মেয়ে, মেয়েজামাই ও ছেলে অস্ট্রেলিয়ার ডারউইনে বসবাস করে। সেই সুবাদে আমাদের অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ। ২০২৪ সালের জুনের মাঝামাঝিতে আমি এবং বাবলু সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বিমানে চেপে যাত্রা শুরু করলাম। সিঙ্গাপুরে আট ঘণ্টার যাত্রাবিরতি ছিল। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দর এতটাই বিশাল এবং সৌন্দর্যময় যে, এই রূপ দর্শনের জন্য আট ঘণ্টা তেমন বেশি কিছু সময় নয়। আধুনিকতা ও নান্দনিকতার মিশেলে তৈরি চাঙ্গি বিমানবন্দর।
‘বিশ্বসেরা বিমানবন্দর’ এই তকমা বহুবার চাঙ্গির কপালে মুকুট হয়ে শোভা পেয়েছে। একে বিমানবন্দর না বলে বিলাসবহুল আধুনিক কোনো শহর বলাই যায়। কী নেই চাঙ্গি বিমানবন্দরে। পার্ক, বাটারফ্লাই গার্ডেন, সানফ্লাওয়ার গার্ডেন, রেইনফরেস্ট, হেজ মেজ (গোলকধাঁধা), হেরিটেজ জোন, সাততলা উঁচু কৃত্রিম ঝরনা আরও অনেক আনন্দ যাপনের ব্যবস্থা যা বলে শেষ করা যাবে না। আমরা পছন্দের কিছু অংশে ঘুরে বেড়ালাম, লাউঞ্জে খাবার খেলাম। প্লেনের সময় দেখে স্কাই ট্রেনে চেপে নির্দিষ্ট টারমিনালের নির্দিষ্ট গেটে গিয়ে পরবর্তী প্লেনের অপেক্ষায় থাকলাম।
পনেরো জুন ভোর ছয়টায় পৌঁছলাম সিডনিতে। এদিকে মেয়ে, জামাই, ছেলের ফ্লাইটও ডারউইন থেকে একই সময় সিডনির মাটি ছুঁলো। গাড়ি রেন্ট করাই ছিল। আমরা মালপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। বুকিং দেওয়া অরৎনহন চেকইন টাইম দুপুর দুইটা। হাতে তখনও অনেক সময়। আমরা নাশতা খেতে গেলাম রেস্টুরেন্টে। ডিম, রুটি, চিজ, বাটার, অভ্যাকেডো, লেটুসপাতার সমারোহে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর নাশতা করলাম। সঙ্গে ছিল নানান রকম ফলের জুস। এরপর সময় কাটাতে ছুটলাম বন্ডাই বিচে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। নরম সোনালি বালি, স্বচ্ছ নীল জলের ধারে মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাসের বয়ে যাওয়া। উপভোগ করলাম বেশ কিছু সময়। মনের গভীরে অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিখ্যাত ‘অপেরা হাউস’ এবং ‘সিডনি হারবার ব্রিজ’ দেখার। সে কথা ছেলেমেয়েদের বলায় ওরা এমন এক জায়গায় নিয়ে গেল যেখান থেকে অপেরা হাউস ও হারবার ব্রিজ একইসঙ্গে দেখা যায়। নিউ সাউথ ওয়েলসের গভর্নর জেনারেল ল্যাচলান ম্যাককুয়ারির স্ত্রী এলিজাবেথ ম্যাককুয়ারির জন্য ১৮১০ সালে এটি খোদাই করে তৈরি করা হয়েছিল।
আমার স্বপ্ন পূরণ হলেও আরও কাছ থেকে দেখার বাসনা নিয়ে রুমে ফিরলাম। আর তাই সন্ধ্যায় আবারও এলাম ভিভিড শো দেখতে। প্রতি বছর অপেরা হাউস ও হারবার ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় সরকারিভাবে ‘ভিভিড শো’র আয়োজন করা হয়। এই শো দেখতে সিডনি, অস্ট্রেলিয়া এমনকি দেশের বাইরে থেকেও প্রচুর লোকজন আসে। আমরা কিছুটা ক্লান্ত ছিলাম তবু এই সুযোগ হারাতে চাইলাম না। সন্ধ্যায় ঠিকই চলে এলাম তবে গাড়ি পার্ক করার ঝামেলার কথা চিন্তা করে এবার ট্রেনে করে এলাম। আলো ঝলমলে রঙিন আলোর ঝলকানিতে বিমোহিত হলাম। ওদের রঙিন নাচ গান বেশ মজার ছিল। একটা কথা না বললেই নয়, আমরা যে সাত দিন সিডনি ছিলাম প্রতিদিন একবার হলেও অপেরা হাউসে গেছি, কখনো একের বেশিবারও গেছি। বাড়ি ফেরার পথে লাকেম্বার (মিনি বাংলাদেশ) ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্টে বাঙালি খাবার খেয়ে ফিরে এলাম অস্থায়ী নিবাসে। একদিনে অনেক ঘোরাঘুরি হলো। পরেরদিন ঈদ। ষোলো জুন, আজ ঈদ।
বিদেশের মাটিতে ঈদ আমাদের জন্য নতুন নয়। সৌদি আরবে ত্রিশ বছর বসবাসের সুবাদে সেখানে অনেক ঈদ করা হয়েছে। তবে মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ার কারণে তেমন কিছু মনে হয়নি। অস্ট্রেলিয়া বলে একটু চিন্তা ছিল, কিন্তু দেখলাম এখানেও অনেক মসজিদ। তাছাড়া আমাদের সামনে খোলা মাঠেও পরপর তিনবার জামাত হলো। জামাত শেষে সবাই কোলাকুলি করলেন। আমাদের ছেলে সদস্যরা কিছু দূরের ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে গিয়েছিল। আসার সময় অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি এলাকা লাকেম্বার বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের খাবার নিয়ে এলো। তা-ই দিয়ে ঈদের দিন শুরু করলাম। দুপুরে বাবলুর মেডিকেল কলেজের বন্ধু ডা. নূরুল ইসলাম ভাইয়ের বাসায় গেলাম। তারা দুই যুগের বেশি সময় অস্ট্রেলিয়ায় শেকড় গেড়েছেন। সাধারণ সময়েও তাদের বাড়িটিতে বাঙালি আত্মীয় বন্ধু স্বজনে ভরভরন্ত থাকে। ঈদের দিনে সেই কলেবর আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মনে হচ্ছিল যেন আমরা বাংলাদেশেই আছি। লিলি ভাবির আন্তরিক অভ্যর্থনায় মুগ্ধ হলাম। টেবিলের পর টেবিল সাজানো দেশীয় ঝাল মিষ্টি খাবার মন ভরে খেয়ে সন্ধ্যায় সিডনি শহর ঘুরে ঘুরে দেখে বেশ রাতে লেবানিজ খাবারের দোকানের খাবার খেয়ে ফিরে এলাম আমাদের আবাসে। সবশেষে বলাই যায় ভালোই হলো ঈদ যাপন।
পরেরদিন সতেরো জুন আমরা সিডনি থেকে আশি কিলোমিটার দক্ষিণে Wollongong Head Lighthouse-এর উদ্দেশে বের হলাম। পথে Bald hill lookout-এ নামলাম। অস্ট্রেলিয়ায় এ ধরনের আরও অনেক লুকআউট আছে, যাতে ভ্রমণবিলাসীরা একটা লুকআউট থেকে সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখতে পারে। এই লুকআউটগুলোতে বসার জায়গা, খাবার দোকান এবং ওয়াশ রুমের ব্যবস্থা থাকে। খুব সুন্দর নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এটি আকাশ পাহাড় সমুদ্রের অপূর্ব মিলনক্ষেত্র। এই আউটলুক থেকে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত sea cliff bridge দেখা যায়, ব্রিজের ওপর গাড়ির চলাচল দেখলাম। কিছুক্ষণ পরে আমরা ব্রিজের পাশে গাড়ি রেখে হেঁটে ব্রিজের ওপর উঠলাম। এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, মাইগ্রেটিং সিজনে তিমি মাছেদের উত্তর-দক্ষিণে চলাচল দেখার দারুণ একটি প্ল্যাটফর্ম।
তবে এখন মাইগ্রেটিং সিজন না হওয়ায় তিমিদের এই চলাচল দেখা হলো না। অবশেষে পৌঁছালাম Wollongong Head Lighthouse-এ। এটি সিডনি থেকে বেশ উপরে তাই এখানে ঠান্ডা অনেক বেশি, তাছাড়া প্রচণ্ড বাতাসে শীত আরও বেশি অনুভব করছিলাম। এর আগে কাশ্মীরের ভূস্বর্গের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আজ এর রূপে কম মুগ্ধ হইনি। সমুদ্রের কিনারায় পাথরের সৃষ্ট বিশাল গর্তে ঢেউয়ের তোড়ে, স্রোতের টানে প্রাকৃতিকভাবে সমুদ্রের পানি এসে জড়ো হতে থাকে। গর্তে অনেক পরিমাণ পানি জমা হওয়ার পর, একটি ঘূর্ণির মতো তৈরি হয়। এতে এই বিশাল জলরাশি প্রবল তোড়ে গর্তের খোলা মুখ দিয়ে উপরের দিকে বের হয়ে আসে। পানি কয়েকশ ফুট উপর পর্যন্ত উঠে যায়। উঠে আসা পানির বিন্দুগুলো রোদের ছটায় ঝলমল করে ওঠে। তৈরি হয় এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট অপার মহিমা দেখে আমরা বিস্ময়াভিভূত। মাঝে মাঝে পানির সঙ্গে সমুদ্রের মাছও উঠে আসে। শুনেছি ভরা পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্নার আলোয় এক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য তৈরি হয়।
আজ আঠারো জুন নির্দিষ্ট ছিল কেনাকাটার জন্য। ছেলেমেয়েরা আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিল। কোনদিন কোথায় যাব, কী কী করব সেই মতো আমরা চলছি। গেলাম পৃথিবীখ্যাত কয়েকটি শপিং মলে। যেমন ওয়েস্টফিল্ড, কুইন ভিক্টোরিয়া বিল্ডিং এবং সেন্টার পার্ক মল। অল্পকিছু কেনাকাটা করা হলো। আসল কাজ হলো সেই বিশ্ববিখ্যাত শপিং মলে অবস্থিত নামিদামি রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া আর ঘোরাঘুরি।
উনিশ জুন আমরা গেলাম Three Sisters Blue Mountain. তিন বোনের মতো পাহাড় তিনটি গায়ে গায়ে লেগে অবিচল দাঁড়িয়ে আছে। প্রচলিত আছে কাটুম্বা উপজাতির সদস্য তিন বোন মেহনি, উইমলা ও গুনেডু বাস করত জেসমিন উপত্যকায়। এই তিন সুন্দরী যুবতী নেপিয়ান উপজাতির তিন ভাইয়ের প্রেমে পড়েছিল। তবে তিন বোনের বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়াল উপজাতি আইন। তাদের আর বিয়ের পিঁড়িতে বসা হলো না। যেন মেহনি, উইমলা ও গুনেডুর মন খারাপ করা মুখের ছবি দেখতে পেলাম। বিকেল পর্যন্ত থেকে ফিরে এলাম। সন্ধ্যায় ডা. দেওয়ান ভাই এবং লিয়া ভাবি সৌদি আরবে তারা ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী। বর্তমানে তাদের দুই সন্তান সিডনির বাসিন্দা, সেই সুবাদে তারাও। তাদের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে আমরা সারাদিনের সব ক্লান্তি ভুলে ঠিক সন্ধ্যারাতেই হাজির হয়ে গেলাম ‘নবাব রেস্টুরেন্টে’। দেশি খাবার কাচ্চি, ফুচকা, মোগলাই, নানা ধরনের দই মিষ্টি এবং পিঠা খেলাম। আমাদের দুই পরিবারের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে, খেলার সাথী ছিল তারা। অনেক দিন পর দুই পরিবারের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুব আনন্দের ছিল।
বিশ জুন, আজকের দিনটা আমার কাছে খুব স্পেশাল ছিল। জগদ্বিখ্যাত সেই অপেরা হাউস আর হারবার ব্রিজ খুব কাছ থেকে মনপ্রাণ ভরে দেখলাম। দারুণ একটা অনুভূতি হলো। সিডনি থেকে ‘ম্যানলি বিচ’ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সার্ফিংয়ের জন্মস্থান বলা যায়, আমরা সড়কপথে ম্যানলি বিচ যেতে পারতাম। তবে জলপথে ফেরি বোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ সিডনি থেকে ম্যানলি বিচ ফেরি বোটের রুটটা এমনভাবে করা হয়েছে যেন দর্শনার্থীরা অপেরা হাউস ও হারবার ব্রিজকে বিভিন্ন দিক থেকে, বিভিন্ন দূরত্ব থেকে, বিভিন্ন অবস্থান থেকে পরিপূর্ণভাবে দেখতে পারে। আমরাও পরিপূর্ণরূপে দেখলাম অপেরা হাউস ও হারবার ব্রিজ। ফেরি বোটে ঝলমলে দিনে প্রখর সূর্যালোকে ম্যানলি বিচে গেলাম। চলন্ত বোটে বসে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখছি সাথে কমলা গোলাপি আকাশ, নিচে নীল জলের সন্তরণ। এক মোহনীয় দৃশ্য! এই রূপ বর্ণনাতীত!
একুশে জুন গেলাম টারঙ্গা চিড়িয়াখানায় কিন্তু আমরা যখন পৌঁছলাম তখন কোয়ালা গভীর নিদ্রায় মগ্ন। শুনেছি, কোয়ালা নাকি দিনের আঠারো ঘণ্টাই ঘুমিয়ে কাটায়। বিরাট এলাকাজুড়ে বিশাল চিড়িয়াখানা। নানা জাতের ক্যাঙ্গারু দেখলাম, যা কি না অস্ট্রেলিয়ার প্রতীক। দেখলাম ট্রেনিংপ্রাপ্ত সীল মাছের বুদ্ধিদীপ্ত নানান রকম খেলাধুলা ও কসরত। আগামীকাল সকালের ফ্লাইটে চলে যাব ডারউইন। ছেলেমেয়েদের কাজের জায়গা, ওদের থাকার জায়গা। সিডনিতে বেড়ানোর আজ শেষদিন।
Like this:
Like Loading...