একটি ফোনকল, এক মিনিটের সিদ্ধান্ত এবং এক মাসের যাত্রা একদিন দুপুরে হঠাৎই ফোন আসে প্রফেসর ইউনুসের কাছ থেকে।
তিনি সরাসরি বললেন, “আশিক, দেশের মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ এসেছে। তুমি আসবে তো?” একটা মুহূর্তও দেরি করিনি। নন্দিনীকে জিজ্ঞেস করিনি, কারণ জানতাম—আমার সিদ্ধান্তে ও কখনও বাধা হবে না। সে একটা ৫৯ সেকেন্ডের হোয়াটসঅ্যাপ কলে আমি সিঙ্গাপুরের বিলাসবহুল, নিরাপদ, গোছানো জীবন পেছনে ফেলে দিলাম।
চলে এলাম বাংলাদেশে। দায়িত্ব নিলাম বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের—সংক্ষেপে BIDA—যেখানে কাজ আমার দেশের জন্য, দেশের মানুষদের জন্য।
বন্ধুরা মজা করে বলে, “তুই তো এখন দেশের চিফ মার্কেটিং অফিসার!”
তবে এই দায়িত্ব শুধু সম্মানের নয়—একটা বিশাল চাপ, বিশাল প্রত্যাশা, আর তার চেয়েও বড় দায়।
এই এক মাসে কোনও সপ্তাহে ছুটি কাটাইনি। শুক্র-শনিবার মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৬-১৮ ঘণ্টা কাজ করছি। প্রায় আড়াইশো সিইও, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। চেষ্টা করছি বুঝতে—তাদের কোথায় বাধা লাগে, কেন নতুন বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, আর আমরা প্রশাসনিকভাবে কীভাবে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে পারি।
আমার কাজ হলো নতুন বিনিয়োগ আনা, দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা, এক কথায়—বাংলাদেশকে তুলে ধরা বিশ্বের বাণিজ্য মানচিত্রে। আমরা একটা জনগণের সরকার। আমাদের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি—এবং সেটা হওয়াই স্বাভাবিক।
জাতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে এই জায়গাটা মিলে যায়—সবার চাওয়া আমরা জিতি, সবসময় ভালো পারফর্ম করি। কিন্তু পরের বলটা একটু খারাপ হলেই চারদিক থেকে হু-হু করে ওঠে সমালোচনার ঝড়—কে দলে থাকবে, কে বাদ যাবে, ফিল্ডিং কেন এমন হল—সব কিছু নিয়েই কথা। তেমনি, আমরাও প্রতিনিয়ত যাচাইয়ের মধ্যে আছি। কাজের ফলাফলে একটু খামতি হলে তার বিশ্লেষণ শুরু হয়, সমালোচনাও আসে।
তবুও এটা মেনে নেওয়া শিখেছি—কারণ দেশটা আমাদের। মানুষ বলবেই। তাদের বলার অধিকার আছে, কারণ আমরাই তাদের প্রতিনিধিত্ব করছি। দিন শেষে যখন বাড়ি ফিরি, ফোনটাও তখনো বাজতে থাকে মেইল,টেক্সট, হোয়াটসঅ্যাপে জমে থাকা মেসেজের ভিড়ে চোখ রাখি। তারপর হালকা ক্লান্ত মনে ফেসবুক খুলে দেখি—সমালোচনার নতুন ঢেউ। এমনকি কখনও কখনও মনে হয়, আমার নিজের স্ত্রীও বুঝি বিরোধী দলে!
তখন নিজেকে বোঝাই—এইটাই তো বাস্তবতা। গণতন্ত্র মানেই ভিন্নমত, মানেই প্রশ্ন তোলা। তাই আমরা ভুল করব, আবার শিখব, আবার শুধরাবো। ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে—দেশটা এগোবে আমরাও এগোবো। এই এক মাসে বুঝেছি—দেশে কাজ করা মানে শুধু চেয়ারে বসে থাকা নয়, না ঘুমিয়ে, না খেয়ে একের পর এক মিটিং করা। নতুন আইডিয়া খুঁজে বের করা, নীতিমালায় পরিবর্তন আনা, আমলাতান্ত্রিক জট ছাড়িয়ে উদ্যোক্তাদের জন্য পথ সুগম করা। সবার চোখে এটা “চাকরি” হলেও, আমার কাছে এটা একধরনের “মিশন”।
আশিক চৌধুরী,
চেয়ারম্যান,
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
Like this:
Like Loading...