অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলা। মৌলভীবাজার জেলার সর্বাধিক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে এই কমলগঞ্জ উপজেলায়। পর্যটন ক্ষেত্রের অপার সম্ভাবনাময় এই উপজেলায় ২০টিরও বেশি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে।
জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, পদ্মকন্যা নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, হামহাম জলপ্রপাত, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাহক বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য রাজকান্দি বন, শমসেরনগর বিমানবন্দর, প্রাচীন ঐতিহ্যের বাহক লক্ষ্মীনারায়ণ দিঘী, ২শ বছরের প্রাচীন ছয়চিড়ী দিঘী, শমসেরনগর বাগীছড়া লেক, আলীনগর পদ্মলেক, মাগুরছড়া পরিত্যক্ত গ্যাস-ফিল্ড, অপরূপ শোভামণ্ডিত উঁচু নিচু পাহাড় বেষ্টিত সারিবদ্ধ চা বাগানসহ বাংলাদেশের বৃহৎ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মণিপুরি সম্প্রদায়ের নিরাপদ আবাসস্থল এ উপজেলায়। এছাড়া খাসিয়া নৃ-গোষ্ঠীসহ গারো, সাঁওতাল, মুসলিম মণিপুরি, টিপরা ও গারোদের নিরাপদ আবাসস্থলও রয়েছে এই উপজেলায়।
এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একটি উদ্যান। দেশের ৭টি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য এবং ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অন্যতম। পরিচিতির দিক থেকে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়ার অবস্থান। এটি এখন বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও পাখির জীবন্ত গবেষণাগার। বিজ্ঞানীদের ভীষণ পছন্দের জায়গা। বিখ্যাত পাখিবিশারদ ডেভিড জনসন ও পল থমসন লাউয়াছড়াকে পৃথিবীর অন্যতম উন্মুক্ত চিড়িয়াখানা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সূর্যের আলো পেতে মরিয়া এ বনের গাছপালা বেশ উঁচু হয়ে থাকে। একটা সময় এই বন এতই ঘন ছিল যে মাটিতে সূর্যের আলো পড়ত না। উঁচু-নিচু টিলাজুড়ে এ বন বিস্তৃত। বনের ভেতর দিয়ে অনেক পাহাড়ি ছড়া বয়ে গেছে, যা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এই বন বিখ্যাত। বনের মধ্যে কিছু সময় কাটালেই উল্লুকের ডাকাডাকি কানে আসবে।
শীত ও বসন্তকালে বেশি লোকসমাগম হয় এই উদ্যানে। এখানে ভ্রমণের জন্য রয়েছে তিনটি ট্রেইল বা হাঁটাপথ। তিনটি পথের মধ্যে একটি ৩ ঘণ্টার, একটি ১ ঘণ্টার এবং অন্যটি ৩০ মিনিটের পথ। গাইডের সহায়তায় বনের ভেতরে যাওয়া যায়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশেই রয়েছে মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি।
মাধবপুর লেকটি চারদিকে উঁচু সবুজ চা-বাগানের মাঝখানে অবস্থিত। স্বচ্ছ পানি, প্রকৃতির ছায়া, নিরিবিলি পরিবেশ আর শরতে শাপলা ফুল লেকটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলে। সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় যতই এগোতে থাকবেন, ততই সবুজ পাতার গন্ধ মন চাঙা করে তুলবে। চারদিকে সবুজ পাহাড়ের পাশাপাশি উঁচু উঁচু টিলা রয়েছে এখানে। মাধবপুর লেক যেন প্রকৃতির নিজ হাতে আঁকা ছবি।
কমলগঞ্জ উপজেলার হাম হাম জলপ্রপাত আরেকটি দর্শনীয় স্থান। দুর্গম জঙ্গলে ঘেরা এই জলপ্রপাত ২০১০ সালের শেষ দিকে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মার সঙ্গে একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে ইসলামপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাজাকান্দি রেঞ্জ। এ রেঞ্জের ৭ হাজার ৯৭০ একর আয়তনের কুরমা বন বিট এলাকার পশ্চিম দিকে চম্পারায় চা-বাগান। এই কুরমা বন বিটের প্রায় ৮ কিলোমিটার ভেতরে দৃষ্টিনন্দন হাম হাম জলপ্রপাতটি অবস্থিত।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতি কমপ্লেক্স:
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই চা-বাগানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ধলই বর্ডার আউটপোস্টে গিয়ে যুদ্ধ করেন। তিনি ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিলেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে হামিদুর রহমান প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের সি কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন। যুদ্ধে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মরণে ধলই চা-বাগানে স্মৃতি কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়। স্মৃতিসৌধের একদিকে বিজিবি ক্যাম্প, অন্যদিকে চা-বাগান। দক্ষিণে ভারত সীমান্ত।
ভানুবিল মাঝেরগাঁও মণিপুরি কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজমঃ
২০১৮ সালের ৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে নিরঞ্জন সিংহের বাড়ি থেকেই শুরু হয় ‘সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন’। বলা যায় তিনিই উদ্যোক্তা।এখানে প্রতিটি ঘরের একটা অংশ পর্যটকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো বাড়ির দুটি, কোনো বাড়িতে চারটি কক্ষেই পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে তাঁত আছে। আছে নিজেদের ঐতিহ্য প্রদর্শনের তাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়ে গড়ে ওঠা একটি বিশালাকার বিমানবন্দর রয়েছে শমশেরনগরে। বর্তমানে এখানে রিক্রুট ট্রেনিং স্কুল করায় প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত হলেও এ এলাকা সংলগ্ন স্থানেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি বধ্যভূমি।
দৃষ্টিনন্দন ক্যামেলিয়া লেকঃ
চারদিকে সারি সারি চা বাগান আর ছোট-বড় পাহাড়ি টিলা। ওপরে নীল আকাশ। সব সময়ই আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি (স্থানীয়দের ভাষায় অতিথি পাখি)। এরই মাঝে অবস্থিত এক দৃষ্টিনন্দন লেক। চা বাগানের শ্রমিকদের কাছে এ লেকটি ‘বিসলার বান’ বা ‘ক্যামেলিয়া বাঁধ’ নামে পরিচিত। তবে এর প্রকৃত নাম ‘ক্যামেলিয়া লেক’। দৃষ্টিনন্দন এ লেকটির অবস্থান কমলগঞ্জ উপজেলার ‘ডানকান ব্রাদার্স টি এস্টেট’র শমসেরনগর চা বাগানে।
চা বাগানগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য প্রায় সব বাগানেই ছোট-বড় লেক দেখতে পাওয়া যায়। এসব বাগানের লেকগুলো সাধারণত চা বাগানের নিচু জমিতে বা পাহাড়ি টিলার পাদদেশে হয়ে থাকে। কিন্তু ক্যামেলিয়া লেকের বৈশিষ্ট্য হলো, এটি বাগানের প্রায় শেষ প্রান্তে টিলার উপরাংশজুড়ে অবস্থিত।‘বিসলার বান’ বা ‘ক্যামেলিয়া লেক’টি পর্যটকদের স্বর্গোদ্যান হিসেবে দেশে-বিদেশে সুপরিচিত।
কমলগঞ্জের অপরূপা এই লেকটি এখন বিনোদনের অন্যতম স্থান। বছরের যে কোনো মৌসুমেই পর্যটকরা ভ্রমণ করতে পারেন পদ্মছড়া লেকে। তবে এখনো দেশের অনেকের কাছেই অচেনা-অজানা এই ‘পদ্মছড়া লেকটি’। কৃত্রিম এ লেকটি পাহাড়ের বুক চিড়ে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে মানুষের মাঝে প্রকৃতির সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে।এখানে এলে দেখা যায় সবুজের সমারোহ, সবুজ পাতার গন্ধ। পলকেই আপনার মনকে চাঙ্গা করে তুলবে এই প্রকৃতি। আপনি বিমোহিত হয়ে মিলিয়ে যাবেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে।
সানামাহি ধর্মের অনুসারী ৪ টি পরিবার ও মিউজিয়াম:
সানামাহি ধর্মের অনুসারীরা মনিপুরী হলেও হিন্দু কিংবা মনিপুরী রীতিনীতি পালন করে না,, ৬/৭ শত বছর আগের তিব্বত ও চিনের রাজার অনুসারী)। এই ধর্মের জানামতে আর কেউ এদেশে নাই। ( তথ্য সংগ্রহকারী আহাদ মিয়া)
কমলগঞ্জ মৎ শিল্পী / কুমার সম্প্রদায় (এক সময় প্রচুর মৎ শিল্পীরা মাটির হাড়ি পাতিল তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো, কালের বিবর্তনে বর্তমানে অনেকটা হাড়িয়ে যাচ্ছে, এছাড়াও অতিথি পাখির অভয়াশ্রম পাত্রখোলা লেক, লাউয়াছড়া স্টুডেন্ট ডরমিটরি লেকসহ পর্যটণে সম্ভাবনাময় অনেক স্থান রয়েছে কমলগঞ্জ উপজেলায়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল, সেখান থেকে বাসে কমলগঞ্জ। রেলপথে ঢাকা থেকে ভানুগাছ কিংবা শমসেরনগরে নেমে বাস অথবা অটো-রিকশায় কমলগঞ্জ যাওয়া যায়।
Like this:
Like Loading...