শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০২ অপরাহ্ন

আমার বারমুডা ডায়েরি

  • আপডেট সময় রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৩
বারমুডা নামটা প্রথম যখন শুনি তখন স্কুলে পড়ি। সম্ভবত ক্লাস সিক্স বা সেভেনে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে আর সবার মতো আমিও বারমুডা বলে যে কোনো দেশ আছে জানতে পারি ওই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বইটি পড়ে। তবে ওই বইতে বারমুডাকে যে ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তা পড়ে দেশটা কে ভালো তো লাগেইনি বরঞ্চ এই দেশটি সমন্ধে মনে এক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল। আমার মনে হয় আমরা মানে ভারতীয়রা বারমুডা দেশটি সমন্ধে বেশি জানতে পারি যখন এরা ক্রিকেট বিশ্বকাপে প্রথম সুযোগ পায়।
কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি এই দেশেই হয়ে উঠবে আমার ভবিষ্যতের স্থায়ী ঠিকানা।
২০০২ সালে আমার প্রথম বারমুডায় আসা। এই নয় যে ওটাই আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। এর আগে কার্নিভাল CRUISE এ কাজ করতাম, তাই দেশ দেখেছি অনেক। কিন্তু বারমুডা সব দিকথেকেই ব্যতিক্রম। শেফের চাকরি নিয়ে আমার বারমুডা আসা। কলকাতা থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েসের প্লেনে লন্ডন প্রায় ১১ ঘন্টার সফর। তারপর প্লেন বদল করে বারমুডা, আরো ৭ ঘন্টা। প্লেন যখন নামল তখন সন্ধ্যে সাড়ে ছটা। বাইরে বেরিয়ে দেখি সূর্যের আলো তখন বেশ প্রখর, তাপমাত্রা মনে নেই , তবে একটু গরমই লাগছিল। পরে জানতে পারলাম যে গরম কালে এখানে সূর্যাস্ত হয় রাত ৮ টার পর। এয়ারপোর্টের বাইরে বেরোতেই নজর কেড়ে নিল বারমুডার অপরূপ সৌন্দর্য । প্রথম দর্শনেই প্রেম।
বারমুডা নামটা শুনলে প্রথমেই ছোটবেলায় পড়া “বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল” বইটির কথাট মনে আসে। একটা রহস্যে ঘেরা দেশ , পড়ার পর দেশটি সম্পর্কে এমনিতেই একটা আতঙ্ক জাগে। এই অঞ্চলে নাকি জাহাজ, উড়োজাহাজ সব রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়। আমার মতো আপনারা অনেকেই ছোট বেলায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বইটি পড়েছেন নিশ্চয়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নামটি এবং পূর্ববর্ণিত রহস্যের পুরোটাই কাল্পনিক। আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমাংশে ত্রিভুজাকৃতি একটি বিশেষ সামুদ্রিক অঞ্চলকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বলে বর্ণিত করা হয়েছে , যার একপ্রান্তে বারমুডা এবং অন্য দুই প্রান্তে ফ্লোরিডা এবং পুয়ের্তোরিকো।
কাল্পনিক এই ট্রায়াঙ্গালটির কথা প্রথম নজরে আসে ১৯৫০ এর দশকে এডওয়ার্ড ভ্যান উইঙ্কল জোন্স নামে একজন সাংবাদিকের কিছু লেখায়। যিনি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের জন্য একটি গল্প লিখেছিলেন, এই অঞ্চলে রহস্যময় ভাবে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বিপুল সংখ্যক জাহাজ এবং বিমান নিয়ে।
১৯৭০ এর দশকে, চার্লস বার্লিটজের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল প্রকাশিত হওয়ার পরে এই ধারণাটি সত্যিই কার্যকর হয়েছিল যে কিছু একটা রহস্য আছে এখানে। বইটি প্রায় ২০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল এবং ৩০ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল সত্যিই কি কোনো রহস্য আছে এখানে? তো রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে দেখা গেল যে, জাহাজ এবং বিমানগুলি নিখোঁজ হওয়ার সত্যতাটা কেউ যাচাই করেননি। কয়েক বছর পরে investigative journalist ল্যারি কুশে আবিষ্কার করেছিলেন যে সমাধানের জন্য কোনও রহস্য নেই এখানে , আগের সব লেখাই কল্পিত। কিছু ক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া বলে দাবি করা জাহাজ এবং বিমানগুলির কোনও রেকর্ডই নেই। লেখকের কল্পনার বাইরে এগুলি কখন ছিলও না। অন্য ক্ষেত্রে যে জাহাজ এবং বিমানগুলি সত্যিই হারিয়ে গেছিলো, তা কিন্তু হারিকেনের (ঘূর্ণি ঝড় ) জন্য, অন্য কোনো রহস্য নেই এর মধ্যে।
এই নিয়ে আরো লেখা হয়েছে, সিনেমা হয়েছে, তথ্যচিত্র হয়েছে। যে যার নিজের কল্পনাকে বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছে। আসল কথা হলো পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য গণমাধ্যম স্বভাবতই এই সব রহস্যোপন্যাস তত্ত্বে একটু বেশিই আগ্রহী হয় আর তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আমাদের পরিবেশনা করে । কিন্তু বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যের পেছনে কোন সত্যতা নেই আর কোন0 রহস্যও কিছু নেই।
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর ঘোষের কিছু লেখা আছে এর উপরে, যা থেকে বোঝা যায় যে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বলে আদতেও কিছু নেই।
সে ট্রায়াঙ্গল এর যাই হোক না কেন , বারমুডা কিন্তু আছে আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে তার অপরূপ প্রাকৃতিক রূপ নিয়ে।
১৫০৫ সালে স্পেনীয় নাবিক জুয়ান ডি বারমুডেজ প্রথম এই ছোট্ট দ্বীপটি আবিষ্কার করেছিলেন এবং তাঁর নামেই এই দ্বীপের নামকরণ। তিনি কিন্তু দ্বীপটাকে দূর থেকে দেখে নামকরণ করেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন, এখানে কোনো স্প্যানিশ উপনিবেশগড়ে তোলেননি।
পরে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রিটিশ নাবিক স্যার জর্জ সমার্স বিশাল এক নৌবহর নিয়ে আমেরিকার ভার্জিনিয়া যাওয়ার পথে বারমুডার খুব কাছে এক ভয়ঙ্কর ঝড়ের মধ্যে পড়েন। ঝড়ের তীব্রতায় জাহাজটি ভেঙে তলিয়ে যায়। ওই জাহাজের অভিযাত্রীরা কোনো ক্রমে ভেঙে যাওয়া জাহাজ থেকে বারমুডার এসে আশ্রয় নেন। তারপর ধীরে ধীরে ব্রিটিশরা এখানে উপনিবেশ গড়ে তোলে।
বর্তমানে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বারমুডা কে paradise বা স্বৰ্গ বলে বর্ণিত করা হয়। সত্যিই স্বর্গ , আমি বলি সব পেয়েছির দেশ। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ । বছরে মাথাপিছু মোট জাতীয় উৎপাদন ( GDP ) আমেরিকান ডলারে ১০২১৯২ (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা ) ন্যূনতম বেতন ভারতীয় মুদ্রায় ১১২৫ টাকা প্রতি ঘন্টা। বারমুডার অর্থনীতি বিষয়টি বেশ আকর্ষণীয় । পুরো অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে বীমা কোম্পানি আর পর্যটন শিল্পের উপর। বারমুডাকে অনেক দেশই অফশোর ট্যাক্স হেভেন বলে চিহ্নিত করে। বিশ্বের প্রথম সারির বীমা এবং পুনর্বীমাকরণ কোম্পানি গুলির সদরদপ্তর বারমুডাতে। শতাধিক বিমান এবং জাহাজ কোম্পানিও বারমুডাতে নথিবদ্ধ।
বারমুডার অর্থনীতি নিয়ে লেখার কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই। আমি সেই অর্থে কোনো লেখক নই। আজ প্রায় বিশ বছরের বেশি বাস এই দেশে। স্থানীয় মেয়ে ট্রেসিকে বিয়ে করে একমাত্র কন্যাকে নিয়ে এখানেই স্থিতু। এই দেশটা সত্যি অবাক করে আমাকে। এই দেশ এবং এখানকার মানুষরা সত্যিই অন্যরকম। সারা পৃথিবীতে এতো সমস্যা, কিন্তু এদেরকে সেসব নিয়ে কখনো ভাবতে বা আলোচনা করতে দেখিনি, অদ্ভুত রকমের উদাসীন এক জাতি। এরা মাইকেল জ্যাকসনকে দেখে ছুটে যায় না। বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটনরা এসে এখানে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় সাধারণ মানুষের মতন। মাইকেল ডগলাস , ক্যাটরিনা জিতা জোন্সরা আমাদের সাথেই বাজার করে ।
আমার রেস্টুরেন্টে যে ধোয়ামোছার কাজ করে সে আবার এখানকার FM রেডিও জকি।
আমি সেই অর্থে কোনো লেখক নই। নিজের খেয়ালে লিখি , লেখার আনন্দে লিখি। জীবনে কাঙ্খিত সব পেয়েও থেকে যায় অনেক শুন্যতা। আমি লিখি সেই শুন্যতা থেকে মুক্তি পেতে। আমার জন্ম , পড়াশোনা , বেড়ে উঠা সবই কৃষ্ণনগরে। কিন্ডার গার্ডেন স্কুল , ডনবস্কো স্কুল , কৃষ্ণনগর কমার্স কলেজ তারপর জীবন নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে বোম্বে , দুবাই , আমেরিকা হয়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে আটকে গেলাম। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। আমার জীবনটা অনেকটা পাল তোলা নৌকোর মতো , আর সেই পালে হাওয়া লেগেই আছে। হোটেলের শেফ থেকে পুলিশ অফিসার , চাকরির সাথে সাথেই নিজের রেস্টুরেন্ট। তার মাঝে এই ট্রায়াঙ্গালেই পেলাম নিজের জীবন সঙ্গিনী ট্রেসি কে। মেয়ের বাবা হলাম , সেও বেশ বড় হয়ে গেল। সুপ্ত ইচ্ছে থেকে তৈরি হওয়া ছোট ছোট স্বপ্ন গুলি পূর্ণতা পেতে লাগল। ছুটি পেলেই কৃষ্ণনগরে চলে যাই। ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে স্মৃতির আকাশে ডানা মেলে উড়তে উড়তে এতো দ্রুত ছুটি কেটে যায় যে মনে হয় যেন শুরু আগেই শেষ হয়ে গেল। এই লেখালিখির মাধ্যমে আমার পালে নতুন হাওয়া লেগেছে , দেখি কোথায় গিয়ে থামে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com