রবিবার, ৩০ মার্চ ২০২৫, ০৩:৫৪ অপরাহ্ন

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড না থাকায় দেশীয় গ্র্যাজুয়েটে আগ্রহ কম বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫

দেশের অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা ও এর মান নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। এ কারণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির পাশাপাশি দেশেও নির্বাহীরা স্থানীয় গ্র্যাজুয়েটদের প্রতি ভরসা রাখতে পারছেন না। দেশে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বাড়লেও দক্ষতার ঘাটতি থাকায় তাদের সবার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না। দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন থাকলেও উচ্চশিক্ষিত বেকার বেড়েই চলেছে। অনেক কোম্পানি বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়ে ঘাটতি পূরণ করে আসছেন।

দেশের খাতসংশ্লিষ্টরা এ ধরণের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। এবার একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন প্রতি বছর ‘কান্ট্রিজ উইথ বেস্ট পারফর্মিং এডুকেশন সিস্টেম’ শীর্ষক জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান এতে তুলে আনা হয়। সে অনুযায়ী, বিশ্বের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় মানদণ্ডে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

৯৩টি দেশের র‌্যাংকিং করা হয়েছে। এর চূড়ান্ত তালিকায় প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ থাকলেও বাংলাদেশ নেই। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ), ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, ইউনেস্কো, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং, বিশ্বব্যাংকসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য এ প্রতিবেদনে সমন্বয় করা হয়েছে।

এ ধরনের দুর্বলতাগুলোর বিষয়ে অবগত আছেন দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তারাও। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মজিদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪০ শতাংশ পাঠদান ও ৬০ শতাংশ গবেষণা থাকা দরকার। কিন্তু দেশে শুধু পাঠদাননির্ভর শিক্ষা। হাতে-কলমে শিক্ষা নেই বললেই চলে। গবেষণায়ও বরাদ্দ অপ্রতুল। বড় বড় ক্যাম্পাস থাকলেও গবেষণা হয় না।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবেও পিছিয়ে, তাদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে। এক জায়গায় নিজেকে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত না করে অন্যত্র বেশি বেতনে যাওয়ার চেষ্টা থাকে। লিডারশীপ নেওয়ার বিষয়ে তেমন আগ্রহ থাকে না। ফলে তারা পিছিয়ে পড়ছে। ইংরেজিতে কম দক্ষতার পাশাপাশি যোগাযোগের ক্ষেত্রেও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে।

এসব থেকে বেরিয়ে আসতে কারিকুলামে এন্টারপ্রেনারশিপ বা উদ্যোক্তাভিত্তিক কোর্স যুক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে উপাচার্য বলেন, শিক্ষার্থীদের লিডারশিপের মতো বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। মোরালিটির মতো বিষয় শেখাতে হবে। এগুলো হলে তখন শিক্ষার্থীরা দক্ষ দেশে-বিদেশে নেতৃত্ব দিতে পারবে। এক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকদের কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে।

১৬টি ডাটা পয়েন্টে এক লাখ ৯৬ হাজার ৩০০ ব্যক্তির ওপর পরিচালিত জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাংকিং প্রস্তুত করা হয়েছে। জানা গেছে, দেশের ১৬৩টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ১৩০টি শিক্ষক সংকটসহ নানান সমস্যায় ভুগছে। এ সংকটের প্রভাব ফুটে উঠেছে র‌্যাংকিংয়ে। এ তালিকা করার উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষামানের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে প্রভাবশালী শীর্ষ নির্বাহী ও কোম্পানি প্রধানদের উৎস দেশগুলোর সম্ভাবনা তালিকাভুক্ত করা।

বৈশ্বিক বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের নির্বাহীদের জন্য প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনের ২০২৪ সংস্করণে ৯৩টি দেশের র‌্যাংকিং করা হয়েছে। এর চূড়ান্ত তালিকায় প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ থাকলেও বাংলাদেশ নেই। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ), ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, ইউনেস্কো, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং, বিশ্বব্যাংকসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য এ প্রতিবেদনে সমন্বয় করা হয়েছে।

সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের র‌্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্য। ১০০ পয়েন্ট বিবেচনায় কোয়ালিটি ইনডেক্সে ৭৮.২ এবং অপরচুনিটি ইনডেক্সে ৬৯.৭৯ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে দেশটি। তালিকার তলানিতে ৯৩তম হয়েছে বতসোয়ানা। তাদের পয়েন্টে ২৭ ও ৪০.১৬। ভারত ৫৯.১ এবং ৪৮.২১ পয়েন্ট নিয়ে ৩৩তম অবস্থানে রয়েছে। ৩৯.৩ এবং ৪১.৯৬ পয়েন্ট নিয়ে ৭৭তম অবস্থানে শ্রীলংকা। পাকিস্তান ৩৪.৭ এবং ৪০.৮২ পয়েন্ট নিয়ে ৮৩তম। ২৮.৫ এবং ৪০.৬২ পয়েন্ট নিয়ে মালদ্বীপ আছে ৮৭তম স্থানে। গৃহযুদ্ধ সামলানো মিয়ানমার ২৭.২ এবং ৪০.২২ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার ৯২তম স্থানে আছে।

চলতি বছরের কিউএস সাসটেইনেবিলিটি বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক পর্যায়ে ৬৩৪ ও এশিয়ায় ১১২তম স্থানে রয়েছে। এশিয়ার ৯৮৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের আছে ২৯টি। এর মধ্য ১৩টি পাবলিক, ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাংকিংয়ে দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের ২৪টি রয়েছে। ১৭টি সরাসরি র‌্যাংকিংয়ে এবং সাতটি রিপোর্টার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে।

তালিকায় বিশ্বের সেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটিও নেই। শিক্ষার মান, শিক্ষার্থী-শিক্ষকের অনুপাত, গবেষণা, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সূচকে বিশ্বের ১১৫টি দেশের প্রতিষ্ঠান নিয়ে এ তালিকা করা হয়। শিক্ষাবিদসহ খাত সংশ্লিষ্টরাও দেশের শিক্ষা ও পাঠক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকদিন ধরে। দেশের গ্র্যাজুয়েটদের শিক্ষার মান ও দক্ষতা নিয়ে সংশয় আছে শিক্ষাবিদ এবং কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীদেরও। মান ঠিক না থাকায় শিক্ষার্থীরা ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারছেন না।

এতে কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোজন পিছিয়ে আছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৩ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে এখন উচ্চ শিক্ষিত বেকার ৯ লাখ ৬ হাজার। ২০২২ সালে ছিল ৭ লাখ ৯৯ হাজার। ২০২২ সালে শিক্ষিত বেকারের হার ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে।

জরিপের প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোয়ালিটি ইনডেক্স ও অপরচুনিটি ইনডেক্স শ্রেণিতে স্কোরিং করা হয়। কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোরিংয়ের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাগ্রহণের আগ্রহ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাজেট, দক্ষতা, শিল্প সম্পৃক্ততা, গবেষণা, আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে অবস্থানের মতো বিষয়।

আর অপরচুনিটি ইনডেক্সে সাক্ষরতা ও গ্র্যাজুয়েশন হার, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার ও শিক্ষার বাজেটের মতো বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মক্ষেত্রে ভালো করার মতো দক্ষ করে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে পারছে না দেশের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। দক্ষতা অর্জনে বড় বাধা গবেষণার অপ্রতুলতা এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট খাতের মধ্যে পর্যাপ্ত যোগাযোগ না থাকা। এতে দক্ষ ও যোগ্য কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।

সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের র‌্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্য। ১০০ পয়েন্ট বিবেচনায় কোয়ালিটি ইনডেক্সে ৭৮.২ এবং অপরচুনিটি ইনডেক্সে ৬৯.৭৯ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে দেশটি। তালিকার তলানিতে ৯৩তম হয়েছে বতসোয়ানা। তাদের পয়েন্টে ২৭ ও ৪০.১৬। ভারত ৫৯.১ এবং ৪৮.২১ পয়েন্ট নিয়ে ৩৩তম অবস্থানে রয়েছে। ৩৯.৩ এবং ৪১.৯৬ পয়েন্ট নিয়ে ৭৭তম অবস্থানে শ্রীলংকা। পাকিস্তান ৩৪.৭ এবং ৪০.৮২ পয়েন্ট নিয়ে ৮৩তম। ২৮.৫ এবং ৪০.৬২ পয়েন্ট নিয়ে মালদ্বীপ আছে ৮৭তম স্থানে। গৃহযুদ্ধ সামলানো মিয়ানমার ২৭.২ এবং ৪০.২২ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার ৯২তম স্থানে আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা এক শিক্ষার্থী বলেন, তিনি পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষা এবং চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে দেখতে পান, তিনি যে পড়াশোনা করেছেন, তাতে অনেক পিছিয়ে আছেন। অনেক কিছুই তাকে নতুন করে শিখতে হবে। তার জন্য বিদেশে চাকরির ‍সুযোগ তৈরি করাও কঠিন। ফলে তিনি বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি বাদ দিয়ে দেশের কোম্পানিতে মোটামুটি বেতনে চাকরি শুরু করেছেন।

যদিও অনেক শিক্ষার্থী দেশে ঠিকমতো শিখছে বলে মনে করেন ব্রেইন স্টেশন-২৩ এর সিইও রায়সুল কবির। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা ভালো স্টুডেন্ট পাচ্ছি, যারা জয়েন করার যোগ্য। দেখা যাচ্ছে, পড়াশোনার পাশাপাশি যারা বিভিন্ন কাজ করছে, কম্পিটিশনে আসছে, হ্যাকথন করছে, তারা বেশি রেডি হচ্ছে। শুধু ইউনিভার্সিটির পক্ষে রেডি করা ডিফিকাল্ট।’

তিনি বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি যে কাজগুলো হচ্ছে, যেমন কম্পিটিশন, ইন্ডাস্ট্রি ইন্টার্নশিপ, ইন্ডাস্ট্রি মানুষজন কিছু ক্লাস নেয়া, সেমিনার করানো, এই কাজগুলো ভালো রেজাল্ট দিচ্ছে। আমাদের কোম্পানিতে আমরা স্টুডেন্ট নিয়ে হ্যাপি। আমাদের যেটা করতে হবে, সিনিয়র তৈরির জন্য ভালো ট্রেইনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। এই জায়গায় এখন বেশি গ্যাপ এবং এটা আমার মনে হয় ইন্ডাস্ট্রি থেকে করতে হবে হয়তো।’

দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এখন র‌্যাংকিংগুলোতে নিয়মিত আসছে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাদের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। তারা গবেষণা করতে পারছে কিনা, আবাসন সুবিধা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা, শিক্ষক নিয়োগ কেমন হচ্ছে, তারা রাজনীতির বাইরে পড়াশোনা নিয়ে ভাবছেন কিনা, এগুলোসহ নানান বিষয় বিবেচনা করা দরকার। আমাদের শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত মেধাবী। তাদের যদি আমরা ঠিকমতো তৈরি করতে পারি, তাহলে তারা এসব জায়গাগুলোয় এগিয়ে যাবে।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com