ল্যান্ড করার আগে দিয়ে আকাশ থেকেই দেখা যায় অসংখ্য অগণিত নারিকেল গাছে ঘেরা এক দ্বীপ।এতো সবুজ চারিদিকে, প্রকৃতি যেন তার সবটুকু সবুজ রঙ ঢেলে দিয়েছে অকৃপণ হাতে। কলোম্বো এয়ারপোর্টে আমাদের জন্য দুটি মজার ঘটনা অপেক্ষা করছিল। তার একটা হল নিলাঙ্গন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বেগুনী অর্কিডের মালা হাতে নিয়ে।দারুণ অভ্যর্থনা ! ওদের প্রথা এটা, নির্ধারিত গাইডরা নেমপ্লেট এর সাথে ফুলের মালা হাতে অপেক্ষা করে।অন্যটা আরও সুখের, সিম নেওয়ার সময় ১০০ ডলার ভেঙ্গে ১৫ হাজার রুপি পেলাম যা প্রায় দ্বিগুণ আমাদের দেশের তুলনায়। পথে একটা স্টলে চা বিরতি এবং পথের জন্য সতেজ রামবুটান কিনে নিলাঙ্গনের গাড়িতে ক্যান্ডির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমরা।
কালচারাল সিটি হিসেবে ক্যান্ডি বিখ্যাত । জেম জুয়েলারি এবং উড ক্রাফটিং এর জন্য খ্যাতি আছে। আর আছে ‘টেম্পল অব দ্যা টুথ রিলিক’ যেখানে গৌতম বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষিত আছে।ক্যান্ডির এই টেম্পলটি অত্যন্ত পবিত্র ও জগৎবিখ্যাত একটি বৌদ্ধ মন্দির। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের নির্বান লাভের পর উনার একপাটি দাঁত ভারতের কলিঙ্গ রাজ্যের একটি বৌদ্ধ বিহারে পরম যত্নে সংরক্ষিত ছিল। এটি বিবেচিত হয় পবিত্র পুণ্যবস্তু ও শান্তির আধার হিসেবে। সমকালীন সময়ে শ্রীলংকার অনুরাধাপুরে বৌদ্ধ রাজার রাজত্ব চলছিল। প্রিন্সেস হেমামাল ও তার স্বামী প্রিন্স দান্তা।
রাজা গুয়াসিভার নির্দেশে মেয়ে ও জামাতা এই পবিত্র দন্তরাজি কলিঙ্গ থেকে শ্রীলংকায় নিয়ে আসার কার্য্যে নিয়োজিত হন। বুঝা যায় বৈধতার প্রশ্নে সম্ভববত: কিছুটা জটিলতা ছিল। দন্ত আনার কার্য্যে যারা নিয়োজিত হয়েছিলেন তারা দীর্ঘদিন চেষ্টার পর সফলতা লাভ করেন। ৩০১ থেকে ৩০৮ খৃ: এর মধ্যে কোন এক সময়ে দন্ত পাটি নিয়ে শ্রীলংকায় ফিরে আসতে সমর্থ হন এবং যথা নিয়মে অনুরাধাপুরের রাজার কাছে হস্তান্তর করেন।কথিত আছে রাজকুমারী তার চুলের খোঁপার মধ্যে লুকিয়ে এনেছিলেন এই দন্ত রাজি। পরবর্তীকালে, এটিকে কেন্দ্র করেই মন্দির নির্মাণ করা হয়।টেম্পল এ প্রবেশ টিকেটের জন্য বেশ ভালো পরিমান অর্থ গুনতে হয় তবে সার্কভুক্ত দেশের জন্য কিছু সুবিধা আছে। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আলাউড না। পূজারীরা সবাই সাদা পোষাকে যায়, সেই সাথে অগণিত পদ্মের শুভ্রতায় অনন্য এক পবিত্রতা সেখানে।
পাহাড়ি শহর ক্যান্ডির ঠিক মাঝখানে দারুণ এক লেক, হোটেলগুলো পাহাড়ের গায়ে গায়ে।শ্রীলংকায় আমাদের প্রতিটি হোটেলই ছিল নান্দনিক, তবে স্পেশালিটি হল ওরা অভ্যর্থনা জানায় আদা চা দিয়ে, চায়ের সাথে পিরিচে একটুকরো গুঁড় থাকে।অভ্যর্থনায় একটুকরো গুড় সব হোটেলেই পেয়েছি। রিসিপসন থেকে কর্তব্যরত কোন তরুণী গিয়ে রুম পর্যন্ত দিয়ে আসে। লাগেজ বহনকারী বেয়ারার সাথে ছেড়ে দেয় না। ‘সামুদ্রিকা’ নামে এক মিষ্টি মেয়ে আমাদেরকে রুমে পৌঁছে দিয়ে গেল। শাড়ি ওদের ফর্মাল পোশাক। শাড়ি পড়ার ধরনটা আমাদের থেকে একটু আলাদা এবং অবশ্যই মনোরম।
আমরা বিকেলে ক্যান্ডি পৌঁছেই একটা কালচারাল শো দেখি। খুব বিখ্যাত সেই শো, ড্রাগন নৃত্য, ঘরে ফসল তোলা, বিভিন্ন মনোরম নাচের অনুষ্ঠান, সেই সাথে ফায়ার ড্যান্স।শো এর দর্শক সবাই বিভিন্ন দেশের টুরিস্ট। পরদিন সকালে ক্যান্ডির স্মৃতি হিসেবে একটা রুবী কিনে দেয় মিঠু, আমার ভ্রমণ সঙ্গী এবং জীবন সঙ্গী। জুয়েলারি শপের মালকিন সান্ধ্যারেনু। রত্নের দোকানে যাবার পর গরম চায়ের সাথে ২০ মিনিটের একটা ভিডিও দেখায় ওরা,কীভাবে জেম তোলা হয় মাটির নিচ থেকে , কীভাবে সেপ দেওয়া হয়। আসবার সময় ছোট্ট একটা জিরকন উপহার পেলাম রেনুর কাছ থেকে, নাকফুল বানাবার জন্য।
পথেই দুপুরের খাবার। খাবার হোটেলগুলো খুব সাধারণ, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। প্রত্যেক হোটেলেই কর্মচারীরা কেউ না কেউ ইংরেজি জানে।ছোট ছোট হোটেল কিন্তু বুফে সিস্টেম । একটা মজার ব্যাপার দেখলাম, ওখানে বসে খেলে ২০০ রুপি , প্রতিটা সসপ্যান থেকে নিজেই তুলে নেওয়া যাবে। টেক ওয়ে ১৫০ রুপি সেক্ষেত্রে্ ওরা প্যাক করে দেবে। খাবার হোটেলে ভিড় কম, বেশীর ভাগ মানুষ টেক ওয়ে নেয়, গাড়িতে বসে খায়। খাবার আমাদের মতই, লাল শাক, ঢ্যাঁড়স ভাজা, সব চেয়ে অবাক হয়েছিলাম কাঁচা কাঁঠালের তরকারী দেখে, সেই সাথে আমড়ার টক । এয়ার টাইট স্বচ্ছ প্ল্যাস্টিকের বড় বয়মে রাখা আছে পাঁপড়, ইচ্ছে হলে বয়মের মুখ খুলে নেওয়া যাবে পাঁপড় ,ভাতের সাথে।কিছু আইটেম নারকেল তেলে রান্না করা, দুই রকম তেলেই রান্না করে ওরা। খাবার বেশ সুস্বাদু।
ক্যান্ডি থেকে নুয়ারা এলিয়া বেশ উঁচুতে, যত উপরে উঠছি ততই ঠাণ্ডা। চা বাগান এর মধ্যে দিয়ে পথ, বর্ণনাতীত সুন্দর, অনেকটা শিমলা মানালির মত। মেঘ এসে পথ আগলে ধরছে মাঝে মাঝেই।পথে অসংখ্য ঝর্ণা। পাহাড়ি পথের পাশে লাল হলুদ কলাবতী, ধুতুরা ফুলের গাছ এবং তাতে পরিচর্যার ছাপ স্পষ্ট। একটা চা বাগানে এসে বিরতি নিলাম আমরা। সেখানে একের পর এক টুরিস্ট গাড়ি এসে থামছে। অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরা সেখানে পার্টটাইম গাইডের কাজ করে। আমাদেরকে স্বাগত জানালো এক তরুণী। সুন্দর ইংরেজিতে আমাদেরকে চা উৎপাদনের সবগুলো ধাপ দেখালো, কাঁচা পাতা থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত। সেখানে একটা ছোট্ট ক্যান্টিন আছে, গাইড মেয়েটা আমাদেরকে তাদের নিজস্ব চা আপ্যায়ন করল।তাদের চা বিক্রয় কেন্দ্র থেকে কেনা যায় বিভিন্ন ফ্লেভারের প্যাকেটজাত চা । ব্যাগ ভর্তি চা কিনলাম বন্ধুদের জন্য।একটা কথা বলে রাখি শ্রীলংকার চা কিন্তু পৃথিবী বিখ্যাত। সিলন টি নামটা সবার পরিচিত, আর ‘সিলন’ হল শ্রীলংকার আদি নাম।
শ্রীলংকার তাপমাত্রা আমাদের দেশের মতই। কিন্তু নুয়ারা এলিয়ায় যে এতো ঠাণ্ডা হবে ধারণা ছিল না। ৪ টা জায়গায় থাকার প্ল্যান আমাদের, ক্যান্ডি, নুয়ারা এলিয়া, গল এবং কলম্বো। সব জায়গায় আবহাওয়া মোটামুটি একই রকম, শুধু নুয়ারা এলিয়ায় বিপরীত। সেখানে সারা বছর একটাই ঋতু, শীত কাল ! এজন্য হানিমুন কাপলদের ভিড় সেখানে সবসময়। শেষ বিকেলে যখন পাহাড়ের উপরে শহরটাতে গিয়ে পৌঁছালাম, সন্ধ্যা হতে তখনও সামান্য দেরী। ঠাণ্ডা বাতাস, সাথে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি । শহরের মাঝখানে বয়ে চলেছে গ্রেগরি লেক। পাহাড়ের উপরে এতো বড় একটা লেক, ভাবাই যায় না ! গাড়ি থেকে নামতেই শীতের অভ্যর্থনা , এদিকে জুন মাস, আমরা গেছি ঢাকা এবং মালদ্বীপের প্রচণ্ড গরমের আঁচ সাথে নিয়ে। আমার গায়ে পাতলা সিল্কের একটা টপ। ঠাণ্ডায় হিম হয়ে আছি। গাড়িতে অবশ্য একটা ওড়না আছে । নিলাঙ্গনকে বললে গাড়ি থেকে নিয়ে আসবে কিন্তু ওড়নার ইংরেজিটা ঠিক জানি না, ইন্ডিয়া ট্যুরে খুব সুবিধা, দোপাট্টা বলে কাজ চালানো যেত। ওকে বললাম,’ চল আমার সাথে, গাড়ির ডোরটা খুলে দেবে, আমার একটা জিনিস নিতে হবে।’ এতোটা পথ ড্রাইভ করে এসে সেও একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। আমার কথায় আবার রওনা দিল গাড়ির দিকে। যাবার সময় দেখি রাস্তায় কী যেন একটা খাবার বিক্রি হচ্ছে , অনেকটা আমাদের দেশের ১২ ভাজার মত।
ওড়না নিয়ে এসে আগের জায়গায় দাঁড়ালাম মিঠুর অপেক্ষায়। রেশমি ওড়নার কতটুকুই বা ক্ষমতা শীত ঠেকানোর। তবুও কান মাথা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার ধারে। পাহাড়ি ছোট্ট বাজার। আমার হাসবেন্ড মানি এক্সচেঞ্জ করতে গেছে। চারিদিকে মানুষের আনাগোনা। বেশিরভাগই তামিল । শ্রীলংকান জনগনকে ছবিতে যতটা কালো লাগে , আসলে তেমন কিন্তু না, আমাদের মতই গায়ের রঙ ওদের, তবে তামিলরা কালো, বেশ কালো । রাস্তার ধারে ওদের লোকাল মদের দোকান। বাজার করে যাবার সময় লোকজন মদের বোতল কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যেমন কোক বা সোয়াবিন তেলের বোতল হাতে করে নিয়ে যাই, ঠিক তেমন। সবার গায়ে শীতের পোশাক শুধু আমাদের গায়ে নেই। কনকনে হাওয়া এসে বার বার সূক্ষ্ম ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে … চা খাওয়া দরকার। গরম ধোঁয়া ওঠা চা, সাথে ঐ বারো ভাজা।
মিঠু ফিরে এলে একটা রেস্টুরেন্ট এ বসলাম আমরা, আমাদের দেশের মতই। টেবিল চেয়ার, দেয়ালে মেন্যু চার্ট। ঢোকার মুখেই কাঁচের একটা ব্যারিকেট। তারমধ্যে একজন দক্ষ হাতে পাতলা রুটি কেটে চলেছে।আমাদের দেশে যেমন মাংসের কিমা কাটে। কাঠের টেবিলে অনবরত দুই চাপাতির শব্দে মোটামুটি কান পাতা দায়। এতো শব্দ ! কি করছে এমন করে ? নিলাঙ্গনের কাছে জানতে চাইলাম। সে জানাল এর নাম Kottu Roti , তামিলদের খুব জনপ্রিয় খাবার।বলা হল ৩ প্লেট দিতে। এবার আমাদের জন্য রুটি কুটতে শুরু করেছে, আবারও খট খট খট…ওয়াও এ যেন এক মিউজিক্যাল ক্যাফে । কিছুক্ষণ পর হাজির কোটু রুটি। পরিমানে এতো বেশী ! নিলাঙ্গন হেসে জানায়, তামিলরা খুব পরিশ্রমী, সারাদিন খেটে ঘরে ফেরার সময় এক প্লেট কোটু রুটি খেয়ে বাড়ি যায়, রাতে আর খেতে হয় না। ছোট ছোট কুটি করা রুটির সাথে ডিম পেঁয়াজ মশলার অপূর্ব সমন্বয়ে এই নতুন খাবার … সাথে ঘন দুধের চা। সন্ধ্যা নেমেছে ততক্ষণে … খুব ছোট্ট একটা হোটেলের সস্তা কাঠের টেবিল চেয়ারে বসে , খেটে খাওয়া মানুষদের সাথে আমরাও খাচ্ছি কোটু রুটি । খুব সাধারণ একটা স্মৃতি, কখনো কখনো অতি সাধারণ বিষয়গুলোও পাকাপোক্ত শেকড় ছড়ায় মনের মাঝে।
নুয়ারা এলিয়ায় দিনে তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রী , রাতে ৯ ডিগ্রীতে নামে , এদিকে একটাও শীতের কাপড় নেই সাথে। এই কথা মনে হলেই শীত যেন আরও বেশী জাঁকিয়ে বসছে। নিলাঙ্গন আশ্বস্ত করেছে নেমেই সে আমাদেরকে নিয়ে যাবে হট ওয়েল ম্যাসাজ নিতে। আয়ুর্বেদিক জড়িবুটির বাস্পে শ্রীলংকান এই ম্যাসাজ এর সুনাম বিশ্বব্যাপী।গরম তেল আর জড়িবুটির ভাপে কাজ হল , সেই সাথে রুম হিটার , ভালোই কাটল রাত।পর দিন সকালে সীতা এলিয়া, অশোক বন, যেখানে রাবন, সীতাকে বন্দী করে রেখেছিল। একপাশে বড় বড় গাছের জঙ্গল। পাহাড়ের বুক চিরে নেমে এসেছে ঝর্ণা , এখানেই নাকি সীতাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সেই স্মৃতিকে স্মরণ করে গড়ে উঠেছে টেম্পল। ঝর্ণার উপর দিয়ে একটা ছোট্ট সেতু। হাঁটতে হাঁটতে সেতু পেরিয়ে ওপারে গেলাম, যেখানে সীতার মূর্তি গড়া। সীতার সাথে হনুমান এবং হরিণ।বয়ে চলা ঝর্ণার পাশে পাথরের গায়ে একটা গর্তে সবাই পয়সা ছোঁড়ে ইচ্ছা পূরণের জন্য। আমার কাছে শ্রীলংকান কোন কয়েন ছিলনা। আমি আমার দেশের শাপলা দেওয়া কয়েন ফেললাম গর্তে ,ফিস ফিস করে বললাম – যা কিছু শুভ , তাই হোক সবার জন্য।
এরপর গন্তব্য গল সিটি । ৪০০ বছরের পুরাতন সিটি ‘গল’ যেখানে সুলতান সুলেমানের বানিজ্য তরী ভিড়েছিল এক সময়।এখানে দুর্গ গড়ে শাসন করে গেছে ডাচ, ওলন্দাজ, ইংরেজরা । সুনামিতে গল এর পুরো এরিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই দুর্গ ছিল অক্ষত, এর অসাধারণ নির্মাণ দক্ষতার কারণে। গল এর বিখ্যাত স্টেডিয়ামও এই দুর্গের প্রাচীর ঘেঁষে।গল এর হোটেলটা ছিল অসাধারণ । রুমের সাথে প্রাইভেট সুইমিং পুল। ছাদে খোলা জায়গায় ডাইনিং। ‘গল’ এর নতুন অভিজ্ঞতা ছিল পাহাড়ি খরস্রোতা কালিনী নদীতে জীবনের প্রথম ওয়াটার র্যাফটিং ! সাথে আমাদের সহযোগী শঙ্কর এবং সম্পদ নামের দুই তরুণ। ওদের নির্দেশনায় খুব সহজ হয়ে যায় সবকিছু। পরবর্তীতে আরও ওয়াটার র্যাফটিং করেছি অন্য জায়গায় কিন্তু শ্রীলংকার র্যাফটিং মনে রাখার মত । যখন স্রোতের তোরে বোট ভেসে যায় তখনই অ্যাডভেঞ্চার । পাহাড়ি নদীর খরস্রোতে কলার মোচার মত ভেসে যায় বোট, কখনো কখনো পুরো পানিতে চুবিয়ে আবার ভেসে ওঠে। নির্দেশনা মানতে হয় গাইডের, বডি কন্ট্রোল করতে হয় রোপ ধরে, তবে পুরো জার্নিটা ছিল চমৎকার।
এরপর মাদু রিভারে বোট সাফারি। ছোট ছোট বিভিন্ন আইল্যান্ডে বোট থামে, এক একটা আইল্যান্ড এক এক রকম। কোনটা দারুচিনি দ্বীপ, সেখানে দারুচিনি বানানোর ধাপগুলো হাতে কলমে দেখায়। কোন দ্বীপে আবার টেম্পল। ওখানে ‘রাতার গুল’ এর মত একটা অংশ আছে। দারুচিনি দ্বীপ, ফিস স্পা , ছোট ছোট ভাসমান নারিকেল দোকান সব ছিল এই সাফারিতে। শ্রীলংকান নারিকেল অরেঞ্জ কালার এবং সুস্বাদু।সাফারি শেষে লাঞ্চটা ছিল অসাধারণ।এতো সুস্বাদু ফ্রাইড রাইস খাইনি এর আগে, সাথে ওদের স্পেশাল চিলি পেস্ট, যেটাতে ছোট চিংড়ি মেশানো এবং তার স্বাদ কিছুটা ঝাল কিছুটা মিষ্টি, অসাধারণ। আমি কলোম্বো এসে ডিপার্টমেন্টাল শপ থেকে ঠিক খুঁজে বের করেছিলাম সেই চিলি পেস্ট এবং সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম দেশে।
বীচ থেকে অনেকটা দূরে সমুদ্রের পানিতে ভেসে থাকা একটা ছোট্ট দ্বীপে ওদের একটা উপাসনালয় আছে । স্পিড বোটে যেতে হয় সেখানে। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরাই শুধু যেতে পারে। নিলাঙ্গন জানালো, সুনামির সময় পুরো গল সিটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই টেম্পল ছিল অক্ষত। আরও একটা মজার গল্প বলল সে, সুনামির কিছু আগে সাগরের পানি একদম নিচে নেমে যায়। ভাটার মত মাইল কে মাইল ফাঁকা জায়গা চরের মত জেগে ওঠে, মানুষজন খুশি হয়ে যায়, সবাই নতুন জেগে ওঠা জায়গা দখলের তোড়জোড় শুরু করে। তারা তখন জানত না কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়াল স্রোতের তোড়ে ভেসে যাবে সবকিছু – খড়কুটোর মত।
কলোম্বো এসে পৌঁছাই সন্ধ্যায়।৫ টায় ওদের অফিস শেষ। পথে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়। ৮ টার মধ্যে সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। বেশি রাতে ম্যাকডোনাল্ডস একমাত্র ভরসা। রাতের খাবার সেরে যখন ১২ টায় রুমে ফিরছি হেঁটে হেঁটে, পথে একটা মজার দৃশ্য দেখলাম । বেশীর ভাগ মানুষ গাড়িতে বসে খাবার খাচ্ছে। ওদের রেস্টুরেন্ট এ বসে খেলে চার্জ বেশী পড়ে। টেক ওয়েতে খরচ কম, তাই গাড়িতে বসেই সপরিবারে খেয়ে নিচ্ছে গরম গরম। রুমে ফিরে গোছগাছ এর পালা। ভোর ৪ টায় বের হতে হবে এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে। গোছানো শেষ করে রাত ২ টায় যখন আমাদের ৯ তলার রুমের ব্যালকোনীতে এসে দাঁড়ালাম, বাইরে ঘন অন্ধকার, হয়ত কৃষ্ণ পক্ষ চলছে। সমুদ্রের গর্জন শুনে বোঝা যাচ্ছে সমুদ্র খুব কাছেই। ভোরের আলো ফুটলে হয়ত এখান থেকেই দেখা যাবে জলরাশি। কিন্তু আমরা বেরিয়ে যাবো ভোর হবার আগেই, অন্ধকার থাকতেই। নিলাঙ্গন আমাদেরকে নিতে আসবে ঠিক ৪ টায়। কাজে দেখা হবে না নতুন জায়গার নতুন সকাল। নতুন কোন জায়গায় বেড়াতে গেলে , সেখানকার সকালের একটা আলাদা আবেদন থাকে। আকুতি থেকে গেল কলোম্বোর না দেখা সকালটার জন্য । বারান্দা থেকে শোনা সেই সমুদ্রের গর্জন কানে নিয়ে আবারও যাবো এই প্রতিশ্রুতি জানিয়ে চলে এলাম, মনে মনে বললাম , ‘ Good bye কলোম্বো।’
ভ্রমণ শেষ হলেও একটা গল্প থেকে যায়। এয়ারপোর্টে বিদায় নেবার সময় একটা ছোট কাগজে নিলাঙ্গনের ফেইস বুক আই ডি টা লিখে এনেছিলাম। ফিরে এসে ব্যস্ততা, সময় হয় নাই। বেশ কিছুদিন পর খানিকটা অবসরে ভাবলাম দেখি তো , ওকে একটা ধন্যবাদ অন্তত জানাই। সার্চ দিয়ে ভীষণ অবাক হলাম।ওর প্রোফাইল পিকচারে আমরা ! আমি, মিঠু, সন্ধ্যারেনু এবং নিলাঙ্গন। ভিন দেশী একটা ছেলে, আমাদেরকে এভাবে মনে রেখেছে ! আমি মুগ্ধ হলাম ওর আন্তরিকতায়।নিলাঙ্গন আমাদেরকে শ্রীলংকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে ৫ দিনে। রাতে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া সবটুকু সময় একসাথে ছিলাম আমরা। ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া দাওয়া সব একসাথে।
দীর্ঘ পথে গাড়িতে সিংহলী ভাষায় গান শুনতে শুনতে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, সেও মিঠুর কাছ থেকে পাওয়া বাংলাদেশী সিগেরেটে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। পাহাড়ি পিচ্ছিল রাস্তায় চমৎকার গাড়ি চালায় সে,ভালো ইংরেজি বলে, ভদ্র বিনয়ী।ওর বন্ধু রেনু’র দোকান থেকে আমরা ছোট্ট একখণ্ড রত্ন কিনেছিলাম শ্রীলংকার স্মৃতি হিসেবে। আর ঐ মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করতে সে সেলফিটা তুলেছিল এবং সেটাই সে প্রোফাইল পিকচার করেছে।এয়ারপোর্টে হ্যাণ্ডসেক করে বিদায় নেওয়ার সময়, ওর নীরবতা দেখে আমার কাছে মনে হয়েছিল নিলাঙ্গন আবেগ-অনুভূতিশূন্য এই প্রজন্মের একটা ছেলে। ভাবনায় ভুল ছিল আমার। মানুষের মনও প্রকৃতির মতই বিচিত্র।
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার সাথে প্রাকৃতিক মিল ছাড়াও অনেক মিল আছে আমাদের দেশের।ওদের খাবার, সংগীত, মানুষের আন্তরিকতা আমাদের সাথে বেশ মিলে যায়। পাহাড় আর সমুদ্রের উপচে পড়া সৌন্দর্য পর্যটকের মন কেড়ে নেয় অনায়াসে।বার বার কাছে যাওয়ার হাতছানি দেয় অপরূপা শ্রীলংকা।