বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫৪ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

আমার স্বপ্ন ছিল, আশা ছিল

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩

মানবপাচারের অভিযোগে দণ্ডিত হয়ে গ্রিক দ্বীপ চিওসের কারাগারে আছেন বেশ কিছু অভিবাসী। তাদের বেশিরভাগই সিরীয় নাগরিক। অভিবাসীদের অভিযোগ সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তাদের সাজা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এসব ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস।

গ্রিক দ্বীপ চিওস থেকে ইনফোমাইগ্রেন্টসের বিশেষ প্রতিনিধি শার্লত ওবেরতি।

গ্রিক বিচার বিভাগ দেশটিতে প্রবেশ করা বহু অভিবাসীকে পাচারকারী হিসাবে দোষী সাব্যস্ত করেছে৷ তাদের অনেকে চিওসের জেলে অবস্থান করছেন। কারো কারো ২০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।

জাল্লউল, আলসাহলি এবং বায়াসি এই তিন অভিবাসীর সবাই সিরিয়ার উপকূলীয় শহর বানিয়াসের বাসিন্দা। সমুদ্র তীরবর্তী শহর থেকে আসা এই ব্যক্তিরা খুব ভাল সাঁতার জানেন।

২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর নৌকাযোগে সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে অন্যদের সঙ্গে গ্রিসে আসছিলেন এই তিন অভিবাসী। কিন্তু পথিমধ্যে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে সাইক্লেডসের দ্বীপপুঞ্জের পারোসের কাছে নৌকাটি উল্টে যায়। নৌকাডুবির পাঁচ ঘন্টা পানিতে ভেসে এই তিন সিরীয় উপকূলে আসতে সক্ষম হলেও ১৮ জনের মৃত্যু হয়।

২০২২ সালের মে মাসে গ্রিক আদালত এই তিন ব্যক্তিকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিবাসী নৌকার চালকের ভূমিকায় থাকার অপরাধে মানবপাচারের অভিযোগ আনা হয়।

আলসাহলি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, আমরা তুরস্ক থেকে আসার সময় পাচারকারীদের চাপে দুই ঘন্টা করে নৌকা চালাতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কেউই নৌকার অধিনায়ক বা পাচার চক্রের লোক ছিলাম না।

বর্তমানে কারাগারে থাকা এই তিন ব্যক্তির সাথে কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ১৩ জানুয়ারি কথা বলার সুযোগ পায় ইনফোমাইগ্রেন্টস। এই প্রথমবারের মতো আদালতের বাইরে কোথাও তারা নিজেদের মামলার ব্যাপারে কথা বলেছেন। যদিও চলতি বছরের জুনে এই মামলার আপিল আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘আগে থেকেই নিজেদের মধ্যে পরিচয় ছিল না মূলত তুরস্কে এসে একে অপরের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন।’’

১৮৭ বছরের জেল

৩৩ বছর বয়সি জাল্লউল ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, গ্রিক আইনি ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না এবং বোঝেন না। বিচারের সময় আদালত তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিলেও পরবর্তীতে তিনি গণমাধ্যমে দেখতে পান তাকে ১৮৭ বছর এবং অপর দুই সিরীয়কে ১২৬ বছরের সাজা প্রদান করা হয়েছে।

এটি দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

মূলত এটি গ্রিক আইনের একটি বিশেষত্ব। এই ধরনের ঘটনায় গ্রিক বিচার বিভাগ নৌকায় উপস্থিত যাত্রীদের সংখ্যাকে কারাদণ্ড দিয়ে গুণ করে মূল সাজা প্রদান করেন।

অর্থাৎ প্রতি অভিবাসীকে পাচারের দায়ে সাজা প্রদান করা হয়। যার ফলে একেকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অত্যন্ত দীর্ঘ একটি রায় প্রদান করা হয়।

এই ধরনের ‘অযৌক্তিক রায়’ প্রদান করা হলেও প্রকৃতপক্ষে গ্রিসে একজন ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ২০ বছর জেলে রাখার মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে।

গ্রিসে অভিবাসী নৌকার চালকদের সরাসরি মানবপাচারকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি নিয়ে পুরো ইউরোপ জুড়ে অধিকার সংস্থা, এনজিও ও অভিবাসন সংগঠনগুলো সরব।

এই বন্দিদের আইনজীবী আলেকজান্দ্রোস জর্গোলিস বলেন, প্রথম থেকেই একজন ব্যক্তির পাচারের উদ্দেশ্য ছিল কী না বা সরাসরি এই কার্যকলাপ থেকে লাভবান হয়েছেন কিনা সেটি গ্রিক বিচার বিভাগের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। এটি একটি অযৌক্তিক আইন এবং অবশ্যই পরিবর্তন করা উচিত। এটি কিছু মানুষকে সমুদ্র পারাপারের চেষ্টা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে৷ এর বেশি কিছু নয়।

“আমি একজন বন্দি তবে, এটি শীঘ্রই শেষ হবে”

জাল্লউল আশ্বস্ত করেন, নৌকা চালানোর সময় তিনি যে মানবপাচারের আইনি ঝুঁকি নিচ্ছিলেন সে সম্পর্কে তিনি অজ্ঞাত ছিলেন। সিরিয়ার যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর নয় বছর ধরে তুরস্কে তিনি তার জীবন পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছিলেন।

সেখানে তিনি তার স্ত্রী এবং চার সন্তানকে রেখে এসেছেন। তিনি ভেবেছিলেন তিনি নেদারল্যান্ডসে পৌঁছাবেন। কারণ তিনি শুনেছিলেন নেদারল্যান্ডস শিশুদের জন্য একটি ভালো দেশ। একবার পৌঁছাতে পারলে তিনি পরিবারকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিলেন।

কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস এখন তিনি জানেন না যে তিনি তাদের সাথে আবার কবে দেখা করতে পারবেন। কীভাবে তারা তুরস্কে বেঁচে থাকবেন এবং জীবিকা নির্বাহ করবে।

কারাগার থেকে একটি প্রিপেইড সীম কার্ডের সাহায্যে জাল্লউল তার ৩ থেকে ৯ বছর বয়সি শিশুদের সাথে নিয়মিত কথা বলেন৷ তিনি বলেন, “যতবারই ফোনে তাদের সাথে কথা হয়, তারা বলে যে তারা আমাকে দেখতে চায়।”

সিরিয়ায় থাকা আমার বাবা-মাকে আমি জানাই, আমি গ্রিসে একজন বন্দি কিন্তু চিন্তা করবেন না, এটা শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। আমি আর কি বলব? তারা ক্লান্ত।

শুধুমাত্র তার স্ত্রীই সবকিছু জানেন। রায়ের পর আমার স্ত্রী আমাকে জানান, “আপনি তো প্রায় মারা যেতেন সাগরে৷ এ অবস্থায় যাত্রীদের মৃত্যুর জন্য আপনাকে কীভাবে দায়ী করা যেতে পারে?” তার স্ত্রীর স্মরণ করে জাল্লউল বলেন, “আমি ইতিমধ্যে মৃত।”

পালতোলা নৌকায় এসেও জেলে ওয়াসিম

এই তিন অভিবাসীর চেয়ে আবার সিরীয় ওয়াসিমের ঘটনা ভিন্ন। তিনিও বর্তমানে এই কারাগারে আছেন। সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে এসেছেন এই ৩০ বছর বয়সি অভিবাসী।

তিনি ২০২২ সালের ১৮ জুন তুরস্ক থেকে ইটালির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া একটি বড় পালতোলা নৌকায় যাত্রা করেছিলেন। গ্রিসের অভিবাসীদের প্রতি কঠোর হওয়ার সংবাদ শুনে তিনি এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিলেন।

কিন্তু সেদিন আবহাওয়া খারাপ ছিল এবং যাত্রীরা তুর্কি পাচারকারীদের কাছে অনুরোধ করে অবশেষে গ্রিসের উপকূলে কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছিল।

পরবর্তীতে তিনি গ্রিক উপকূলের কাছে একটি জেট-স্কিতে ঝাঁপ দেন। কিন্তু সাগরের তীব্র ঢেউ এবং যাত্রীদের আতঙ্কে এক পর্যায়ে নৌকাটি ছেড়ে দেন। সে সময় ওয়াসিম আবারও নৌকার পাল ছিঁড়ে ফেলার উদ্যোগ নেন। কিন্তু বাতাস নৌকাটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে। তিনি তার নিজের ফোন থেকে গ্রিসের জরুরি পরিষেবাগুলিকে উদ্ধারের জন্য ফোন করেছিলেন।

অবশেষে একটি নৌকা তাদের কাছে এসে উদ্ধারের জন্য একটি দড়ি ছুঁড়ে দিলে ওয়াসিম সেটিকে ধরে পালতোলা নৌকায় বেঁধে দেয়। কিন্তু নৌকার পাল ছিঁড়ে ফেলা, টেলিফোনের মতো বিষয় তাকে নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করে৷

“যখন আমাকে বলা হয়েছিল যে আমি আদালতে হাজির হতে যাচ্ছি, আমি ভেবেছিলাম যাইহোক, আমি কোন অন্যায় করিনি,’’ স্মরণ করেন ওয়াসিম।

ওয়াসিমের ক্ষেত্রে আদালত অবশ্য জরুরী কাজগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে যা কিছু যাত্রীকে নৌকাডুবি এড়াতে সহায়তা করেছিল।

কিন্তু বিচারকরা বিবেচনা করেছেন যে ওয়াসিম গ্রিসে আসার জন্য তুরস্কে পাচারকারীদের সঙ্গে ‘একটি চুক্তি করেছিলেন’। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

রায়ের কথা স্মরণ করে তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “আমার স্বপ্ন ছিল, আশা ছিল এবং এ কারণে আমাকে এই রাস্তা বেছে নিতে হয়েছিল। এখানে ভালো অথবা খারাপ দিক কোনটি?’’

ইনফো মাইগ্রেন্টস

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com