বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪২ অপরাহ্ন

আমাদের সুচিত্রা সেন বাংলাদেশের মেয়ে

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০২৩
সুচিত্রা সেনের প্রেমে পড়েছিলেন আমার বাবা, আমি পড়িনি। না হলে আমাদের শহরের ‘রওশন টকিজ’ হলে সুচিত্রার ছবি এলেই মাকে নতুন কাপড় পরিয়ে রিকশায় বসিয়ে বাবা হুড তুলে ভাইবোনদের (যার যার) দাঁড়ানো রিকশা ভরে নিয়ে যেতেন সুচিত্রা দর্শনে। আমি তখন সিনেমা বোঝার বয়সে পড়িনি। কিন্তু সিনেমা হলে বাবার দেওয়া চানাচুর ভাজা, দুধ মালাই তো নিশ্চিত। আমি এতেই সন্তুষ্ট।
রিকশার টুনটুন বাজিয়ে মধ্যরাতে যখন ঘরে ফেরা হতো, তখন বড় চাচা গলা খাকারি দিয়ে বলতেন, ‘কি রে, বই দেখে ফিরলি?’
বাবা বলতেন, ‘জি মিয়া ভাই। সুচিত্রা সেনের ছবি।’ ওই পর্যন্তই। পরে সুচিত্রা সেনের প্রেমে পড়েন বড়ভাই। কলেজে ওঠার পরপর তার মাথার ভেতর রমা ঢুকে যায়। আর যাবে কোথায়? বাবার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সুচিত্রার বই দেখে দেখে বড়ভাই ঈষৎ রোমান্টিক, ঈষৎ বিরহ পালন করতে করতে যৌবন অতিক্রম করেন। বাবা ও বড়ভাইয়ের আরাধ্য নারীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় আরও পরে। যখন স্কুল শেষ করে কলেজে উঠেছি।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ভারতীয় ছবির ‘চ্যারিটি শো’ হিসেবে প্রদর্শিত হতে থাকে সিনেমা হলগুলোয়। ঠিক তখনই সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আমার পরিচয়। ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে সুচিত্রা সেন। বসন্ত চৌধুরীর সেবার দায়িত্বে নার্স সুচিত্রা সেন। সহশিল্পী পাহাড়ী সান্যাল। অসাধারণ এক নারীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যৌবনে পা দেওয়া এক যুবক। অনুরণন তুলতে থাকে… ‘এই রাত তোমার আমার।’ চোখের তারার তার ব্যাকুল নিমন্ত্রণ! সে কোনো সাধারণ নারী নয়। যুবকের ভূভাগে নারীর বাঁকা অক্ষির মোহনা জুড়ে চতুরতা। তা কেবল গহীন সাগরে হাবুডুবু খাওয়া কাতর ডলফিন। কণ্ঠের মধুরিমায় যে প্রকাশ, এর নাম মমতাময়ী প্রেমিকা। আমি তো তার জন্যই অপেক্ষা করছি।
বাবা ও বড়ভাইয়ের ভালোবাসায় প্রাপ্তি ছিল। তাদের সঙ্গে সুচিত্রা সেনকে মানায়নি। আমি তার যথার্থ প্রেমিক। আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছি। না, ওই মুখ দেখে তৃষ্ণা মেটেনি আমার। এরপর শুধু সুচিত্রা সেনকে আবিষ্কার করা। বাংলা-হিন্দি ছবি মিলিয়ে সুচিত্রা সেন অভিনয় করেছে ৬০টি ছবিতে। ৫৩টি বাংলা, বাকি ৭টি হিন্দি ছবি। প্রথম বাংলা ছবি, ‘সাত নম্বর কয়েদি’ মুক্তি পায় ১৯৫৩ সালে। শেষ ছবি ‘প্রণয়পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। হিন্দি ছবি ‘দেবদাস’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। বাংলা ছবি ‘দেবদাস’ মুক্তি ১৯৫৫ সালে। শেষ হিন্দি ছবি ‘আঁধি’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে।
সুচিত্রা সেন অভিনীত ছবির নায়করা (বাংলা) সমর রায়, উত্তম কুমার, রবীন মজুমদার, বিকাশ রায়, অশোক কুমার, অসিত বরণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ কুমার, নির্মল কুমার, উৎপল দত্ত, সমিত ভঞ্জ ও রঞ্জিত মল্লিক।
হিন্দি ছবির নায়করা দিলীপ কুমার, শেখর, ভরত ভূষণ, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র ও সঞ্জীব কুমার। সুচিত্রা সেন অভিনীত সর্বাধিক জুটির মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নায়ক উত্তম কুমার। উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ছবি ৩০টি। সুচিত্রা সেনের ৩৫ বছর অভিনয় জীবনে উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ছবি ৩০টি। সুচিত্রা সেনের ৩৫ বছর অভিনয় জীবনে উত্তম-সুচিত্রা সফল ও চিরায়ত জুটি হিসেবে চিহ্নিত। কে ও কী কারণে সফল এবং চিরায়ত ওই ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তার সময়ে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের সফল তারকাদের সঙ্গে সুচিত্রা সেন অভিনয় করেছেন। বলা যায়, ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে সফল ও দর্শকনন্দিত নায়িকা হিসেবে সুদীর্ঘ সময় দীপ্যমান। ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করুন, আপনার প্রিয় নায়িকা কে? অন্তত ৬০ শতাংশ দর্শক জবাব দেবেন সুচিত্রা সেন। কে ও কী কারণে সুচিত্রার সফল অভিনয়শৈলীর একটু ঠিকুজি থাকা দরকার। সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯২৯ সালের ৬ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচিতে তার মামাবাড়িতে। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার একতলা পাকা পৈতৃক বাড়িতে শিশুকাল, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। স্কুলে ভর্তি করার সময় তার নাম রাখা হয় কৃষ্ণা দাসগুপ্ত।
ডাকনাম রমা। বাবা করুণাময় দাসগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ভাইবোনদের মধ্যে সুচিত্রা পঞ্চম। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর পাবনা ছেড়ে বাবার সঙ্গে তিনি চলে যান কলকাতায়। ওই বছর তার বিয়ে হয় আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে। রমা সেন ভালোবেসেই দিবানাথ সেনকে বিয়ে করেছিলেন ১৯৪৮ সালে। স্বামীর সম্মতিতেই ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে চিত্রজগতে আত্মপ্রকাশ তার। কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায়নি।
সুচিত্রা সেন সম্পর্কে চিত্র পরিচালক সুকুমার দাসগুপ্ত বলেছেন, ‘১৯৫১ সালে ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছি। এমন সময় অমিত চৌধুরী বললেন, একটি ভালো ও শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে আছে। মনে হয়, সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে নাম করবে। তার কথায় মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিতে বললাম। প্রথম দিন তার স্বামী দিবানাথ সেনের সঙ্গে এসেছিলেন দেখা করতে অরোরা স্টুডিওতে। ছিপছিপে চেহারা, ডাগর ধরনের চোখ। চোখ দুটি ভারী সুন্দর এবং খুব এক্সপ্রেসিভ। চাহনিতে স্বচ্ছ গভীরতা। মিষ্টি হাসিতে মুখখানা যেন উচ্ছ্বলতায় ভরে যায়। একনজরে পছন্দ হয়ে গেল। কণ্ঠস্বরও বেশ মিষ্টি। কথার মধ্যে বাঙাল টোন আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিতে রাজি হয়ে গেলাম।’
ওই ‘সাত নম্বর কয়েদি’ দিয়ে শুরু। তখনও রমা সেন নামেই পরিচিত। ১৯৫২ সালে রমা সেন পাল্টিয়ে সুচিত্রা সেন নামে আত্মপ্রকাশ নীরেন লাহিড়ীর ‘কাজরী’ ছবিতে। ৫ ফিট সাড়ে ৪ ইঞ্চির মতো সুচিত্রা হয়তো আজকের সুস্মিতা ও ঐশ্বর্যদের মতো দীর্ঘাঙ্গী নন। ফিতার মাপে তিনি স্লিম নন, নন আন্তর্জাতিক রূপসী। তার সুগঠিত নাক, লম্বাটে ভরাট মুখমণ্ডল, ছোট কপাল, একঢাল কালো চুল, শ্যামবরণ ত্বক। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘কালো মেয়ের প্রেমে পড়লে ওঠা যায় না।’ সুচিত্রা সেনের সৌন্দর্য অনেকটা ওই ঘরণায় আকৃষ্ট করে। একই সঙ্গে দূরত্ব রচনা করে রোমান্টিক ও বিরহী। আমার মতো লাখো প্রেমিক আছে সুচিত্রা সেনের। যেকোনো বয়সের প্রেমিক।
সিনেমা জগতে এত দীর্ঘকাল প্রেমিকা থাকা খুব কঠিন। সুচিত্রা সেন ছিলেন এবং আছেন। মনময়ূরী স্বপ্নের দেবী। কী চমৎকার রূপ, কী তার চাহনি, কী অভিনয়! যেন বারবার হৃদয় পোড়ে। সুচিত্রা সেন মানেই স্বতন্ত্র স্টাইল। বলা যায়, তার মতো স্টার ইমেজ কারও ছিল না। দর্শককুল তাকে গভীর ভালোবাসে। এতে কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব নেই। কাম ও ক্রোধহীন নিষ্পাপ প্রেম। সে প্রেম কোনো পুরুষকে জীবন ভালোবাসতে শেখায়। বিরহের অনল হৃদয়ে উত্তাপ ছড়ায়, এর মধ্যে সহস্র রেণু ঝরে পড়ে। তা মানুষকে অনন্ত এক সহযাত্রীর সন্ধান দেয়।
বাংলা ছবির গ্ল্যামার কুইন সুচিত্রা। রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে তার খ্যাতি চিরায়ত। তার দীর্ঘ রোমান্সের সমকক্ষ অভিনেত্রী সে যুগে কেউ ছিল না, এ যুগেও কেউ নেই।
তো কলেজে পড়া ঝুল-বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে যে নারী, তিনি প্রণয় আর সে জয়িত সুন্দরী। এ রকম গহীন রহস্যের অনঙ্গ পরী, সৌন্দর্যের অনন্য উপমা ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’ দিয়ে এ নারীকে আবিষ্কার করা। সাধারণ নার্স, শুভ্র বসনা। চোখের অনন্য চাহনিতে উল্টে দিয়েছিল পৃথিবীর দেওয়াল।
প্রেমান্ধ পরিব্রাজক আস্তে আস্তে খুঁজে পায় ‘পথে হলো দেরি’র মল্লিকা, ‘উত্তর ফাল্গুনী’র ব্যথিত মা ও কন্যা। অপূর্ব অভিনয়শৈলী হৃদয়িক মহিমায় তাকে কেবলই উচ্চশিখরে নিয়ে গেছে।
উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ৩০টি ছবি বাংলা সিনেমায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যখন পর্দায় দুজনকে দেখা যেত তখন তা আর অভিনয় থাকেনি, হয়ে উঠেছে বাঙালির জীবন কাহিনির দৃশ্যমান সহজ চলচ্চিত্র। অসাধারণ ব্যক্তিত্বে দুজনই কিংবদন্তি। কী চলনে, কী বলনে। এখনও সুচিত্রা-উত্তমের ছবি চ্যানেলগুলোয় প্রদর্শনের সময় বাংলা সিনেমার দর্শককুল দয়িতা অথবা প্রেমিক হয়ে ওঠে।
আমি যখন সুচিত্রা সেনকে খুঁজে পাই তখন তিনি প্রায় অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ সত্তর দশকের প্রথম দিকে। ১৯৭৮ সালে তার অভিনীত শেষ বাংলা ছবি ‘প্রণয়পাশা’ মুক্তি পায়। এরপর রুপালি পর্দা থেকে অবসর নিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান তিনি। ধর্মের প্রতি গভীর অভিনিবেশ তাকে জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। শেষ দিকে বলতেন, ‘এক সময় বাসনার রূপ ছিলাম। তাই এখন সরিয়ে নিয়েছি নিজেকে ওই চোখগুলো থেকে অনেক দূরে।’
প্রায় ৩৫ বছরের আলো ঝলমল জীবন তাকে ধরে রাখতে পারেনি। গৃহকোণে নিভৃতে ঈশ্বরের খোঁজে বসবাস করে সাধারণ হয়ে বাঁচতে চেয়েছেন।
১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর তার গলায় মালা রেখে গিয়েছিলেন। এরপর মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেননি। একাকী নিঃসঙ্গ জীবনযাপন।
হলিউডের গ্রেটা গার্বো, টালিউডের সুচিত্রা সেন খ্যাতির তুঙ্গে থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন। গ্রেটা গার্বো ১৯৪১ ও সুচিত্রা ১৯৮০ সালে। প্রচারের হ্যালোজেন থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত দুই কিংবদন্তি ফিরে আসেননি রুপালি পর্দায়। তারা অধরা মাধুরী। দুই নারী ঢেকে রেখেছেন তাদের গভীর গোপন সেই অন্ধকার, পিচ্ছিল গহ্বর, ব্যক্তিগত জীবন।
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার এক হাসপাতালে ৮৪ বছর বয়সে তার বর্ণাঢ্য জীবনচরিতের অবসান ঘটে। রেখে যান একমাত্র কন্যা মুনমুন সেন এবং নাতনি রিয়া সেন ও রাইমা সেন। তারাও হিন্দি ছবিতে উত্তরাধিকারের উজ্জ্বল উপস্থিতি রেখেছেন।
আমি নামক মানুষ যে নারীর ঊর্ণনাভে জড়িয়ে মধ্যাহ্নে পৌঁছে গেছি, আজও তার প্রতি অণুরাগের এতটুকু কমতি নেই। তাকে সন্ধান করতে করতে এক সময় মনে হয়েছে, আমার কিছুই হারায়নি। এমন মগ্নতায় কি ছল থাকে? সুচিত্রা সেন অভিনীত চরিত্রগুলো হেঁটে আসে কখনও রমা, কখনও মল্লিকা। মল্লিকা বলছেন, ‘আমার মনে হচ্ছে আমাদের ভালোবাসা দেখার জন্য ওই কাঞ্চনজংঘার নিচে এত সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে…। ভাটার ফুল ঝরে যাবে, চাঁদ ডুবে যাবে। কিন্তু আজকের লগন কোনো দিন শেষ হয়ে যাবে না।’
প্রিয় সুচিত্রা সেন, আপনার চোখের মায়াময় দ্যুতি, হৃদয়কাড়া হাসি, অব্যক্ত ক্রন্দনের দৃশ্যকল্প খুঁজে খুঁজে এত দিন-রাতের মুগ্ধতা কি বিস্মরণের অতলে হারিয়ে যেতে পারে? আপনার চোখের তারায় ক্রুশবিদ্ধ করেছি। বর দিন, তিন পুরুষের প্রণয়পাশার খেলোয়াড় কেমন কাঙাল হয়ে আছে!
লিখেছেন : আলমগীর রেজা চৌধুরী

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com