বাংলাদেশ থেকে অনেকে মনে করেন যে ইউরোপে বিয়ে করা অনেক সহজ একটা ব্যাপার!সাইপ্রাসে বাংলাদেশি ছাত্র ও প্রবাসীদের বিয়ে ও বিয়ে করার সূত্রে বৈধতার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে অনেক দালাল হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
ইউরোপ এবং এশিয়ার সমঙ্গস্থলে অবস্থিত ছোট দেশ সাইপ্রাস। পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরে অবস্থিত এ দ্বীপ দেশটি ভৌগোলিকভাবে এশিয়ার অংশ হলেও সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাইপ্রাসকে ইউরোপের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সাইপ্রাস ইউরোপিয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ হলেও ‘শেনজেন কান্ট্রি’ নয়। ইউরোপিয় ইউনিয়নের ২৬টি দেশ এই চুক্তিতে আছে। কিন্তু সাইপ্রাস নেই, দেশটি সম্পূর্ণ নিজস্ব আইনে চলে, অনেকটা ব্রিটিশদের মতো।
ইউরোপে বৈধতা পাওয়ার জন্য সাইপ্রাসে হাজার হাজার প্রবাসী এশিয়ান ও বাংলাদেশি আছেন যারা ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ এর মাধ্যমে কাগজপত্র বানিয়ে নিচ্ছেন।
ইউরোপে সহজ ভাষায় ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ হল টাকার বিনিময়ে বিয়ে। অর্থাৎ মেয়ে থাকবে মেয়ের জায়গায়, ছেলে থাকবে ছেলের জায়গায়। মাঝখানে দালালপক্ষ উকিলের ম্যাধ্যমে টাকার বিনিময়ে কাগজপত্রগুলো বানিয়ে দেয়।
চুক্তিভিত্তিক বিয়ের নামে এখন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিসহ শত শত এশিয়ান প্রবাসী। বিয়ে করার জন্য দালালের সঙ্গে চুক্তি হয় একরকম, কিন্তু শেষের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমে দালালের সঙ্গে বিয়ে করা থেকে শুরু করে কাগজপত্র পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশিরা প্রায় ৮-১০ লাখ টাকার চুক্তি করেন।
বিয়ের পর চুক্তি অনুযায়ী মেয়েকে রোমানিয়া বা বুলগেরিয়া থেকে নিয়ে আসতে হয় ( উল্লেখ চুক্তি ভিত্তিক বিয়া রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া মেয়েদের কম টাকাতে করা যায় ) । মেয়েকে নিয়ে আসার পর থেকে শুরু হয় খরচের অত্যাচার। এবার তার যাবতীয় খরচ বহন করতে হয়। দালালের সঙ্গে চুক্তির বাইরেও তাকে টাকা দিয়ে খুশি রাখতে হয়, যাতে ওই মেয়ে কোন বাটপারি না করে!
কিন্তু তাতেও কি লাভ হয়! মেয়ে আপনার উপর এমন অর্থনৈতিক অত্যাচার চালাবে যেন আপনি একজন জমিদার আর সে আপনার রাজরাণী! যেখানে এক ইউরো লাগে সেখানে আপনাকে দিয়ে সে দশ ইউরো খরচ করাবে। এভাবে যেতে যেতে আপনার যখন প্রায় পাঁচ-ছয় লাখ টাকা খরচ হয়ে যাবে এবার শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল।
সে আপনার চুক্তির বাইরে আরো টাকা চাইবে। আপনি দিতে বাধ্য, কারণ না দিলে সোনার পাখি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে। আর পাখি চলে গেলেই আপনার সবকিছু শেষ। এতদিন যে টাকা খরচ করলেন তার পুরোটাই লোকসান। চুক্তির বউ যদি বেঈমানি করে তাহলে ইউরোপের কাগজ পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। তখন মনে পড়ে যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা, ‘স্ত্রীর সঙ্গে বীরত্ব করে লাভ কি? আঘাত করলেও কষ্ট, আঘাত পেলেও কষ্ট।’
আবার যার ভাগ্য ভালো সে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে না। তবে সবাই যে কাগজ পায় না তাও না। অনেকের সবকিছু সুন্দরমতো হয়ে যায়।
তবে বর্তমানে চুক্তিবদ্ধ বিবাহের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সে দেশের সরকার বর্তমানে দক্ষিণ এশীয়দের বিবাহ স্থগিত করে রেখেছে।
চুক্তিবদ্ধ বিবাহের বেশিরভাগই ছিল নকল যা পরবর্তীতে দেশটির পুলিশি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। সাইপ্রাসের সরকারের দেয়া এক বিবৃতি অনুযায়ী গত দুই বছরে সে দেশের পুলিশ অন্তত ৩,৬০০ টি এ রকম নকল বিবাহের কেস লিপিবদ্ধ করে।
এমনকি গত জুলাই মাসে দেশটির একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লারনাকা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ১১ জন বুলগেরিয়ান ও রোমানিয়ান মহিলাকে আটক করা হয় যাদেরকে এ ধরনের বিবাহের জন্য ভাড়া করা হয়েছিল।
সাইপ্রাসের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী দেশটিতে বর্তমানে এক সুবিশাল দালালচক্রের নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে যারা সেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে রেসিডেন্ট পারমিটের কথা বলে এ রকম চুক্তিবদ্ধ বিবাহের আয়োজন করে থাকে।
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত এবং নেপালের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অধিবাসীরা সেনজনের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে সহজ শর্তে রেসিডেন্ট পারমিট পাওয়ার জন্য এ ধরনের চুক্তিবদ্ধ বিবাহের আশ্রয় নেয়।
বাংলাদেশি অনেকে এ ধরনের বিবাহের জন্য এক বছর আগেই দালাল শ্রেণিকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দিয়ে রেখেছে।
সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে একদিকে তারা যেমন এ বিষয়ে অগ্রসর হতে পারছেন না অন্যদিকে দালালদের থেকেও তারা তাদের প্রাপ্য অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না। পাওনা টাকা দাবি করতে গিয়ে অনেকে ইতোমধ্যে শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। ফলে এক ধরনের হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন।
দালালচক্রের হাত অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে অনেক সময় যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না । বাংলাদেশ থেকে শুরু করে পাকিস্তান, নেপাল, ভারত এমনকি সাইপ্রাসের স্থানীয় অনেকে এ চক্রের সাথে জড়িত ।
তাই প্রবাসী বাংলাদেশি যারা দালালদের প্রলোভনে পড়ে সাইপ্রাস বা ইউরোপের নন-শেনজেন দেশগুলোতে আসার চিন্তা করছেন, এসব মিথ্যা প্রলোভনে ভুলেও কেউ পা দেবেন না।
মাহাফুজুল হক চৌধুরী, সাইপ্রাসের নিকোশিয়া থেকে