লকাতা থেকে দুই ঘন্টা পনের মিনিটের বিমান যাত্রায় তেরশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আন্দামান ও নিকোবর রাজ্যের রাজধানী পোর্টব্লেয়ার পৌঁছলাম। আকাশ থেকে প্রায় আধা ঘন্টা ধরে সাগর আর পাহাড়ের মিতালি চোখে পড়ে। আসলে আন্দামানের চারপাশে বঙ্গোপসাগর, আন্দামান সাগর আর ভারত মহাসাগরের অবস্থান। এইজন্যই যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি।
দুই রাত তিন দিন ধরে ইতিহাস চর্চার পর আমাদের মন আন্দামানের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য আকুলিবিকুলি করছিল। এবার তাই নির্ভেজাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সন্ধানে আমরা রওনা দেই আন্দামান সাগরের আরেকটি দ্বীপ হাভেলকের উদ্দেশ্যে। ৮০ কিলোমিটারের মত সমুদ্র্রপথ আধুনিক ক্রুজ শিপের কল্যানে মাত্র দুই ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছে যাই আমরা। জাহাজ থেকে নেমে দীর্ঘ জেটির পথ ছিল বিস্ময়ে ভরা। স্বচ্ছ পানির নিচে সাদা বালিতে খেলে বেড়ানো রঙবেরঙের মাছের মেলা দেখে আমরা অভিভূত।
রস আইল্যান্ডে এসেও সময় বাঁচাতে আমরা দ্রুত হোটেলে ছুটলাম। দুপুরের খাবার শেষ করেই ট্যাক্সি ধরে ছুটলাম রাধানগর বিচের উদ্দেশ্যে। এক ঘন্টার মত লাগল সেখানে পৌঁছাতে। টাইম ম্যাগাজিনের বিচারে এই বিচটি এশিয়ার মাঝে সেরা। বিচটি আসলেই দেখবার মতো সুন্দর। যেদিকেই তাকানো যায় চারদিকে শুধু ঘন নীল পানি, ধবধবে সাদা বালি আর ঘন সবুজ বনের মিতালী মিলে তৈরি করেছে অপার্থিব সৌন্দর্যের লীলাভূমি।
পরদিন সকালে গেলাম এলিফ্যান্ট বিচ। অনিন্দ্যসুন্দর এই বিচে মাঝেমধ্যেই হাতির দেখা মেলে। এইজন্যই এমন নামকরণ। এই বিচে নানারকম ওয়াটার স্পোর্টস উপভোগ করা যায়। সেসব স্পোর্টস উপভোগের ঠিক শেষ মুহূর্তে আমরা হাতির দেখা পাই যা আমাদের ভ্রমণকে পরিপূর্ণ করে এ যাত্রা।
দুইরাতের হাভেলক ভ্রমণ শেষে আবারও শিপে করে নীল আইল্যান্ডমুখী যাত্রা। এবারের যাত্রা ৪৫ মিনিটের। জীবন্ত প্রবালের জন্য বিখ্যাত এই দ্বীপ। মাত্র দুই ঘন্টার মত আমরা ছিলাম গ্লাস বটম বোটে। বোটের কাঁচের পাটাতনের নীচে স্বচ্ছ পানিতে জীবন্ত প্রবাল আর মাছের লুকোচুরি সারাজীবন মনে রাখবার মতো স্মৃতি হয়ে জমা হয় আমাদের হৃদয়ে। এই দ্বীপেই আছে কোরাল ব্রিজ যা স্থানীয়ভাবে হাওড়া ব্রিজ নামে পরিচিত।
প্রায় ছয়শ দ্বীপ নিয়ে আন্দামান এন্ড নিকোবর আইল্যান্ড গঠিত যার মাত্র ২৫ কিংবা ২৬টিতে মানুষের বসতি রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই আবার এখানকার স্থানীয় আদিবাসী। আমাদের পাঁচ রাত ছয় দিনের ভ্রমণে এতগুলো দ্বীপের মধ্যে মাত্র চারটি দ্বীপ দেখা সম্ভব হয়েছে। দ্বীপের প্রায় চার লাখ অদিবাসীর অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী, যাদের পূর্বপুরুষ তৎকালীন পূর্ববাংলা (বিশেষ করে দক্ষিণ অঞ্চল) থেকে গিয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে সবাই তাদের বাড়িতে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছে। সেসব বাড়িতে তাদের পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের স্মৃতিচারণে বাংলাদেশের কথা উঠে এসেছে। বারবার করে আমাদের দেশের উন্নতি সম্মন্ধে জানতে চেয়েছেন তারা। কতকাল আগে দেশ ছেড়ে এলেও এখনো ছেড়ে আসা মাটির প্রতি তাদের টান লক্ষণীয়। এখানকার একটা বিষয় ঠিক আমাদের মত আর তা হল স্থানীয় অধিবাসীরা খুব অতিথিপরায়ণ। এখানে গেলে পাবেন প্রচুর খাবার হোটেল, খাবারও একদম বাংলাদেশের মত। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আর আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী আন্দামান হতে পারে আপনার পরবর্তী ভ্রমণ গন্তব্য।
লেখক এ.এস.এম শাহীন