথে। এখান থেকে সকাল আটটার ফ্লাইট ধরে পাড়ি দেব বালি দ্বীপে। মাত্র এক ঘণ্টার উড়ান। নামার সময় জানলা দিয়ে নীচে তাকাতেই চোখে পড়ে ছোট ছোট দ্বীপের মধ্যে জাভানিজ় স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠা বাড়িঘর। পাশেই টলটলে নীল জলে ভেসে বেড়ানো নৌকো ও লঞ্চ। দেখতে দেখতে নেমে আসি ‘দেনপাসার’ এয়ারপোর্টে।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সোজা রওনা দিই হোটেলের পথে। পরিচ্ছন্ন পথ ধরে কিছুটা এগোতেই পথের মোড়ে এক বিশাল স্ট্যাচু। মুখোমুখি মহাভারতের দুই যুদ্ধরত চরিত্র। একজন রথারূঢ়, সম্ভবত তিনি কর্ণ। মসৃণ পথের দু’ধারে বড় বড় পাম গাছের সারি। পরের গন্তব্য সমুদ্রতল থেকে বারোশো মিটার উচ্চতায় অবস্থিত উলুন দানু মন্দির দর্শন। রাজা আগুঙ্গ নির্জন পরিবেশে ধ্যান করার জন্য ‘বেরাতন’ হ্রদের ধারে এই মন্দিরটি নির্মাণ করান। মন্দির প্রাঙ্গণে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের সুন্দর সহাবস্থানও চোখে পড়ে।
শহর থেকে ‘উলুন দানু’ প্রায় আড়াই ঘণ্টার পথ। বেলা দেড়টায় রওনা দিয়ে চারটে নাগাদ পৌঁছে যাই গন্তব্যে। গেট দিয়ে ঢুকতেই সামনে এক আশ্চর্য সুন্দর বাগান। বাগানটির পিছনেই দিগন্তজোড়া পাহাড়ের কোলে টলটলে জলে ভরা বেরাতন হ্রদ। তখন হ্রদের জলে ঢেউ তুলে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে কয়েকটি স্পিডবোট। স্বভাবতই এখানে উপচে পড়ছে পর্যটকদের ভিড়। ইদানীং নাকি সারা বিশ্বের নবদম্পতিদের কাছেই মধুচন্দ্রিমাযাপনের আদর্শ স্থান হয়ে উঠেছে বালি। পড়ন্তবেলায় অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু গায়ে মেখে হ্রদের তীরে বসে সকলেই উপভোগ করতে চাইছেন এই জায়গাটির স্বর্গীয় সুষমা। হ্রদের তীরে গড়ে ওঠা উলুন দানু মন্দিরটিও বড় অপরূপ দেখতে। সত্যি বলতে, শুধু উলুন দানু মন্দির ও বেরাতন হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যই বালি আসা যায়।
দিনের আলো একেবারেই কমে এসেছে। কেউ যেন কালো চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে দূর পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়, বেরাতন হ্রদের গায়ে। দিনের শেষে বাগানের ফুলগুলিও যেন একটু বিশ্রামের অপেক্ষায়। আর দেরি না করে বেরিয়ে আসি বাইরে। তারপর একটি ভারতীয় রেস্তরাঁয় খেয়েদেয়ে ফিরে যাই হোটেলে। পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ি পাহাড়ি গ্রাম কিণ্টামনির পথে। আমরা দেখব বালির অন্যতম জীবন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট বাটুর ও তার পাদদেশে অবস্থিত বাটুর হ্রদ এবং সেই সঙ্গে দুটি বিখ্যাত মন্দির তিরতা এমপুল ও তানহা লট, জাভাযাত্রীর পত্রে যে মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। অনেক জায়গাতেই পথের ধারে বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে অসংখ্য পাথরের মূর্তি। বেশ কিছুটা পথ চলার পর পৌঁছই তিরতা এমপুলে। এক হাজার বছরেরও বেশি পুরনো এই মন্দিরটি আসলে একটি পবিত্র জলের মন্দির। এটি বালি দ্বীপের অন্যতম জলের উৎসও বটে। এই মন্দিরে প্রবেশের সময় নারী-পুরুষ উভয়কেই একখণ্ড রঙিন বস্ত্র লুঙ্গির মতো করে পরে নিতে হয়। স্থানীয় ভাষায় বস্ত্রখণ্ডটির নাম সারঙ্গ। মন্দিরটির কাছেই একটি প্রস্রবণ থেকে বহুধারায় বেরিয়ে আসছে জল।
তিরতা এমপুল দেখে বেরোনোর মুখে পড়ে এক বৃহৎ জলাশয় যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ভেসে বেড়ায় রঙিন মাছ। এখান থেকে বেরোনোর পর গেলাম কফি উৎপাদন কেন্দ্রে। একজন জাভা তরুণী বিভিন্ন রকম কফির গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে শোনায়। হঠাৎ তার মুখে এক চমকপ্রদ তথ্য শুনি! ওই কেন্দ্রে ওরা পঞ্চাশটির মতো একরকমের প্রাণীকে লালন পালন করেন। পাশেই রাখা রাখা সেই প্রাণীটি, অনেকটা বনবিড়ালের মতো দেখতে। এই প্রাণীদের বিশেষত্ব হল কফির যে বীজগুলি ওদের খেতে দেওয়া হয়, সেগুলি ওরা হজম করতে পারে না। পরদিন সেই বীজগুলিই বেরিয়ে আসে ওদের বর্জ্য হিসেবে কফি তৈরির মূল প্রক্রিয়াটি চলে প্রাণীটির পাকস্থলীতে। তখন বীজগুলি পুনরায় সংগ্রহ করে ধুয়ে শুকিয়ে কড়াইতে ভাজা হয়। তারপর মেশিনে গুঁড়ো করে তৈরি হয় উৎকৃষ্ট মানের কফি। প্রাণীটির নাম লুয়াক। তাই কফির নামকরণও হয়েছে প্রাণীটির নামে, লুয়াক কফি। সাধারণ মানের কফি থেকে এই কফির দাম বেশ কয়েকগুণ বেশি। একটু দ্বিধা সত্ত্বেও খেয়ে দেখি অপূর্ব স্বাদ। তবে দাম শুনে আর কিনে আনার কথা ভাবিনি।
এরপর আমরা চলে আসি সমুদ্রতল থেকে পাঁচহাজার ছশো ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট মাউন্ট বাটুর-এর পাদদেশে অবস্থিত বাটুর হ্রদের কাছে। সুন্দর পাহাড়ি এলাকা। অনেকটা আমাদের সিমলা বা মানালির মতো। রাস্তার একদিক রেলিং দিয়ে ঘেরা, রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালেই চোখে পড়ে মাউন্ট বাটুর। এটি একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। এই মাউন্ট বাটুরের পাদদেশেই পাহাড়ের গা-বেয়ে নেমে আসা ঝরনাধারায় পুষ্ট বাটুর হ্রদ। হ্রদের ধারে পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠেছে নয়নাভিরাম কিন্তামণি গ্রাম। একেবারে ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মতোই দৃশ্য। তানহা লট-এর যত কাছে আসতে থাকি, পথের সৌন্দর্য ততই আমাদের মুগ্ধ করে দেয়। যখন পৌঁছই তখন অস্তগামী সূর্যের রঙিন আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সারা আকাশ। কাছে গিয়ে দেখি উত্তাল ভারত মহাসাগরের তীরে এ এক অসাধারণ সুন্দর জায়গা। সমুদ্র দেবতা বরুণ এই মন্দিরের আরাধ্য।
তবে মন্দিরটির বিশেষত্ব, জোয়ারের সময় শিলাখণ্ডের অনেকটা অংশই চলে যায় জলের তলে। তখন মনে হয়, পুরো মন্দিরটিই যেন জলের উপর ভাসছে। স্বভাবতই তখন মন্দিরে প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। আবার ভাটার সময় জল সরে গেলে সহজেই মন্দিরে প্রবেশ করা যায়। জোয়ারের জন্য আমিও মন্দিরে ঢুকতে পারিনি। তবে দেখেছি, মহাসাগরের উত্তাল জলরাশি ক্রমাগত ঢেউ তুলে একের পর এক এসে আছড়ে পড়ছে মন্দিরের গায়ে আর সেই অপরূপ দৃশ্যের সামনে মুগ্ধ নেত্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেশ বিদেশের পর্যটকেরা। পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ি আগুঙ্গ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত বালির অন্যতম পবিত্র মন্দির বেশাখী-র (বৈশাখী নয়) দিকে। মাউন্ট বাটুর ছাড়া বালির অপর যে আগ্নেয়গিরিটি এখনও সক্রিয় সেটি মাউন্ট আগুঙ্গ। পথের ধারে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে ধান বা ভুট্টার ক্ষেত। দেখতে দেখতে প্রায় দু’ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছই মন্দিরটির কাছে।
মন্দিরপ্রাঙ্গণ থেকে বেশ কিছুটা দূরেই নামতে হয় আমাদের। সারঙ্গ পরে মন্দিরপ্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ি আমরা। আগুঙ্গ পাহাড়ের কোলে মনোরম পরিবেশে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে মন্দিরগুলি। চূড়াগুলি প্যাগোডাধর্মী। বালি হিন্দু প্রধান অঞ্চল হওয়ায় এখানে হিন্দু মন্দিরের ছড়াছড়ি । স্থানীয় মহিলাদের দেখি বেতের চুপড়ির মধ্যে পূজার উপকরণ সাজিয়ে মাথায় নিয়ে চলেছেন মন্দিরের পথে। বেশাখী মন্দির দেখে বেরিয়ে এসে রওনা দিই এদিনের শেষ গন্তব্য উলু ওয়াতু মন্দিরের দিকে। অনেকটাই পথ। যেতে যেতে দেখি পর্যটকদের অনেকেই বাইক নিয়ে চলেছেন উলু ওয়াতুর পথে। শুনলাম বালি ভ্রমণে এসে অধিকাংশ পর্যটক সস্ত্রীক কিংবা একা বাইক ভাড়া নিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো দর্শনীয় স্থানগুলি দেখে নেন। তবে উলু ওয়াতু দর্শন সেরে শহরে ফেরার জন্য কোনও গণ পরিবহনের ব্যবস্থা নেই।
বালি সূর্যাস্তের জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে উলু ওয়াতু মন্দির থেকে ভারত মহাসাগরের বুকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অসাধারণ। এখানকার অন্যতম দ্রষ্টব্য বালির বিখ্যাত কেকাক নৃত্য। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে দেখি সুন্দর গাছ-গাছালিতে ছাওয়া প্রান্তর। সামনেই উত্তাল ভারত মহাসাগর। সাগরতীরের একটু উঁচুতে পাহাড়ের গায়ে মন্দির। মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছে নিস্তব্ধ প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে যখন চারপাশে তাকালাম তখন এক অপূর্ব অনুভূতিতে ভরে উঠল মন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে এলাম কেকাক নৃত্যদর্শনে। এখানে মঞ্চ বলে কিছু নেই। খোলা আকাশের নিচে একটা ছোট্ট গোলাকার স্টেডিয়ামে মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটিতে একখণ্ড পাথরের গায়ে জ্বলছে পাঁচটি অগ্নিশিখা।
সেই অগ্নিশিখা ঘিরে তিরিশ চল্লিশজন শিল্পী দেড় ঘণ্টা ধরে এক অপরূপ নৃত্যশৈলীতে ফুটিয়ে তুললেন রামায়ণ মহাকাব্যের এক বড় অংশকে। দিব্যি দেখছিলাম। হঠাৎ দেখি সারা পশ্চিমাকাশ রাঙিয়ে অস্তাচলে যেতে উদ্যত হয়েছেন সূর্যদেব। রাত আটটায় শেষ হল অনুষ্ঠান। গাড়িতে কিছুটা এগোতেই জিমবারান সমুদ্রসৈকত। এখানেই একটা হোটেলে আমাদের জন্য গাইড ব্যবস্থা করেছেন ক্যান্ডল লাইট ডিনারের। সৈকত বরাবর পরপর বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল। আমাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দেখি সমুদ্রতটে বালির ওপর পেতে রাখা চেয়ার-টেবলে বসে স্বল্পালোকে নৈশভোজে মেতে উঠেছে পর্যটকের দল। চোখের সামনে একের পর এক এসে আছড়ে পড়ছে ভারত মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ।
সমুদ্রসৈকতটির কাছেই দেনপাসার বিমানবন্দর। খানিক বাদেই খাবার এল, ভাত, সব্জি, তিন রকম সামুদ্রিক মাছ, স্যালাড ও সবশেষে একটা করে গোলাপজাম। পরিতৃপ্ত মনে রাতের শহর দেখতে দেখতে যখন হোটেলে ফিরি ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশটা। এযাত্রায় জাভা ও বালি ভ্রমণ শেষ। তাই ফেরার পথে একটু বিষণ্ণ রাগিণীর সুরও যেন বাজতে থাকে মনের ভিতর।