বর্তমান যুগে চাকরিহীনতা অনিশ্চয়তার অপর নাম। তাই বর্তমান চাকরি ছাড়ার আগে বেশিরভাগ মানুষ অন্য কর্মস্থল বা পেশা ঠিক করে রাখেন। এর আরেকটি কারণ অবশ্য- নিয়োগদাতারা বর্তমানে কর্মরত এমন কর্মী নিয়োগ দিতেই পছন্দ করেন। তাছাড়া, চাকরিহীন প্রার্থীর আবেদনকে সেভাবে মূল্যায়নও করা হয় না। বেকারদের ব্যর্থ আর অযোগ্য বলে ভাবেন চাকরিদাতারা। তবে সবকিছুর পরও এমন একটা সময় আসে যখন চাকরি ছাড়াই শ্রেয়। আর তা না করলে নিজের ভবিষ্যতের ক্ষতিই করবেন শুধু।
পারিবারিক একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন আমেরিকার বোস্টন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ক্যারিয়ার স্ট্র্যাটেজিস ইনকর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট প্রিসিলা ক্লামান। তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে দেখান কীভাবে তার বাবাকে খুশি করতে গিয়ে একবার তার বাগদত্তা মরতে বসেছিলেন। প্রিসিলা যদি তাকে না থামাতেন তাহলে সেদিন তার বাগদত্তার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। ফলে বিয়ের ফুল অঙ্কুরেই বিনাশ হতো। আর আজকের সুখের সংসারের মুখও দেখতে হতো না।
প্রিসিলা বলছেন, একই ঘটনা চাকরির ক্ষেত্রেও হতে পারে। কখনো-সখনো আপনি যদি হাল না ছাড়েন- তাতে খুব সহজে নিজেই নিজের ক্যারিয়ার ধবংস করে ফেলতে পারেন। দুটি এমন পরিস্থিতির উল্লেখ করেন তিনি, যখন আপনি অন্য চাকরি ঠিক না করেই বর্তমান কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারেন-
তবে চাকরি ছাড়ার আগে- কখন ও কীভাবে ছাড়বেন আপনাকে অবশ্যই তার একটি পরিকল্পনা রাখতে হবে। তাতে আরও থাকবে কাদের আপনি পরবর্তী চাকরিতে সুপারিশদাতা বা রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করবেন- সেটি নির্ধারণ। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- কী বলে পদত্যাগপত্র দেবেন- তাও সাজিয়ে ফেলা।
যেমন- বেথ নামের এক কর্মীর উদাহরণ দিয়েছেন প্রিসিলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহপাঠীর সাথে তিনি একটি স্টার্টআপ কোম্পানি শুরু করেন। কিন্তু, কিছুদিন পরই লক্ষ করলেন গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করছে তার অংশীদাররা। নীতিবিরুদ্ধ এ কাজে মনঃক্ষুণ্ণ হন বেথ, তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে চলতে থাকলে কোম্পানিতে তার বিনিয়োগ অনিরাপদ তো হবেই, তার ওপর চাকরি নিয়েও টানাটানি দেখা দেবে যেকোনো দিন। সবচেয়ে বড় কথা তার সুনামহানি হবে। সকলে বেথকে প্রতারক হিসেবে চিনবে।
এসব চিন্তা মাথায় রেখে পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করলেন বেথ। প্রথমে একজন আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে কোম্পানির প্রতি তার দায়বদ্ধতা সম্পর্কে বুঝে নিলেন। এরপর পদত্যাগের দিন ঠিক করলেন। পদত্যাগপত্রে সতর্কভাবে লিখলেন অব্যাহতি চাওয়ার কারণ। তিনি লিখেছিলেন, “তোমাদের দুজনের অধীনে এই স্টার্টআপ কোম্পানিতে চাকরি ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা। হয়তো পৃথিবীর কোনোকিছুর বিনিময়ে আমি এ চাকরি ছাড়তাম না। তবে নিজেকে আমি এখন আরও ভালোভাবে জানতে পেরেছি। তাই আমি এ প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও পরিচালনায় ঘাটতি নিয়ে অস্বস্তি বোধ করছি…”
পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে নিজের রেফারেন্স ঠিক করতে মনোযোগী হন বেথ। পেলেন তিনজনকে- একজন তার সাবেক চাকরিদাতা, একজন বর্তমান গ্রাহক ও অপরজন বর্তমান এক সহকর্মী। প্রত্যেকেই বেথ যৌক্তিক কারণেই চাকরি ছেড়েছেন- কেউ জানতে চাইলে এমন সাক্ষ্যদানে সম্মতি দিলেন। তবে নিজের অংশীদারদের অসততা নিয়ে বেথের মনে যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে তা তিনি এসব ব্যক্তিকে জানাননি। এভাবে সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেই চাকরি ছাড়েন বেথ এবং তার চার মাসের মধ্যেই আরেকটি ভালো চাকরি পেয়ে যান।
পল ছদ্মনামে আরেক কর্মীর সমস্যা ছিল অন্যরকম। তিনি একটি কোম্পানির পরিশ্রমী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। কিছুদিন পর ঐ কোম্পানিটি অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে একীভূত হয়। এরপর একে একে চাকরি হারাতে থাকেন পলের পুরনো সহকর্মীরা। নতুন ব্যবস্থাপকদের সাথে মানিয়ে চলতে পলেরও ভীষণ অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু, পরিবারের কথা ভেবে তিন সন্তানের এই বাবা যেভাবেই হোক চাকরি টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন।
কিন্তু, এই চাকরি পলের ওপর প্রচণ্ড চাপ ফেলে। তার স্বাস্থ্য-রুটিন নষ্ট হয় যায়। ওজন বেড়ে যায় ৩০ পাউন্ডের মতো। প্রতিদিন সকালে কাজে যাওয়ার আগে অসুস্থ বোধ করতে থাকেন তিনি। পলকে এই অবস্থায় দেখে তার পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা শঙ্কিত হয়ে ওঠে।
বর্তমান চাকরিতে পলের প্রতিটি পদক্ষেপের আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল, এর ফাঁকে অবিরাম নতুন চাকরি খুঁজতে খুঁজতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। ফলে কোনো চাকরির ইন্টারভিউতে টিকতে পারছিলেন না। পল বুঝতে পারেন- অন্য চাকরি পান আর নাই পান- তাকে বর্তমান কর্মস্থল ত্যাগ করতেই হবে।
পল এবার চাকরি ছাড়ার পরিকল্পনা সাজালেন। প্রথমে রেফারেন্স যোগাড় করলেন। বেশিরভাগ সুপারিশদাতা বেছে নিলেন কোম্পানি একীভূত হওয়ার আগের ব্যবস্থাপকদের মধ্যে থেকে। এরপর নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে পদত্যাগপত্র জমা দিলেন। তবে সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি সম্পর্কে কোনো অভিযোগ উল্লেখ করেননি। উল্টো কোম্পানি একীভূত হওয়ার পরও তাকে চাকরিতে রাখার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। চাকরি ছাড়ার কারণ হিসেবে তিনি এখন অন্যখাতে যেতে আগ্রহী বলেও উল্লেখ করেছিলেন।
প্রিসিলা ক্লামান বলেন, স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়ে অভিযোগ না করে পল খুবই বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন। তিনি একথা উল্লেখ করলে তার মানে দাঁড়াতো- ‘আপনারা আমাকে অসুস্থ করে ফেলেছেন।’ চাকরি ছাড়ার সময় বসদের নাখোশ করতে চাননি তিনি। তার জানা ছিল, নতুন চাকরিদাতারা পুরনো কোম্পানির কর্মকর্তাদের কাছে অবশ্যই তার বিষয়ে জানতে চাইতে পারেন।
তবে শেষপর্যন্ত পলের পরিকল্পনা সফল হয় এবং তিনি কোম্পানি একভূত হওয়ার আগের ব্যবস্থাপকদের সুপারিশে একটি ভালো চাকরিও জুটিয়ে ফেলেন।
পল ও বেথের সফল এই চাকরি বদল থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছেন প্রিসিলা-