সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৩ অপরাহ্ন

ইটালিতে নিয়মিত বাংলাদেশির সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়েছে

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৩

ইউরোপের দেশ ইটালিতে বাংলাদেশিদের আসা শুরু হয় ৯০-এর দশকে৷ কিন্তু এটি তীব্র হয় ২০০০-এর দশকে৷ ইউরোপের বাইরের দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশিরা এখন ইটালিতে অষ্টম সর্বোচ্চ৷

চলতি বছরের জুলাইয়ে ইটালির শ্রম ও সামাজিক পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে৷

প্রতিবেদন অনুযায়ী,

২০২২ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী ইটালিতে নিয়মিতভাবে বসবাস করছেন এক লাখ ৫০ হাজার ৬৫২ জন বাংলাদেশি অভিবাসী৷ ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এটি সর্বোচ্চ৷

ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশিরা থাকেন ফ্রান্সে এবং তৃতীয় প্রধান দেশ স্পেন৷

তবে ইউরোপ মহাদেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বাস করেন যুক্তরাজ্যে৷ ব্রেক্সিটের পর দেশটি আর ইইউ’র অংশ না হওয়ায় ইটালিতে এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান বাংলাদেশি কমিউনিটির বসবাস৷

২০০২ সালে ইটালিতে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার৷ অর্থাৎ ২০ বছরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাত গুণ৷ ইটালিতে বসবাসরত বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে নিজ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷

ইটালি থেকে যেসব দেশে অভিবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়৷ ইটালি থেকে পাঠানো মোট রেমিট্যান্সের ১৫ শতাংশ যায় বাংলাদেশে৷

রাজনীতি, অর্থনীতি ও জলবায়ু

বাংলাদেশিরা যেসব প্রাসঙ্গিক কারণে ইটালিতে স্থায়ী হচ্ছেন সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা, নাজুক অর্থনীতি ও জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রধান হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ইটালি কর্তৃপক্ষ৷

প্রতিবেদন অনুযায়ী,

বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী কারণে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি থেকে নাগরিকদের দেশ ছাড়ার হার বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৪৪ লাখেরও বেশি মানুষ জলাবয়ু পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হয়ে তাদের ঘর বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন৷

২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় শীর্ষ দেশ৷ টানা বন্যা বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম৷

অপরদিকে, বিশ্বের অনেক দেশের মতোই কোভিড-১৯ মহামারি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে৷

২০২০ সালে এসে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমেছে, কমেছে রপ্তানি আয়৷ বিপরীতে, বেড়েছে বৈষম্য এবং দারিদ্র্যের হার, যা ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশ হয়েছে৷

৯০-এর দশকে ইটালিতে আসা বাংলাদেশি অভিবাসীরা মূলত দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত ছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷ প্রথমত, এক দল উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ তরুণ এবং একক পুরুষ অভিবাসী৷ তারা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ও উন্নত জীবনের খোঁজে ইটালিতে আসতে শুরু করেন৷

অপর ভাগে ছিলেন, অদক্ষ একক পুরুষ অভিবাসীরা, যারা কোনো একটি কাজের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে দেশে থাকা নিজেদের পরিবারের খরচ যোগান দেয়ার লক্ষ্যে ইটালিতে আসতে শুরু করেন৷

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আসা বাংলাদেশিদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে৷ এসব ব্যক্তিরা প্রায়শই আন্তর্জাতিক সুরক্ষা ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে থাকেন৷ মূলত লিবিয়ায় ‘সেকেন্ডারি মাইগ্রেশন’ বা অস্থায়ী কর্মী হিসেবে আসা তরুণ বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক দাসত্বের শর্ত থেকে মুক্তি পেতে ভূমধ্যসাগরের পথ বেছে নেন৷

নারী ও পুরুষ অভিবাসীদের সংখ্যায় অসমতা

ইটালিতে অবস্থানরত নিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে পুরুষ ও নারী অভিবাসীদের সংখ্যা মধ্যে বড় ধরনের লিঙ্গ অসমতা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে৷

বাংলাদেশিদের মধ্যে ৭১.৭ শতাংশ অভিবাসী একক পুরুষ হিসেবে ইটালিতে বসবাস করেন৷ আর নারীদের সংখ্যা ২৮.৩ শতাংশ৷ লিঙ্গ অসমতার দিক দিয়ে ইটালির ইইউ এর বাইরের দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ও সেনেগালের পর বাংলাদেশের অবস্থান৷

মূলত বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের শুরুতে পরিবারগুলো মূলত কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীদের ওপর বিনিয়োগ করে থাকেন৷ ফলে মোট বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে তরুণদের প্রধান্য বেশি৷ এছাড়া অভিবাসীরা নিয়মিত হওয়ার পর তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আসার সুযোগ পান৷ সেটাও এই বৈষম্য তৈরির অন্যতম একটি কারণ৷

ইটালিতে বাংলাদেশি পুরুষদের মধ্যে ৫৭.৩ শতাংশের বয়স ৩৫ বছর বা তার নিচে৷ ইউরোপের বাইরের দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের তুলনায় বাংলাদেশি তরুণ অভিবাসীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি৷

অপরদিকে বাংলাদেশি নারীদের মধ্যেও তরুণীদের সংখ্যা বেশি৷ মোট নারীদের মধ্যে ৩৫.৭ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক৷ ইউরোপের বাইরের দেশগুলো থেকে আসা মোট নারী অভিবাসীদের মধ্যে এই গড় ২০.৩ শতাংশ৷

২০২২ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ইটালিতে বাংলাদেশি অপ্রাবয়স্ক অভিবাসী বা ১৮ বছরের কম বয়সি অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার৷ যা ইউরোপীয় দেশগুলোর বাইরে থেকে আসা মোট অপ্রাপ্তবয়স্কের ৪.৫ শতাংশ

এছাড়া ইটালিতে বাংলাদেশি পরিবারগুলোতে জন্ম হার কমার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে৷ ২০২০ সালে তিন হাজার ৬২৯ জন নতুন বাংলাদেশি শিশু জন্ম নিলেও ২০২১ সালে সেটি দাঁড়ায় তিন হাজার ২১৮ জনে৷ প্রায় ১১.৩ শতাংশ কমেছে শিশু জন্মের হার৷

প্রতিবেদনে ইটালির পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্র দিয়ে বলা হয়েছে,

২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইটালিতে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৫৭১ জন, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৭৯.৯% কম৷

৪৬ শতাংশের বসবাস উত্তর ইটালিতে

ইটালিতে বাংলাদেশিরা কোথায় বসবাস করেন সেটি নিয়েও বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে দেশটির শ্রম ও সামাজিক পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ইন্টিগ্রেশন ও অভিবাসন বিষয়ক দপ্তর৷

তারা জানিয়েছেন, আনুমানিক ৪৬ শতাংশ বাংলাদেশি নাগরিক উত্তর ইটালির বিভিন্ন শহরে বাস করেন৷ বিশেষ করে, এ অঞ্চলের লোমবার্ডি শহরে ১৫.৭ শতাংশ বাংলাদেশির বসবাস৷ এ অঞ্চলের আরেক শহর ভেনেটোতে আছেন ১২.৪ শতাংশ বাংলাদেশি৷

দক্ষিণ ইটালির বিভিন্ন অঞ্চলে ১৭.৪ শতাংশ বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করছেন৷ এ অঞ্চলে প্রধানত ক্যাম্পানিয়া এবং সিসিলি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বসতি গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশিরা৷

বাংলাদেশিদের বাকি ৩৬.৪ শতাংশ সেন্ট্রাল ইটালিতে বসবাস করেন৷ তবে মোট সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বাস করেন সেন্ট্রাল ইটালির লাজিও অঞ্চলে৷ সেখানে মোট সংখ্যার ২৭.২ শতাংশ বাংলাদেশির অবস্থান৷ রোম লাজিও অঞ্চলের শহর৷

ইটালির রাজধানী রোমের মধ্য-পূর্ব এলাকায় বাংলাদেশিদের শক্তিশালী উপস্থিতি লক্ষণীয়৷

ইটালি কর্তৃপক্ষের মতে,

অভিবাসীদের আঞ্চলিক ঘনত্বের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সামাজিক একীকরণের ইতিবাচক স্তরের একটি সূচক হিসাবে বিবেচিত হতে পারে৷ কারণ এটির মাধ্যমে তারা ‘অভিবাসী শৃঙ্খল’ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। যা অভিবাসীদের তাদের পরিচিত ঘটনার সাথে যুক্ত হতে সহায়তা করে। এটি দীর্ঘমেয়াদী অভিবাসন প্রক্রিয়ার একটি ঐতিহাসিক সূচকের প্রতিনিধিত্ব করে৷

তবে একই সূচক শহরতলী বা উপ-পৌরসভা স্তরে বিবেচনায় নেওয়া হলে ইন্টিগ্রেশনের একটি নেতিবাচক অর্থের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি সম্ভাব্য আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার সংকেত দেয়, এবং তথাকথিত ‘ঘেটো’ অঞ্চল তৈরি করে।

২০২১ সালে ইটালিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য জারি করা নতুন রেসিডেন্স পারমিটের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৯৭৪টি৷ সংখ্যাটি আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি৷

২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনা মহামারির কারণে প্রশাসনিক কাজ স্থবির হয়ে পড়ায় ২০২১ সালের এমন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে৷ এছাড়া কাজও বিভিন্ন বৈধতার আওতায় নতুন বৈধতা পাওয়া অভিবাসীদের রেসিডেন্ট প্রাপ্তির সংখ্যাও ২০২১ সালের সংখ্যায় প্রভাব ফেলেছে।

২০২১ সালে নতুন রেসিডেন্স পারমিটপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের ৪৪ শতাংশ পারিবারিক পুনর্মিলন ভিসায় এসেছিলেন৷ পারিবারিক ভিসায় আসা অভিবাসীদের অর্ধেকেরও বেশি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন৷

দীর্ঘ মেয়াদি রেসিডেন্স পারমিট নিয়ে ৫৬.২ শতাংশ

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের শুধু ২৮৬ জন বাংলাদেশি নাগরিক কাজের ভিসা নিয়ে ইটালিতে প্রবেশ করেছিলেন৷ ২০২১ সালে এই সংখ্যাটি ছিল দুই হাজার ৭৮ জন৷

দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের অনুমতি বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, ইটালীয় ভূখণ্ডে বাংলাদেশিদের স্থিতিশীলতার প্রক্রিয়া এখনও সম্পূর্ণরূপে পরিপক্ক হয়নি৷

২০২১ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি রেসিডেন্স পারমিট নিয়ে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৫৬.২ শতাংশ৷ এসব ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম অংশটি পারিবারিক কারণে অর্থাৎ মা-বাবার উপস্থিতির কারণে বসবাস করছেন৷ দ্বিতীয় প্রধান সংখ্যক ব্যক্তিরা চাকরির কারণে দীর্ঘমেয়াদি পারমিট বহন করছেন৷

ইটালি কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর দেশটিতে অবস্থানরত ১৬টি প্রধান দেশের অভিবাসীদের নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে৷ শ্রম ও সামাজিক পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ডিরেক্টরেট এটির দায়িত্বে থাকে৷

যেসব দেশের অভিবাসীদের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় সেগুলো হলো: মরক্কো, আলবেনিয়া, চীন, ইউক্রেন, ভারত, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, মিশর, পাকিস্তান, মলদোভা, শ্রীলঙ্কা, সেনেগাল, টিউনিশিয়া, নাইজেরিয়া, পেরু এবং ইকুয়েডর৷

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com