শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫৪ অপরাহ্ন

আশ্রয়ণ প্রকল্প: বাংলাদেশি গৃহহীনদের জন্য এক মিথ্যে প্রতিশ্রুতির নাম

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৪

প্রকল্প অনুসারে, প্রতিটি পরিবারকে বাড়ির সঙ্গে ২.৫০ শতক জমির মালিকানা দেওয়ার কথাও রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, বাসিন্দাদের তা দেওয়া হয়নি। বরং সেসব বাড়ি থেকে অনেক বাসিন্দাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি এক শনিবারে আমি গিয়ে পৌঁছালাম সুনামগঞ্জের আম্বারি বাজারে। তখন চোখে পড়ে, সুরমা নদীর তীরে ছোট ছোট অনেকগুলো রঙিন বাড়ি। কিছু বাড়ির ছাদের চালের রঙ লাল আবার কিছু বাড়ির ছাদের চালের রঙ ছিল সবুজ। পাখির চোখে দেখলে মনে হবে, বাংলাদেশের পতাকা। কিন্তু এই সুন্দর দৃশ্যের পিছনে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার গল্প।

বাড়িগুলো গৃহহীনদের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা হয়েছে। এ সারিবদ্ধ বাড়িগুলো গুচ্ছগ্রাম নামে পরিচিত। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন গৃহহীন মানুষ রয়েছে, যা বিশ্বের ৮তম বৃহৎ গৃহহীন জনসংখ্যা। এ সংকট মোকাবেলার জন্য এই প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রাঙারচর ইউনিয়নে বর্তমানে এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে মোট ১৯৯টি বাড়ি রয়েছে। তবে আমি জানতে পারি, বেশিরভাগ বাড়িগুলোতেই ঝুলছে তালা। গ্রামের এক বাসিন্দা এ বিষয়ে জানান, অন্তত ৪০টি বাড়িতে কেউ থাকে না।

নাম না প্রকাশের শর্তে এক নারী বলেন, “এসব বাড়িঘরে থাকার সময় মানুষ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। এজন্য অনেকেই বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকছেন। তবে বাড়িগুলো তাদের নামেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।”

আবার এমনও সংবাদ প্রচারিত হয়েছে যে, অনেকে এসব বাড়ি বিক্রি করে ফেলেছেন বা ভাড়া দিয়েছেন।

এ বাড়িগুলোতে মানুষ কেন থাকছেন না? এ বিষয়ে বিশিষ্ট স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “আপনি যেকোনো সরকারি জমিতে বাড়ি তৈরি করে গৃহহীন মানুষদের সেখানে বসবাস করতে দিতে পারেন না। সেখানে জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করতে হবে এবং আপনাকে দেখতে হবে ওই স্থানে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ হচ্ছে কিনা।”

সরেজমিনে বেশিরভাগ বাড়ির আশেপাশে ছোটখাট বাগানের দেখা মিলেছে। উদাহরণস্বরূপ, এক বাড়ির সামনে এত গাছ ছিল যে পুরো বাড়িটিই ঢেকে গেছে। সে বাড়ির ভিতরে আমরা একটি ফ্রিজও দেখতে পেলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে জুবায়ের আহমেদ নামে এক ব্যক্তি থাকেন।

জুবায়ের বলেন, “আমি শহরে থাকি। এই বাড়িটি আমি রেখেছি। কারণ বাড়িটি খোলামেলায় জায়গায় হওয়ায় এটি আমার পছন্দ হয়েছে। তাছাড়া আমি এখানে গাছপালা লাগিয়েছি। প্রায়ই এখান থেকে আম পেয়ারা ও অন্যান্য ফল আমি শহরের বাড়িতে নিয়ে যাই।”

সুনামগঞ্জ শহরের শ্যামলি বাস কাউন্টারের ম্যানেজার পদে কাজ করছেন জুবায়ের। তার আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করলে এ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়িতে তার থাকার কথা নয়। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি হাসলেন এবং বলেন, “এখানে আপনি ১৫ থেকে ২০ টি পরিবার পাবেন যারা সত্যিই গরীব এবং গৃহহীন। বাকিরা হলেন উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বা ইউনিয়ন পরিষদের কোনো সদস্যের কাছের মানুষ।”

প্রকল্প অনুসারে, প্রতিটি পরিবারকে বাড়ির সঙ্গে ২.৫ শতক জমির মালিকানা দেওয়ার কথাও রয়েছে। কিন্তু বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, “বাস্তবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের দয়ায় তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। কোনো বাসিন্দা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করলে তাদের উচ্ছেদের হুমকি দেওয়া হয় এবং ইতোমধ্যে অনেক বাসিন্দাকে সেসব বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, “সুবিধাভোগীদের নির্বাচন করেছেন ইউএনও। আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।” সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অতিশ দারশী চাকমা বলেন, “আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি। আগের ইউএনও এই প্রকল্পে কাজ করেছেন। তাই আমি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে পারি না।”

১৯৯৭ থেকে জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত এই প্রকল্পের আওতায় মোট ৫,৫৫,৬১৭ গৃহহীন-ভিটাহীন পরিবার পুনর্বাসিত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ৪৭,২১০ পরিবার পুনর্বাসিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৫৮,৭০৩ পরিবার পুনর্বাসিত হয়।

২০১০ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫৪,৬৬০ পরিবার পুনর্বাসিত হয়েছে।

এ বিষয়ে ইকবাল হাবিব মন্তব্য করেন, “এই প্রকল্পটি জাতীয় আবাসন কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত ছিল। তারা প্রযুক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রকল্পগুলির মূল্যায়ন এবং নির্মাণ করতে পারতেন। তার বদলে, দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্থানীয় থানা নির্বাহী কর্মকর্তাদের।”

এগুলো কি ধসে পড়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে?

আমি যখন বাড়িগুলোতে পৌঁছালাম তখন আমার মনে প্রথম প্রশ্নটি এসেছিল স্থানের দুর্বলতা নিয়ে।

ইকবাল হাবিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “নদীর ৫০ গজের মধ্যে নির্মাণ কাজ আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু এই বাড়িগুলো নদীর তীর ঘেঁষে জেগে ওঠা বিভিন্ন চরেই তৈরি করা হয়েছে।”

বাস্তবিকভাবে, ২০২০-২০২১ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বগুড়ার সড়িয়াকান্দি উপজেলার পচগাছি চর এলাকায় ৭৯টি বাড়ি যমুনা নদীর তীরে তৈরি করা হয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে, এই বাড়িগুলির অধিকাংশই যমুনার পানিতে ভেসে গেছে।

তাছাড়া আরেকটি প্রধান প্রশ্ন হতে পারে, একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশে এ আবাসন মডেলটি টেকসই কিনা। এ বাড়িগুলোকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে তেমন কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মানুষরা প্রায়ই বন্যার সময় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

আর সব বাড়ির ডিজাইনও এক রকম। প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে দুটি করে শোবার ঘর, একটি রান্নাঘর, একটি বাথরুম ও একটি বারান্দা। প্রতিটির আয়তন ২৬৪ বর্গফুট।

ইকবাল হাবিবের মতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে একই ডিজাইনের বাড়ি তৈরি করা কোনো টেকসই পদ্ধতি হতে পারে না। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি এবং পরিবেশ ভিন্ন। এখানে পাঁচ ধরনের মাটি রয়েছে। এই বৈচিত্র্য বিবেচনা করে বাড়ির ডিজাইন, কাঠামো এবং নির্মাণ পদ্ধতি প্রতিটি এলাকার উপযোগী করেই তৈরি করা উচিত ছিল।”

তাছাড়া প্রায় সব প্রকল্পেই বাজেটে ঘাটতি ছিল। প্রতিটি বাড়ির জন্য বাজেট ছিল এক লাখ ৯০ হাজার টাকা। এই সীমিত বাজেটের কারণে বাড়িগুলোর নির্মাণ পদ্ধতি ও স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। বাড়িগুলো কোনো ফাউন্ডেশন ছাড়াই ইটের গাথনি করে তৈরি করা হয়েছিল।

ইকবাল বলেন, “আমি বরিশালে প্রকল্প অঞ্চল পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম। তবে এসব বাড়ির ডিজাইন এবং উপকরণ ক্রয় বাস্তবিক অর্থে সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে করা সম্ভব না।”

বাড়িগুলো কি শুধু দেখানোর জন্যই ছিল?

শেখ হাসিনা তার শাসনামলে দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর প্রচারে অনেক বেশি মনোযোগী ছিলেন। আর এ আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্লোগান ছিল ‘আশ্রয়ণের অধিকার শেখ হাসিনার উপহার’।

প্রকল্পটি গৃহহীনদের জন্য করা হলেও, তারা এর তেমন কোনো সুফল পায়নি। কিন্তু তারপরও হাসিনা সরকার হাস্যকরভাবে এ আশ্রয়ণ প্রকল্পকে দেশের ‘উন্নয়ন’ হিসেবে দেখিয়ে গেছে। ২০১৭ সালের শেষদিকে, আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩ এর ঘোষণা দেওয়া হয়। এ প্রকল্প ছিল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসান চরে এ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়।

এ বিষয়ে কূটনীতিক ও নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার সমালোচনার পরও সরকারি তহবিল ব্যবহার করে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্ববধানে ভাসান চরে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।

ওই দ্বীপে ১২০টি গুচ্ছগ্রামে একহাজার ৫০০ বাড়ির মধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থান দেওয়ার মতো অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল মন্তব্য করেন, “এ পুরো প্রকল্পটির মাধ্যমে জনগণের অর্থ সম্পূর্ণভাবে অপচয় করা হয়েছে। আর এসব করা হয়েছে শুধু দেখানোর জন্য।”

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com