আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক ও চাকরিচ্যুত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করতে যাচ্ছে দুদক। তাদের বিরুদ্ধে দুদকে বেশকিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। এ ছাড়া তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি সংক্রান্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট।
এই দুই সাবেক সেনা কর্মকর্তার বিষয়ে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে জেনারেল আজিজ এবং জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অঢেল সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারি চাকরি করে বৈধভাবে এত বেশি সম্পদ অর্জন করা অসম্ভব। এসব সম্পদ তারা কীভাবে গড়েছেন, তার জন্য অনুসন্ধানের প্রয়োজন। চলতি সপ্তাহে কমিশন থেকে তাদের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হতে পারে।
দুর্নীতির অভিযোগে গত ২০ মে জেনারেল আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ হয়। তার বিরুদ্ধে ওঠা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের দাবি উঠলেও এতদিন পাশ কাটিয়ে গেছে দুদক। অভিযোগ অনুসন্ধানের দাবি জানিয়ে গত ২৯ মে দুদকে আবেদন করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। এরপর তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ দুদক অনুসন্ধান করবে কিনা- এ নিয়ে আলোচনা জোরালো হয়। ওই সময় দুদক থেকে জানানো হয়েছিল, আজিজের দুই ভাইয়ের ‘মিথ্যা তথ্যে ই-পাসপোর্ট ও এনআইডি জালিয়াতি’র অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
তবে গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সকারের পতনের পর তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি, ঘনিষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালীদের গণহারে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত আসছে দুদক থেকে। এরই মধ্যে সাবেক দুই ডজন মন্ত্রী-এমপি ও সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ তালিকায় দেড় শতাধিক ব্যক্তির নাম রয়েছেন বলে জানা গেছে।
অঢেল সম্পদ : গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জেনারেল আজিজ ও তার পরিবারের নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। রাজধানীর আমিনবাজার এলাকায় সিলিকন সিটি হাউজিংয়ে তার প্রায় ২০০ কাঠা জমি রয়েছে। এ ছাড়া সিলিকন সিটিতে তার ছোটভাই তোফায়েল আহমেদ জোসেফের নামেও প্রায় ২০০ কাঠা জমি আছে। অভিযোগ রয়েছে, জেনারেল আজিজ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় সিলিকন সিটি হাউজিংয়ের জমি দখলে সহায়তা করায় আজিজ ও তার পরিবারকে এই সম্পত্তি উপহার দেওয়া হয়।
এদিকে জেনারেল আজিজ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নে প্রায় ২১ বিঘা জমি, এর পাশে প্রায় ৫ বিঘার আরেকটি জমি, মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুরে ৪ কাঠার দুটি প্লট, মিরপুর বঙ্গবন্ধু কলেজ রোডে ৫ কাঠার প্লটে একটি ১০তলা বাড়ি, পল্লবীর একটি বিল্ডিংয়ে ২১টি ফ্ল্যাট, মিরপুর সিরামিক এলাকায় ৩ কাঠা প্লট, কুর্মিটোলা গল্ফ ক্লাবের পাশে নিকুঞ্জ-১ এ তার আলিশান একটি বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া তার ভাইদের নামে মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ে কুবা মসজিদের পাশে একটি ভবনে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট ও বছিলায় ৯৮ শতাংশ জমি রয়েছে।
জেনারেল আজিজের ভাই জোসেফের নামেও বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য জানা যায়। আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিংয়ে তার বিলাসবহুল একটি ১০তলা বাড়ি রয়েছে। এর পাশে আজিজের ভাতিজা আসিফ আহমেদেরও একটি বাড়ি রয়েছে। বাড্ডার সাতারকুলে প্রায় ২৩৫ বিঘা জমি দখলে রয়েছে জেনারেল আজিজের আরেক ভাই হারিছ আহমেদ ও স্থানীয় এক সাবেক এমপির ছেলে হেদায়েত উল্লাহ রনর। বাড্ডা মডেল টাউনের ২৩৫ বিঘা জমির ওপর তাদের নামে সাইনবোর্ড রয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে ওই সময় জেনারেল আজিজ দাবি করেছিলেন, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ অসত্য। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তৎকালীন বিজিবির প্রধান হিসেবে বা সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি কোনো দুর্নীতি করেছেনÑ এমন প্রমাণ করতে পারলে ‘যে কোনো পরিণতি’ তিনি মেনে নেবেন।
এদিকে এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের নামে অঢেল সম্পদের তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে। চাকরিচ্যুত এই সেনা কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এনটিএমসির হাজার কোটি টাকার কেনাকাটায় ২০১৭ সালে জিয়াউল আহসান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের পিএস হারুন অর রশীদ বিশ্বাস সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঘুষ, নিয়োগ, বদলি বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হন তারা। এরই মধ্যে আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
প্রসঙ্গত, সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুতির পর ১৫ আগস্ট জিয়াউল আহসানকে আটক করা হয় এবং পরের দিন নিউমার্কেট এলাকার দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলী হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর থেকে রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ঠিকানা