এক সপ্তাহ বাড়ির বাইরে ছুটি কাটাবেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রায় ১৫ শতাংশ কর্মজীবীর এমন সক্ষমতা নেই।
তাদের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ। কোটি কোটি শ্রমজীবীর বাড়ির বাইরে গিয়ে ছুটি, বিশ্রাম বা মানসিক শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ বা সামর্থ্য না থাকার বিষয়টিকে ইউরোপের জন্য বড় এক সামাজিক সংকট হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুসারে, সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (ইটিইউসি)। সংগঠনটির মহাসচিব এসথার লিঞ্চ বলেন, ‘পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে এক সপ্তাহের জন্য বিশ্রাম নেয়া স্রেফ বিলাসিতা নয়, এটা আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। এটা ইউরোপের সামাজিক চুক্তিরই অংশ।’
কিন্তু বর্তমানে শ্রমজীবীদের ছুটি কাটানোর সে চিত্র বদলে গেছে বলে জানান এসথার লিঞ্চ।
পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালে ইউরোপে বাড়ির বাইরে ছুটি কাটাতে না পারা কর্মজীবীর সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১৫ লাখ, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ লাখ বেশি। ২০২১ সাল থেকে টানা তৃতীয় বছরের মতো ঘরের বাইরে ছুটি না কাটানোর এ প্রবণতা বেড়েছে।
ইউরোপের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোয় এ ধরনের পরিস্থিতি সবচেয়ে প্রকট। রোমানিয়ায় ৩২ শতাংশ কর্মী ছুটি কাটাতে অক্ষম, হাঙ্গেরিতে ২৬, বুলগেরিয়ায় ২৪, পর্তুগাল ও সাইপ্রাসে ২৩ এবং স্লোভাকিয়ায় ২২ শতাংশ। অন্যদিকে ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসের মতো নর্ডিক দেশগুলো এবং লুক্সেমবার্গ ও স্লোভেনিয়ায় এ হার ৫-৭ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির চার দেশ জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন ও ইতালি। এসব দেশের প্রতিটিতে ৫০ লাখের বেশি কর্মজীবী ছুটি কাটাতে পারছেন না। ২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী, ইতালিতে ৬২ লাখ, জার্মানিতে ৫৮ লাখ, স্পেনে ৫৬ লাখ ও ফ্রান্সে ৫১ লাখ কর্মী ছুটির কাটানোর সামর্থ্য হারিয়েছেন।
রোমানিয়া ও পোল্যান্ডে এ সংখ্যা যথাক্রমে ৩৫ ও ৩৬ লাখ। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল দেশ অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডসে পাঁচ লাখের বেশি কর্মী অর্থাভাবে ছুটি কাটাতে পারেন না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বার্ষিক নিট আয়ের সঙ্গে ছুটি কাটাতে না পারার মধ্যে একটি নেতিবাচক সম্পর্ক আছে। আয় যত বাড়ে, ছুটি কাটাতে না পারার হার তত কমে। তবে কিছু দেশ এ প্রবণতার ব্যতিক্রম।
উদাহরণস্বরূপ, আয়ারল্যান্ডে বার্ষিক নিট আয় ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ হলেও ছুটি কাটাতে না পারা মানুষের হার তুলনামূলক বেশি। বিপরীতে স্লোভেনিয়ায় আয় তুলনামূলকভাবে কম হলেও ছুটি কাটাতে বাইরে যাননি এমন শ্রমজীবী অনেক কম।
এ বৈপরীত্য বোঝায় ছুটি কাটানোর সামর্থ্য শুধু আয়ের ওপর নির্ভর করে না, বরং জীবনযাত্রার খরচ, ভর্তুকি, সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক সুরক্ষানীতির ওপরও অনেকাংশেই নির্ভরশীল। শুধু কর্মজীবী নয়, পুরো জনগোষ্ঠীকে ধরলে চিত্র আরো উদ্বেগজনক।
২০২৩ সালে ইউরোপে সাধারণ জনগণের মধ্যে ২৯ শতাংশ ছুটি কাটাতে পারেননি। রোমানিয়ায় এ হার ছিল ৬০ শতাংশ, আর লুক্সেমবার্গে ১১ শতাংশ। অর্থাৎ কর্মজীবীদের তুলনায় সাধারণ জনগণের মধ্যে ছুটি কাটাতে না পারার হার প্রায় দ্বিগুণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছুটি কাটানো মূলত ‘ডিসপোজেবল ইনকাম’ বা ব্যয়ের পর অবশিষ্ট আয়ের ওপর নির্ভর করে। ভাড়া, খাবার, জ্বালানি, এবং চলাচলের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বহু মানুষ ছুটি তো দূরের কথা, দৈনন্দিন খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
ইটিইউসি ইউরোপিয়ান কমিশনকে আহ্বান জানিয়েছে যেন ন্যূনতম ছুটি বাস্তবায়ন করা হয়। সেই সঙ্গে আসন্ন ‘কোয়ালিটি জব প্যাকেজ’ বা চাকরির নীতিমালায় এমন আইন অন্তর্ভুক্ত করা, যা অর্থনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলে।
সংস্থাটির ভাষ্য, সারা বছর পরিশ্রম করার পর ছুটি কাটাতে পারা ন্যূনতম অধিকার হওয়া উচিত। এটি যেন শুধু বিত্তবানদের জন্য বিলাসিতা হয়ে না দাঁড়ায়।