শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৩ পূর্বাহ্ন

আধুনিক দাসত্ব: সুরক্ষা দিচ্ছে যুক্তরাজ্য

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০২৩

আপনি কি যুক্তরাজ্যে গৃহকর্মী, আয়া বা গৃহস্থালি কোন কাজে নিয়োজিত? আপনি কি নিজেকে আধুনিক দাসত্বের শিকার বলে মনে করেন? তাহলে আপনার সুযোগ আছে দেশটির ন্যাশনাল রেফারেল মেকানিজম নামের কার্যক্রমের অধীনে সুরক্ষা চাওয়ার৷

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত নির্যাতনের শিকার বিদেশি গৃহকর্মীরা ‘আধুনিক দাসত্ব’ থেকে সুরক্ষা চাইতে পারেন৷ যেসব অভিবাসী গৃহকর্মী ভিসায় (ও.ডি.ডব্লিউ.ভি) দেশটিতে আসেন এবং নিয়োগকারীর অবমাননাকর আচরণের শিকার হন তাদের সহায়তায় সরকারের ‘ন্যাশনাল রেফারেল ম্যাকানিজম’ বা এন.আর.এম. নামে একটি কার্যক্রম রয়েছে৷

তবে জেনে রাখা দরকার, এন.আর.এম. আপনাকে কোন ভিসা বা আশ্রয়ের নিশ্চয়তা দিবে না৷ এটি মূলত একটি সরকারি স্কিম যার মাধ্যমে নিয়োগকারীর নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা অভিবাসীরা প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে পারেন৷

আধুনিক দাসত্ব বলতে কী বোঝায়?

মানবপাচার, দাসত্ব বা জোরপূর্বক শ্রমের মতো শোষণমূলক আচরণকে আধুনিক দাসত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷

কর্মীদের অনেকে অভিযোগ করেন তাদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অথবা প্রতারণার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসা হয়৷

কাজের সময়সীমা না থাকা, মজুরি আটকে রাখা, কারো তত্ত্বাবধানে ছাড়া বাইরে যেতে না দেয়াসহ নানা অবমাননাকর পরিস্থিতিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তারা৷

কিছু ক্ষেত্রে পাসপোর্ট বা মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া, যথেষ্ট খাবার না দেয়া এবং মৌখিক, মানসিক, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনাও জানা যায়৷

যেসব পদক্ষেপ নেয়া যায়

আধুনিক দাসত্বের শিকার হিসেবে এন.আর.এম. এর সুরক্ষার জন্য বিবেচিত হতে হলে গৃহকর্মীর আবেদেনটি ‘ফার্স্ট রেসপন্ডার অর্গানাইজেশনের’ বা প্রথম সাড়াদানকারী সংস্থার মাধ্যমে আসতে হবে৷

আটটি সরকারি সংস্থা ও দশটি বেসরকারি সংস্থার এই ভূমিকা বা এখতিয়ার আছে৷ এমনই এক বেসরকারি সংস্থা কালাইয়ান (Kalayaan) এর সঙ্গে কথা বলেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস৷ এটি গৃহকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে৷

বেশ কিছু ক্ষেত্রে অবমাননাকর পরিস্থিতির শিকার অভিবাসীরা শুরুতে স্থানীয় সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন৷ তাৎক্ষণিক কিছু সহায়তা দেয়ার পর তারা প্রথম সাড়াদানকারী সংস্থার কাছে অভিবাসীদের পাঠায়৷

ফিলিপিনো ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংগঠনের সহায়তা নেয়া ফিলিপিন্সের কয়েকজন গৃহকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস৷

তাদেরই একজন মারিসা (ছদ্মনাম)৷ ২০১৮ সালে কাতার হয়ে যুক্তরাজ্য আসেন তিনি৷ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে মারিসা জানান, তাকে চাকরিদাতার দুইটি বাড়ি পরিষ্কার করতে হতো৷

তিনি বলেন, ‘‘আমার কোন ছুটির দিন ছিল না৷ সাত দিন, ২৪ ঘণ্টাই কাজ করতাম আমি৷’’ স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি মেঝেতে ঘুমাতাম৷ আমার খাওয়ার জন্য অবশিষ্ট থাকতো বড়জোর রুটি, ডিম আর পানি৷’’

২০১৯ সালে নির্যাতনকারী চাকরিদাতার কাছ থেকে পালিয়ে আসেন তিনি৷ আধুনিক দাসত্বের শিকার বিবেচিত হওয়ায় এনআরএম কর্মসূচির সহায়তা পান তিনি৷

ফিলিপিনো ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন সদস্যদের অনেকেই আধুনিক দাসত্বের শিকার হয়ে  এনআরএম স্কিমের সহায়তা পেয়েছেন৷ ছবি: আর্নো পেদ্রাম
ফিলিপিনো ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন সদস্যদের অনেকেই আধুনিক দাসত্বের শিকার হয়ে এনআরএম স্কিমের সহায়তা পেয়েছেন৷ ছবি: আর্নো পেদ্রাম

প্রশ্নের পর প্রশ্ন

কালাইয়ানের মতো প্রথম সাড়াদানকারী সংস্থা ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসীদের কয়েক ধাপের সাক্ষাৎকার নেয়৷ যুক্তরাজ্যে আসা থেকে শুরু করে কাজের অভিজ্ঞতা এবং পালিয়ে আসার বিস্তারিত জানতে চায় তারা৷

সংস্থার একজন কর্মকর্তা অ্যাভ্রিল শার্প ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তাদের বিস্তর প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন৷ বলেন, ‘‘কাউকে বিরক্ত করা এর উদ্দেশ্য নয়৷ এটা করা হয় যাতে মূল্যায়নের জন্য সমস্ত তথ্য আমরা সংগ্রহ করতে পারি৷’’ সরকারের সুরক্ষা পেতে হলে কাজের পরিবেশকে দাসত্বের দিক থেকে মূল্যায়ন করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷

সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ হলে কালইয়ানের মতো প্রথম সাড়াদানকারী সংস্থা সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়ের এনআরএম-এর কাছে তারা ওই ব্যক্তির আবেদন সুপারিশ করবে কিনা৷

এনআরএম-এর শর্তগুলো পূরণ না হলে অভিবাসীদের একমাত্র সুযোগ হলো একজন আইনজীবী নিয়োগ দেয়া এবং নির্যাতনকারী নিয়োগকর্তাকে আদালতে হাজির করা৷ যদিও বেশিরভাগ অভিবাসীর পক্ষেই এই খরচ বহন করা সম্ভব হয় না৷

প্রাথমিক সিদ্ধান্ত

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনটি আসার পর সাধারণত পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যেই প্রাথমিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়৷ সেটি ইতিবাচক হতে পারে আবার নেতিবাচকও হতে পারে৷

আবেদন নাকচ হলে আপিল এবং সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার বিধান রয়েছে৷ আবেদন সুপারিশ করা প্রথম সাড়াদানকারী সংস্থা এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে আপিলের জন্য সহায়তা করতে পারে৷ সাধারণত নাকচ হওয়া সব আবেদনকারীকেই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার পরামর্শ দেয়া হয়৷

যাদের আবেদন গৃহীত হয় তারা আইনি সহযোগিতা, থাকার ব্যবস্থাসহ নানা সহায়তা পান৷ স্যালভ্যাশন আর্মি ও অন্য দাতা সংস্থাগুলো সাধারণত এই সেবাগুলো দিয়ে থাকে৷

দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত

প্রথম ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেয়ার পর এন.আর.এম. এর কাছ থেকে দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে৷

তবে দিন দিন আবেদনের সংখ্যা বাড়ায় অপেক্ষার সময় আরো দীর্ঘ হতে পারে বলে মনে করে কালইয়ান৷

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন প্রত্যেকের বিষয়গুলো আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখে৷ যেমন, আবেদনকারী যুক্তরাজ্যে অবস্থান, আইনি প্রক্রিয়া, ক্ষতিপূরণ বিষয়গুলোরও সুরাহা করা হয়৷

তবে যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতির জন্য এন.আর.এম.এ চূড়ান্ত সমাধান নয়৷ এর অধীনে সাময়িক বসবাসের অনুমতি মিললেও পুরোপুরি সুরক্ষা বা আশ্রয়ের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না৷

আধুনিক দাসত্বের শিকররা আলাদাভাবে আশ্রয় আবেদন করতে পারেন৷ দেশে ফিরে গেলে আবারও পাচার হয়ে দাসত্বের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন এমন কারণ দেখিয়ে সাধারণত অনেকেই আবেদন করেন৷

নির্যাতন ও দাসত্ব বরণের ঝুঁকি

প্রথম ও দ্বিতীয় সিদ্ধান্তের মধ্যবর্তী সময়ে ভুক্তভোগীর কিছু অধিকারের বিষয়ে নজর রাখাও গুরুত্বপূর্ণ৷

কেউ যদি তার গৃহস্থালি কাজের ভিসার মেয়াদ পূর্তির ছয় মাস আগে প্রথম সিদ্ধান্তটি পেয়ে থাকেন তাহলে তিনি দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়ার আগ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন৷

কিন্তু ভিসার মেয়াদ ছয় মাসের কম থাকলে তিনি এই সময়ে কাজের অনুমতি পাবেন না৷ তাকে পরের সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷

এর ফলে অনেকেই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন৷ বেশিরভাগ কর্মীরাই অভিযোগ করেন তাদের পক্ষে এই সময় কাজ ছাড়া থাকা প্রায় অসম্ভব৷ বেশ কয়েকজন বিদেশি কর্মী ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছেন, নিজ দেশে পরিবারের অসুস্থ সদস্যের চিকিৎসা বা সন্তানের পড়াশোনার জন্য তাদেরকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়৷

এই অবস্থায় অনুমতি না থাকলে কোনো অভিবাসীকে কাজে নিয়োগ দেয়া নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের জন্যও কঠিন৷ কেননা এর ফলে বড় অঙ্কের জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ডও ভোগ করতে হতে পারে৷ অন্যদিকে কাজের অনুমতি না থাকা অভিবাসী আটক এবং অভিবাসন সংক্রান্ত জটিলতার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন৷

শার্প জানান এমন প্রেক্ষিতে অনেক অভিবাসী আবারও নির্যাতন ও পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েন৷

তিনি বলেন, ‘‘তারা অনেক সময়ই অনানুষ্ঠানিক বা অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে বাধ্য হন, যেখানে আবারো তারা প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হন, আর তাদের এই পরিস্থিতির সুযোগে থাকেন শোষণকারী চাকরিদাতারা৷’’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com