শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৯ পূর্বাহ্ন

অস্ট্রেলিয়ায় পাল তোলা জাহাজে ভেসে বেড়ানো

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০২৪

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সামুদ্রিক জাদুঘর ভ্রমণে গিয়ে জানতে পারলাম সেখানকার জাহাজগুলো সত্যিকারের জাহাজ বা সেগুলোর হুবহু রেপ্লিকা এবং সেগুলো সমুদ্র ভ্রমণে বের হয়। জেমস ক্রেইগ এবং ডিফেন জাহাজ দুটি নিয়মিত ভ্রমণ পিপাসুদের নিয়ে সমুদ্রে বেরিয়ে পড়ে। যে কেউই এই ভ্রমণে যেতে পারেন তবে তার বয়স ন্যূনতম বারো বছর হতে হবে।

অনলাইনে আগে থেকেই টিকিট করে নিতে হবে। আর আগে থেকে বমি প্রতিরোধকারী বড়ি খেয়ে নেওয়া ভালো। কারণ সমুদ্রের ঢেউয়ে অনেকেই বমি করে দেন। এটা জেনেই আমি আর আমার চৌদ্দ বছর বয়সী কন্যা উৎসাহী হয়ে গেলাম। অবশ্য একটু মন খারাপ হচ্ছিল কারণ আমার নয় বছর বয়সী ছেলে আমাদের সাথে যেতে পারবে না। অনলাইনে আমরা ডাইফেনের টিকিট করে তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। শুরুতে একটু মন খারাপ করলেও পরবর্তিতে মেনে নিলো।

অস্ট্রেলিয়ায় পাল তোলা জাহাজে ভেসে বেড়ানোজাহাজের ছইয়ের উপর দাঁড়িয়ে বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়

অফিসে আমার বসের সাথে এটা নিয়ে আলাপ করতেই সে আমাকে সেই সপ্তাহের ফেরির একটা ভিডিও দেখিয়ে বললো, তুমি এই ঢেউ দেখে ভয় পাবে না তো। আমি বললাম, মোটেও না। আমার জন্ম বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রশস্ত নদী পদ্মার তীরে। এই ঢেউ দেখে দেখে আমি বড় হয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি আমি চাইছি ঐদিন আবহাওয়া একটু বিপদজনক থাকুক যেন আমার মেয়েটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসতে পারে।

এরপর নির্দিষ্ট দিনে আমি আর মেয়ে হাজির হয়ে গেলাম সিডনির ডারলিং হারবারে অবস্থিত সামুদ্রিক জাদুঘরে। সেখানে শুরুতেই পলা নামের একজন নাবিক আমাদের স্বাগত জানিয়ে জাহাজের নানান খুঁটিনাটি বিষয়ে অবগত করলেন।

অস্ট্রেলিয়ায় পাল তোলা জাহাজে ভেসে বেড়ানোকামান দাগার পরের ধোঁয়ার কুন্ডলি

তার কাছ থেকেই জানলাম ১৬০৬ সালের মার্চ মাসে উইলেম জানসজুনের নেতৃত্বে ৬০ টন ওজনের ডাইফেন জাহাজটি বর্তমান পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার বান্দা থেকে রওনা হয়েছিল। নিজেদের অজান্তেই ইউরোপীয়রা অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে পৌঁছেছিল। এই সমুদ্রযাত্রাটি কেবল অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডের সাথে প্রথম ইউরোপীয়দের প্রথম যোগাযোগই নয় বরং এটি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আদিবাসী এবং ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রথম সাক্ষাতও ছিল। এটি জেমস কুকের যাত্রার ১৬৪ বছর আগের ঘটনা।

পরবর্তিতে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মেরিটাইম মিউজিয়ামের সাথে যৌথভাবে এই জাহাজটির রেপ্লিকা তৈরি করে রেপ্লিকা ফাউন্ডেশন। ১৯৯৯ সালের ২৪শে জানুয়ারী ফ্রেম্যান্টলে চালু হয়েছিল। এই জাহাজটি আসল জাহাজের হুবহু প্রতিকৃত অবলম্বন করে তৈরি করা হয়েছে। এই জাহাজে ভ্রমণ করে আপনি চারশ বছরেরও বেশি আগের সময়ে নাবিকদের ছয় মাসের সমুদ্রযাত্রার গতি প্রকৃতি সম্মন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন।

পাল তুলতে হাত লাগিয়েছে যাত্রীরাও

এরপর নোঙর করা জাহাজে উঠে পড়লাম। সবমিলিয়ে আমরা বারো জনের একটা দল। হিসাব করে দেখলাম আমাদের চেয়ে জাহাজের নাবিকের সংখ্যায় বেশি। জাহাজে শুরুতেই মারিয়া নামের একজন নাবিক আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে কিভাবে লাইফ জ্যাকেট পড়তে হবে সাথে আর কি কি করণীয় সেই বিষয়ে ধারণা দিয়ে দিলেন। এরপর জাহাজের ক্যাপ্টেন ব্র্যান্ডিন আমাদের স্বাগত জানিয়ে একটা বক্তব্য দিলেন।

সেখানে তিনি যাত্রাপথের এবং কিভাবে যাত্রা করবেন সেই বিষয়ে ধারণা দিলেন। শুরুতেই ইঞ্জিনের সাহায্যে ডাইফেনকে এমন একটা জায়গা নেয়া হবে যেখানে বাতাস আছে ,এরপর বাতাসে পাল তুলে যাত্রা করা হবে। সেদিন সারাদিন ধরেই ইলশেগুঁড়ি ঝরে চলেছিল। তাই সবাই সাথে করে রেইনকোট নিয়ে এসেছিল। আমরা সবাই রেইনকোট পরে নিয়েছিলাম। এরপর জাহাজ চলতে শুরু করলো।

অস্ট্রেলিয়ায় পাল তোলা জাহাজে ভেসে বেড়ানোডাইফেন জাহাজের ক্যাপ্টেনের কামরা

ক্যাপ্টেন জাহাজের ছইয়ের উপর দাঁড়িয়ে ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। আর সময়ে সময়ে হাল ধরে থাকা নাবিককে দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। তখন আমরা খেয়াল করলাম ছইয়ের নিচে একজন মানুষ ক্যাপ্টেনের কথার প্রতিশব্দ করে জানাচ্ছেন নির্দেশ পালন করা হয়েছে। আমরা তখন নিচে নেমে এসে হাল ধরা নাবিকের সাথে পরিচিত হলাম। টেরি নামের মাঝ বয়স পার করা একজন হাসিখুশি মানুষ। আমাদের দেখেই বলল, তোমরা কি হাল ধরতে চাও।

আমরা সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। পালা করে আমি আর মেয়ে হাল ধরলাম। তার পেছনে একটা কামরা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি। টেরি বলল, এটা ক্যাপ্টনের কামরা, তোমরা চাইলে ভেতরে যেতে পারো। আমরা ভেতরে ঢুকে দেখলাম একেবারে সেই আদিকালের মতো করে কামরাটা সাজানো।

অস্ট্রেলিয়ায় পাল তোলা জাহাজে ভেসে বেড়ানোডাইফেন জাহাজের শুকনা খাবার

এরপর আমরা আবার ছইয়ের উপর চলে এলাম কারণ এখান থেকে চারিদিকটা ভালোমতো দেখা যাচ্ছে। কথায় কথায় ক্যাপ্টেনকে জানালাম, আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমি ছোটবেলায় পালতোলা নৌকা দেখেছি বলেই গুগুল করে আমাদের পালতোলা নৌকার ছবি দেখিয়ে দিলাম। সেটা দেখে ক্যাপ্টেন অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বললো, সি ইজ গর্জিয়াস। এরপর বললাম তোমাকে আরো একটা জিনিস দেখায়।

যখন স্রোতের বিপরীত দিকে যেতে হতো তখন আমরা গুণ টেনে নৌকা এগিয়ে নিতাম বলেই আবারো গুগুল করে গুণটানা নৌকার ছবি দেখিয়ে দিলাম। বললাম এই দড়িগুলোর এক প্রান্ত নৌকার মাথায় আটকানো আর অন্য প্রান্ত এই মানুষগুলোর ঘাড়ে ধরা লাঠির সাথে আটকানো। দেখে সে খুবই অবাক হলো এবং বলল আমি অবশ্যই বাংলাদেশের নৌকা নিয়ে খোঁজ খবর নেব।

জাহাজ চলতে থাকলো। একটা জায়গায় যেয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হলো।

অস্ট্রেলিয়ায় পাল তোলা জাহাজে ভেসে বেড়ানোডাইফেন জাহাজের হাল ধরে আছেন নাবিক টেরি

এরপর পালতলার জোগাড় শুরু করা হলো। যাত্রীদের মধ্যে যারা সাহায্য করতে আগ্রহী তাদেরকে আহবান করা হলো। আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। একজন নাবিক সুরে সুরে বলেবেন, ফোর সিক্স আর আমাদেরকে বলতে হবে হিভস। আর সাথে সাথেই দড়ি ধরে টান দিতে হবে। এভাবেই নামিয়ে রাখা পাল জাহাজের মাস্তুল বেয়ে একসময় উপরে উঠে গেল। তারপর সেটাকে সেখানে ভালোমত বেঁধে দেয়া হল।

এরপর দুজন নাবিক দুদিক থেকে উঠে পালের বাঁধন খুলে পাল তুলে দিলেন। কিন্তু বাতাস তেমন না থাকায় পাল উড়ছিল না। তখন ক্যাপ্টেন বলল, আজকে বাতাস না থাকায় পাল উড়ছে না তবে এটার একটা ভালো দিকও আছে। সেটা হলো আমরা ঠিক সেই আদিকালের মতো জাহাজে যাত্রার অনিশ্চয়তার বিষয়টা বুঝতে পারছি।

অস্ট্রেলিয়ায় পাল তোলা জাহাজে ভেসে বেড়ানোনাবিক মারিয়া বুঝিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে লাইফ জ্যাকেট পরতে হয়

জাহাজ চলতে থাকলো ধীর গতিতে। এরমধ্যে আমাদেরকে খাবার দিয়ে দেয়া হলো। একেবারে জাহাজের খাবার। সেখানে সবই প্রায় শুকনা খাবার। আমরা যতটুকু পারলাম খেয়ে বাকিটা বাসার জন্য রেখে দিলাম। এরপর কামান দাগার প্রস্তুতি চলতে থাকলো। প্রথমে কামানে একটা লাঠি দিয়ে ঠেলে ঠেলে কার্তুজ ঢোকানো হলো।

এরপর হেনরি নামের একজন হাসিখুশি নাবিক সেখানে আগুন দেয়ার জন্য দড়ির মাথায় আগুন নিয়ে আসলো। আগুন দেয়ার আগে সাবধান করে দেয়া হলো যে জোরে শব্দ হবে তাই দুই হাত দিয়ে কান ঢেকে রাখায় বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এটা শুনে আমি দুই কানে টিস্যু গুঁজে দিলাম কারণ আমি কামান দাগার ছবি তুলবো। কামান দাগা হয়ে গেলে আমরা ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু করলাম। ক্যাপ্টেন সময়ে সময়ে বলছিলেন আমাদের জাহাজের গতিবেগ কত।

অস্ট্রেলিয়ায় পাল তোলা জাহাজে ভেসে বেড়ানোডাইফেন জাহাজের ক্যাপ্টেন ব্র্যান্ডিন

এরপর পাল নামানোর সময় আমরা আবার হাত লাগালাম। পাল নামিয়ে আমরা ধীরে ধীরে জাদুঘরের জেটিতে এসে নোঙর করলাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। ক্যাপ্টেন ছইয়ের উপর থেকে নেমে আসলেন। আমাদের সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন উনাদেরকে জাহাজটা চালানোর সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

অস্ট্রেলিয়ায় পাল তোলা জাহাজে ভেসে বেড়ানোনোঙর করে আছে ডাইফেন জাহাজ

উনি বললেন, তোমরা এসেছো বলেই আমরা জাহাজটা নিয়ে বের হতে পেরেছি। আর এই নাবিক হিসাবে আমরা এক কাজটাই সবচেয়ে ভালো পারি এবং করতেও পছন্দ করি। আশাকরি এই ভ্রমণ তোমাদের ভালো লেগেছে এবং তোমাদের কিছু সুন্দর স্মৃতি তৈরি হয়েছে। আমি নতুন নতুন নৌকা এবং জাহাজ সম্মন্ধে জানতে ভালোবাসি। আমি আজকে বাংলাদেশের জাহাজ সম্মন্ধে জেনেছি। তিনি আবারও ধন্যবাদ দিয়ে বললেন তোমরা চাইলে তোমাদের বন্ধু বান্ধবদের আমাদের সম্মন্ধে বলতে পারো। আর কোন সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি বা ভিডিও দিলে অবশ্যই আমাদের জাহাজটাকে ট্যাগ করতে ভুলো না।

অস্ট্রেলিয়ায় পাল তোলা জাহাজে ভেসে বেড়ানোসিডনি হারবারে ভেসে চলেছে অস্ট্রেলিয়ায় আসা প্রথম জাহাজ

আমার মেয়েটা পুরো সময়টা বেশি কথা বলেনি। শুরুতে কিছুটা বিরক্তই ছিল বৃষ্টির দিনে এমন একটা ভ্রমণে আসার জন্য। কিন্তু যখন আমরা জাহাজ থেকে নেমে বাড়ির পথ ধরেছি তখন সে বলল, বাবা তোমাকে ধন্যবাদ আমাকে এমন চমৎকার একটা ভ্রমণে সঙ্গে আনার জন্য।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com