মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৭ পূর্বাহ্ন

অতুলনীয় জেনেভা

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৪

জেনেভা লেক সম্পর্কে এই কথাটাই আমার মনে এল। আর গল্প শুনে তারে আমি কবে যেন ভালবেসে ফেললাম! মনে পড়ে, এই লেকের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করে দিয়েছিলেন সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায়, তাঁর ‘পথে প্রবাসে’ গ্রন্থে।

ফ্রান্স সফর শেষে বেরিয়ে পড়লাম সুইজ়ারল্যান্ডের উদ্দেশে। অ্যানেসি থেকে ট্রেনে চেপে জেনেভায় উপস্থিত হলাম। বহুদিনের ইচ্ছা, একবার ওয়র্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন অর্থাৎ ‘হু’র বিল্ডিংটিকে স্বচক্ষে দেখার। জেনেভা ভ্রমণ আমার সেই স্বপ্নপূরণের গল্প।

জেনেভা শহরটি সত্যি অপূর্ব। পথের দুই ধারে নয়নাভিরাম অট্টালিকার সারি। বিশ্বের ইতিহাসে তারা এক একজন বিশিষ্ট তকমাধারী। শহর ঘুরতে ঘুরতে একে একে সকলের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। আর সেই সঙ্গে রোমাঞ্চ অনুভব করছি।

ইতিহাসের গন্ধ মাখা বাতাস। পথের ধুলোয় মিশে আছে সহস্রাব্দের পদরেণু। সুইজ়ারল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হল জেনেভা। জ়ুরিখের পরেই এর অবস্থান। স্টেশনে নেমে একটা সুদৃশ্য বাসে চেপে বসলাম। শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো শহর জেনেভা। রোন নদী এবং জেনেভা লেকের সংযোগস্থলে গড়ে উঠেছে জেনেভা শহরটি। কূটনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য জেনেভার নাম সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। জাতিসঙ্ঘের সদর দফতর গড়ে উঠেছিল এখানে। রেড ক্রসের সদর দফতরও এখানে। এখানেই সাক্ষরিত হয়েছিল জেনেভা কনভেনশন। ১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া এবং তার ফলাফল সমন্বিত সন্ধিপত্র। যুদ্ধে মানবিক আচরণবিধি নিশ্চিত করতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাম্প্রতিক কালে আফগানিস্তান যুদ্ধ (২০০১), ইরাকের আগ্রাসন (২০০৩), ২০০৮ এ রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধ ছাড়া সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে কনভেনশনের চুক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। আইসিআরসি বা আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটিকে জেনেভা কনভেনশন মানবাধিকার সম্পর্কিত কাজের জন্যে ম্যান্ডেট প্রদান করেছে। ১৮৬৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এটি গঠিত হয়েছিল। তখন থেকে বিশ্বব্যাপী কাজ করে চলেছে। চলতে চলতে দেখে নিলাম ওয়র্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা।

ঘুরতে ঘুরতে এলাম জেনেভার বৃহত্তম মসজিদের সামনে। সৌদি আরবের বাদশা খালিদ বিন আবদুলাজ়িজ় এবং সুইস কনফেডারেশনের সভাপতি উইল রিটসচার্ড এটির উদ্বোধন করেন। একসঙ্গে দেড় হাজার লোক এখানে উপাসনা করতে পারেন।

শহরের দে লা পাজ় অ্যাভিনিউতে পা দিয়েই চোখে পড়ল রাস্তা থেকে কিছুটা ভিতরে সুদৃশ্য পালে ডি নাশিওঁ (Palais des Nations)। সামনে সুন্দর উদ্যান। উদ্যান পার হলে বিশাল অট্টালিকা, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদর দফতর। ন’জন স্থপতি মিলে এর নকশা তৈরি করেন। ন’বছর লেগেছিল এটি সম্পূর্ণ হতে। অনেকটা জায়গা জুড়ে নির্মিত হয়েছে অনুপম এই স্থাপত্য।

১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ জেনেভায় আসেন এবং রোমা রোলাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের কথোপকথনে জাতিসঙ্ঘের প্রসঙ্গ ওঠে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়, বিশ্ব তখন উত্তাল। রবীন্দ্রনাথ কথাপ্রসঙ্গে রোমা রোঁলাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আপনি কি মনে করেন বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জেনেভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে?” উত্তরে রোমাঁ রোলাঁ বলেন, ‘‘অনেকগুলো বিষয় আছে, যেগুলো জেনেভার নিয়ন্ত্রণে নেই।’’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘আমার মনে হয় যে সব শক্তি এ ক্ষেত্রে কাজ করছে, সেগুলোর মধ্যে জাতিসঙ্ঘ একটি। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর উপাদান হিসাবে কাজ করতে পারে…।’’

কয়েক পা এগোতেই দেখলাম, জাতিসঙ্ঘের ঠিক উল্টোদিকের রাস্তার পাশে একটা চকের ভিতরে রাখা আছে বিশাল এক পায়াভাঙা চেয়ার। যাতায়াতের পথে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে এই চেয়ারটি। কৌতূহল হল। জানতে পারলাম, বিরোধীপক্ষের ল্যান্ডমাইন এবং বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল বেশ কিছু মানুষ। সেই নিষ্ঠুরতার প্রতীক হিসাবে এই চেয়ারটি রাস্তার পাশে রাখা হয়েছে, জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। বিখ্যাত সুইস শিল্পী দেনিয়েল বারসেট এবং লুইসের মিলিত উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে দশ মিটার লম্বা এই কাঠের ভাস্কর্যটি। এটি জেনেভার একটা ল্যান্ডমার্ক হিসেবে চিহ্নিত।

বেলা পড়ে এসেছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। জেনেভার হ্রদের পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। সামনে অতুল নীল জলরাশি। লেকের বুকে ভেসে চলেছে পালতোলা নৌকা, সুদৃশ্য ক্রুজ়। যেন ছবির মতো! সম্রাট জুলিয়াস সিজ়ারের সময়ে এর নাম ছিল ‘ল্যাকাস লেমানাস’। যার অর্থ ‘বন্দরের হ্রদ’। পরে এর নাম হল ‘লেক জেনেভা’। একশো ছাপ্পান্ন কিলোমিটার দীর্ঘ এই লেক ফ্রান্স এবং সুইজ়ারল্যান্ডের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অজস্র শহর-গ্রাম-জনপদ হ্রদের বাম এবং ডান তিরে।

জেনেভা, লুসান, মন্টেভ, ভেভে ইত্যাদি বিখ্যাত শহর গড়ে উঠেছে এই হ্রদকে ঘিরে। ট্রেনে আসার পথে দেখলাম দূরে ঢেউখেলানো আল্পস পর্বতমালা, সবুজে ঢাকা উপত্যকাভূমি, বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত, সবুজ দ্রাক্ষাকুঞ্জ, পাথরের দৃষ্টিনন্দন বাড়িঘর। ছোট ছোট জানালা, ঝুলন্ত বারান্দা, মাথার উপরে ধোঁয়া নির্গমনের চিমনি, স্লেট পাথরের ঢালু ছাদ, সামনে ফুলের বাগান— সব মিলে চমৎকার।

লেকের পাশ দিয়ে জাতীয় সড়ক ও রেলপথ। হ্রদে সারা বছর পর্যটকদের ভিড়। এখানে অনেক বিচ আছে। বিচে স্নান করা ছাড়াও স্কুবা ডাইভিং, রোয়িং, ওয়াটার স্কিয়িং, ওয়েকবোর্ডিং, বোটিং করা হয়। অসংখ্য পাখিদের মহামিলনক্ষেত্র এই হ্রদ। শহর ছাড়ালে লেকের অন্য রূপ চোখে পড়ে। শহরের কোলাহলমুক্ত শান্ত জেনেভা হ্রদ যেন একখানি গীতিকাব্য!

এখানে একটি জনপ্রিয় সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিশাল দৈর্ঘ্যের হ্রদটিতে প্রতিযোগীরা রোয়িং করে। চিলন কাসল থেকে জেনেভা পর্যন্ত প্রায় সত্তর কিলোমিটার পথ, কখনও মন্টেক্স থেকে ক্লারেন্স পর্যন্ত পৌনে দুই কিলোমিটার পথ পরিক্রমা করে সাঁতারুরা। এ ছাড়াও সাঁতারুদের আরও নানা ধরনের খেলা চালু আছে। জেনেভা হ্রদের ধারে বাস করতেন মনীষী রোমা রোলাঁ। হ্রদের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় খুঁজে চলেছি সবুজ ছায়াঘেরা সেই ছোট্ট গ্রাম ভিলন্যুয়েভ (Villeneuve)। কোথায় আছে সেই ছোট্ট বাড়ি, ভিলা অলগা। যেখানে মনীষী রোমা রোঁলা থাকতেন।

জেনেভাতে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। শুধুমাত্র ইতালি কিংবা ফ্রান্সই নয়, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা থেকেও বহু মানুষ এখানে এসে থিতু হয়েছেন। ফরাসি হল জেনেভার প্রথম ভাষা। উপযুক্ত কাঁচামালের অভাবে বৃহৎ শিল্প তেমন বিকাশ লাভ না করলেও জেনেভা বিশ্ব অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের ব্যাঙ্কিং কেন্দ্রগুলোর ভিতরে এটি একটি, জ়ুরিখের পরেই এর অবস্থান। বৃহৎ শিল্প তেমন কিছু না থাকলেও যন্ত্রপাতি তৈরি, সুইস ঘড়ি শিল্প, রাসায়নিক এবং সুগন্ধী দ্রব্য প্রস্তুতি, সুতির জিনিসপত্র উৎপাদন এবং অন্যান্য শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। শিক্ষার দিক থেকে জেনেভার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অনেক গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান আছে জেনেভায়। এ ছাড়াও সেখানকার বোটানিক্যাল গার্ডেন, সিটি কনজ়ারভেটরি, জাদুঘর, গ্র্যান্ড থিয়েটার হল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, খেলাধুলো, বিনোদন… সব মিলে জেনেভা বিশ্ববাসীর কাছে ভালবাসা পেয়ে আসছে।

এরপরের দ্রষ্টব্য স্থান হল চিলন কাসল। লেকের ভিতরে একটি ছোট দ্বীপে গড়ে উঠেছিল এই কাসলে। শ্যাটো ডে চিলন হল দশম শতকের একটি দুর্গ। দ্বাদশ শতাব্দীতে ডিউক অফ স্যাভয় এটিকে গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল বানিয়েছিলেন। পুরো গ্রীষ্মের সময়টা তিনি এখানেই কাটাতেন। সুদৃশ্য জাহাজ থাকত এই লেকে। এই হ্রদের ধারে জীবনের এক বিশেষ সময় কেটেছিল কবি লর্ড বায়রনের। ১৮১৬ সালে এখানে থাকাকালীন তিনি লিখেছিলেন ‘দ্য প্রিজ়নার অফ চিলন’ কবিতাটি। মধ্যযুগে নির্মিত এই চিলন দুর্গে বন্দি করে রাখা হয়েছিল ফ্র্যাংকয়েজ দ্য বনিভার্ডকে। টানা ছ’বছর শিকলে বাঁধা ছিলেন বনিভার্ড। ষোড়শ শতাব্দীতে যখন ধর্মযুদ্ধ শুরু হল, স্যাভয়ের ডিউক এই দুর্গকে বন্দিশালা বানিয়ে ফেললেন। সেই ধর্মযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ফ্র্যাংকয়েজ দ্য বনিভার্ড। তিনি আদতে ছিলেন একজন সন্ন্যাসী, ধর্মযাজক। তাঁর দেশপ্রেম এবং শাসকের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সাহস এবং কর্মকাণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কবিতা রচনা করেছিলেন বায়রন। কবিতার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে লিখলেন, ‘There are seven pillars of Gothic mould/ In Chillon’s dungeous deep and old,…’ দুর্গের একটা কক্ষে বনিভার্ড দীর্ঘদিন বন্দি ছিলেন। তাঁর দেখার জগৎ বলতে এক চিলতে একটা জানালা।

এই মনোরম হ্রদের ধারে থাকতেন ইংরেজ কবি পার্সি বিশ শেলি। পরিচয় হয়েছিল বায়রনের সঙ্গে। পি বি শেলির সহধর্মিণী মেরি শেলির সঙ্গে বায়রনের বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। মেরি শেলি এখানে থাকাকালীন রচনা করেন সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’।

এখানে দিন দীর্ঘ। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা বাজলেও আকাশে আলো আছে। বেশ কয়েকঘণ্টা জেনেভা লেকে কেটে গেল। অবশেষে মুগ্ধতা নিয়ে বিদায় নিলাম জেনেভা লেক এবং জেনেভা শহরের কাছ থেকে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com