লাংকাউইতে স্কাই ব্রিজ আর স্কাই ক্যাবের তীব্র আকর্ষণে আমরা যখন পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে গ্র্যাবের গাড়িতে ছুটে চলছিলাম, তখন রাস্তার পাশে আমাদের যেন স্বাগত জানাচ্ছিল দলে দলে বানর। তাদের দেখেই আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম।
লাংকাউই মূলত ছোট–বড় ৯৯টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। মূল ভুখণ্ডের মতো শহুরে নয় বলেই পৃথিবীর সব দেশ থেকে এখানে পর্যটকেরা ছুটে আসেন। প্রকৃতি আর আধুনিকতা যেন অপূর্ব এক মিশ্রণ নিয়ে কাছে ডাকে সবাইকে। লাংকাউই বিমানবন্দরে নামার আগে থেকেই এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমরা বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম। আর স্কাই ব্রিজ যাওয়ার জন্য স্কাই ক্যাবে ওঠার পর যখন দূরদিগন্তে দৃষ্টি প্রসারিত করলাম, তখন পাহাড়, সমুদ্র, মেঘ আর দূরের ইন্দোনেশিয়া যেন স্বর্গীয় এক দৃশ্য চোখের সামনে মেলে ধরল।
আমরা বেশ সকালেই পৌঁছালাম বলে ভিড় কম পেলাম। পর্যটনের মৌসুমও তখন ভাটার দিকে। তাই অনায়াসেই টিকিট পেলাম। টিকিট মানে একটা কাগজে বারকোড প্রিন্ট করা, সেটা কবজিতে ব্যান্ড হিসেবে পরে থাকতে হয় সর্বক্ষণ। ঢোকার মুখে বারকোড স্ক্যান করে প্রবেশাধিকার মিলল।
স্কাই ক্যাব শুরুতেই আমাদের নিয়ে গেল প্রথম স্টেশনে। তারে ঝুলন্ত গাড়িতে চড়ে শূন্যে ওঠার অনুভূতি ভাষায় অপ্রকাশ্য। একটু একটু করে ক্যাব উঠছে পাহাড়চূড়ার দিকে, আমার আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত হচ্ছে আদিগন্ত। সমুদ্র, আকাশ ও পাহাড় যেখানে নীল আর সবুজের এক অবিস্মরণীয় জলছবির মতো প্রতিভাত হয়।
প্রথম স্টেশনটিতে ইগলস নেস্ট নামে রয়েছে এক সুউচ্চ রেস্টুরেন্ট, যার অবকাঠামো ইগলের ঠোঁটের আদলে তৈরি। খাবারদাবারের দামও রেস্টুরেন্টের উচ্চতার মতো আকাশছোঁয়া। বাইরে মূল্যতালিকা দেখে ভেতরে আর ঢুকলাম না। বাইরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আর প্রকৃতি দেখেই আমরা তৃপ্ত।
এরপর টপ স্টেশনে নিয়ে স্কাই ক্যাব আমাদের নামিয়ে দিল। সেখান থেকে কিছু দূর হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে স্কাই ব্রিজ। সে এক আশ্চর্য সেতু! দুই পাহাড়ের মাঝে এক ঝুলন্ত সেতু, যার দৈর্ঘ্য ১২৫ মিটার (৪১০ ফুট), প্রস্থ ১ দশমিক ৮ মিটার (৬ ফুট) আর উচ্চতা ৬৬০ মিটার (২১৭০ ফুট)। নির্মাণ শুরু হয় ২০০৩ সালে, কাজ সমাপ্ত ২০০৪ সালে, উদ্বোধন হয় ২০০৫ সালে।
আমাদের ভাগ্য ভালো, বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও আমরা ঝকঝকে আকাশ পেয়েছি। বাতাসও মৃদু, তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি°সেলসিয়াস। ভারী বৃষ্টি হলে নাকি স্কাই ব্রিজে পর্যটকদের আসতে দেওয়া হয় না। টপ স্টেশন থেকে পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে স্কাই ব্রিজে আসতে হয়। স্কাই গ্লাইড নামে যে এক কেবিনের রেল লিফট আছে, সেটায় চড়তে জনপ্রতি ১০ রিঙ্গিত লাগে। তাই নামার সময় হেঁটেই নামলাম। ফেরার পথে হেঁটে উঠতে কষ্ট হবে, তাই সেটায় চড়ার অভিজ্ঞতাও হলো। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হলো। প্রতিবার ১০ জন করে নেয়, দাঁড়িয়ে যেতে হয়। ভালোই লেগেছে দেড় মিনিটের সেই উত্থান। তবে গালভরা নাম (স্কাই গ্লাইডিং) শুনে শুরুতে ভেবেছিলাম আকাশে উড়িয়ে নেবে, সেই হিসেবে কিছুটা হতাশ হলাম।
এবার স্কাই ক্যাবে করে ফেরার পালা। স্কাই ক্যাব থেকে নামার সময়টাও রোমাঞ্চকর। আর নামার পর ওরা বের হওয়ার পথ করেছে স্যুভেনির শপের ভেতর দিয়ে। ব্যবসা এরা খুব ভালো বোঝে। এমনকি গোড়াতে আমাদের যে ছবি তুলে রেখেছিল (আমি ভেবেছিলাম নিরাপত্তা জন্য তুলেছিল), তা এবার সুন্দর করে এডিট করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে আমাদের উপহার দিতে চাইল। বিনিময়ে ৬০ রিঙ্গিত দিতে হবে। প্রত্যাখ্যান করলে ক্ষতি নেই, ওরা নষ্ট করে ফেলবে। তা–ই করলাম। টাকা আমাকে কষ্ট করে রোজগার করতে হয়, কাজেই দামী ‘উপহার’টা নিলাম না।
এরপর থ্রিডি আর্ট গ্যালারি, স্কাই রেক্স ও স্কাই ডোম পরিদর্শন। গত বছর ঢাকায় সামরিক জাদুঘরের থ্রিডি আর্ট গ্যালারি চমকপ্রদ লেগেছিল। এদেরটায় তার চেয়ে একটু বেশি চমক আছে। আর স্কাই রেক্সে একটা ভার্চ্যুয়াল রাইড। থ্রিডি চশমা পরে একটা ট্রেনের মতো যানে চড়ে বসতে হয়। সেটা আপনাকে নিয়ে যাবে জুরাসিক জগতে। আমাদের অভিজ্ঞতাটা দারুণ হতে পারত। কিন্তু দায়িত্বরত তরুণ আমাদের চশমা দিতে ভুলে গেল। যখন চাইলাম, সে তখন ফিরে যাচ্ছিল রাইড শুরু করে দিয়ে। আমার ডাকে সে ফিরল না। ওই চশমা ছাড়া দৃশ্যগুলো ঘোলাটে দেখায়! মেজাজ আমার খিচড়ে রইল এর পরের এক ঘণ্টা।
স্কাই ডোম মূলত বাচ্চাদের জন্য। আমাদের দেশের নভোথিয়েটারের মতো একটা গম্বুজাকৃতির ছাদে প্রজেক্টর দিয়ে একটা কার্টুন ফিল্ম দেখানো হলো। অ্যাকশনধর্মী সায়েন্স ফিকশান, যা দেশপ্রেমের মন্ত্র শেখায়। ভালোই লেগেছে। তবে আমার ছেলে এখন আর কার্টুন দেখার বয়সে নেই, তাই পয়সা উশুল বলা যাবে না।
এক কথায়, আমাদের লাংকাউই সফরের মূল পর্ব ছিল এটা। ওখান থেকে চলে গেলাম চেনাং বিচ।
চেনাং বিচটাও আমার দারুণ লেগেছে। এর সকালের রূপ যেমন শান্ত ও স্নিগ্ধ, সন্ধ্যার রূপে আছে উৎসবের আমেজ। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে সেদিন আগুন খেলার আয়োজন করা হচ্ছিল। অল্প বয়সী ছেলেরা দারুণ খেলা দেখাল।
প্যারাসেইলিং বা ওয়াটার বাইক চালানো এখানে আরও উপভোগ্য। খাবারদাবারের আয়োজনে পাঁপড় থেকে পিৎজা—সব আছে। ডিউটি ফ্রি পারফিউম, চকলেট আর পোশাকের যেন মেলা বসেছে বিশাল আকারে।
আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড এ সৈকতের অন্যতম আকর্ষণ। আরও অনেক কিছু দেখার ও করার ছিল এ স্বপ্নদ্বীপে। সময় ও টাকা ফুরিয়ে আসছিল বলে সেখানে যেতে পারিনি।
তবে আইল্যান্ড হোপিং নামে ওদের যে বিশেষ ট্যুর প্যাকেজ আছে, সেটা বাদ দিইনি। একটা বড় স্পিডবোটে করে আমরা কয়েকটি পরিবার গিয়েছিলাম। মোটেল থেকে মাইক্রোবাসে প্রথমে জেটিতে, তারপর বোটে ১০ থেকে ১২ জন নিয়ে এক রোমাঞ্চকার অভিযাত্রা। আমাদের সঙ্গে চীনা এক মেয়ে, অস্ট্রেলিয়ান ও আমেরিকান দুই দম্পতি একই বোটে উঠেছিলেন। সবাই খুব ভদ্র ও মার্জিত।
মালাক্কা প্রণালির বড় বড় ঢেউ ভেঙে পাহাড়ি উপত্যকার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় নিজেকে এক দুঃসাহসী নাবিক ভাবতে ভালোই লাগে। ওরা প্রেগন্যান্ট আইল্যান্ড, ব্যাটস কেভ, ইগলস ফিডিং, ক্রোকোডাইলস কেভ দেখিয়ে দায়াং বান্টিং নামের এক মিঠাপানির হ্রদের কাছে নিয়ে গেল। সেখানে আবার কিছু খরচাপাতি করে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। পাহাড়ি পথ বেয়ে তবেই দেখা মেলে পাহাড়ঘেরা এক স্বাদু পানির হ্রদের, যার চারদিক সাগরের লোনাপানি! সেখানে সাঁতার কাটতে হলে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া করতে হয়। এক ঘণ্টা পর বোটে ফিরতে হলো। সব শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো পালাউ বেরাস ব্যাশ পয়েন্টে। সেখানে দারুণ এক পাহাড়ি সৈকত আর জঙ্গল রয়েছে। আশা না মিটতেই ফেরার সময় হয়ে গেল।
মাত্র তিন দিনে লাংকাউইয়ের সব দেখা সম্ভব নয়। তাই লাংকাউইকে বিদায় জানানোর দিন ‘আবার দেখা হবে’ বলে ফিরে এসেছি।
লাংকাউই থেকে পিনাংয়ের ফ্লাইট সন্ধ্যায়। আমরা দুপুরে মোটেল থেকে চেকআউট করে রাস্তার ওপারেই একটা ইন্দোনেশিয়ান রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে নিলোম। এদের সি–ফুড, ফ্রাইড রাইস অসাধারণ! লাংকাউই বিমানবন্দরটা আন্তর্জাতিক হওয়ায় বেশ বড় আর সুন্দর। আমরা মোটেল ছেড়ে দিয়ে বিকেলটা দিব্যি ভেতরে কাটিয়ে দিলাম। অবশ্য এয়ার এশিয়া আমাদের নিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই উড়াল দিল এবং পিনাংয়ে অবতরণ করল খুবই স্বল্প সময়ে। বোয়িংয়ের চেয়ে এয়ারবাস আমাদের বেশি মনে ধরল এর হিমশীতল এসির কারণে। এর কেবিন ক্রুরা খাবার দেয় না তো কী হয়েছে? আচরণ মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস থেকে ভালো।
পরের পর্বে থাকছে পিনাং দ্বীপ থেকে কলকাতা ঘুরে ঢাকায় ফেরার গল্প।