শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৭ অপরাহ্ন

হ্রদ পাহাড়ের দেশে

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পাইনের সবুজ বন। হাজারো লতাগুল্ম মাড়িয়ে ঘোড়াগুলো এগিয়ে চলেছে উঁচু থেকে আরও উঁচুতে। বিস্তীর্ণ মাঠের বুক চিরে যেমন এগিয়ে যায় মেঠো পথ, পাহাড়ের বুকে পাইনের বন চিরে তেমনি চূড়ার দিকে উঠে গেছে এটি। নৈঃশব্দ্য ভেদ করে কোথাও ডেকে ওঠে অপরিচিত পাখি। কোথাও সুগন্ধ ছড়ায় নাম না জানা ফুল। আর অভিজ্ঞ গাইডের পেছনে ধীরপায়ে যেন স্বর্গের দিকে এগিয়ে চলেন অভিযাত্রীরা।

শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ। সেখান থেকে শিতকাডি ক্যাম্পে রাত কাটিয়ে দ্বিতীয় দিনের পথে অভিযাত্রীরা। শিতকাডি থেকে আরও ওপরে। এ পথেই পাইনের বন। এ পথের মাথায় নিচনাই পাস। সেই পাসের নিচে হবে দ্বিতীয় ক্যাম্প। শিতকাডি থেকে খুব বেশি দূরের পথ নয়, মাত্র ১১ কিলোমিটার। হেঁটে যেতে লাগবে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। যেকোনো মানুষের জন্য এ পথ জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতার রসদ জোগাবে। অবশ্য পথ শুধু এটুকুই নয়, কাশ্মীর গ্রেট লেকস ট্রেকের নির্বাচিত পথটুকু প্রায় ৭২ কিলোমিটার, সোনমার্গ থেকে গঙ্গাবাল-নারানাগ পর্যন্ত। যেতে-আসতে সময় লাগবে প্রায় এক সপ্তাহ! পাহাড়ি পথ। ওপরে অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে সবকিছুই যেন স্লো মোশন হয়ে পড়ে।

তাই সময় লাগে বেশি। কিন্তু অভিজ্ঞতা? পাইনের বন ছেড়ে সবুজের গালিচা। তাতে ফুটে থাকা অসংখ্য বুনোফুল। শরতের আকাশ কালো করে হঠাৎ খানিক বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকে ডাবল রংধনু। অক্সিজেনের স্বল্পতা সঙ্গে করে ওপরে উঠতে উঠতে দেখা ভিশানসার ও কিষানসার লেক এবং গাদসার পাস। ‘সার’ একটি কাশ্মীরি শব্দ, অর্থ লেক বা হ্রদ। সেখান থেকে মেনগেন টপ, সাতসার টুইন লেক, সাতসার ক্যাম্পসাইট হয়ে জ্যাজ পাস, গঙ্গাবাল লেক, গঙ্গাবাল ক্যাম্পসাইট তারপর নারানাগ। এই প্রায় ৭২ কিলোমিটার পথে দিন যেমন রাতও তেমনি বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হবে আপনার সামনে। আলোকদূষণ নেই বলে দুপুরের পর থেকে এখানে দেখা যায় চাঁদ। আর পাহাড়ের গায়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামলে কোটি কোটি তারা। খালি চোখে চেনা যায় লুব্ধক, কালপুরুষ কিংবা ধ্রুবতারা অথবা শুক্র গ্রহ। কখনো কখনো কৃত্রিম উপগ্রহের ছুটে চলা সারি বা স্যাটেলাইট ট্রেন দেখা যাবে খালি চোখে, পরিষ্কার। আর সার বা হ্রদ?

আসাদুজ্জামান আসাদ এখানেই থামলেন কথা বলতে বলতে। থামলেন না বলে বলা চলে, হোঁচট খেলেন। তাঁর চোখ চকচক করে উঠল সদ্য শেষ করা এই অভিযানের কথা বলতে গিয়ে। আমার একদম চোখে চোখ রেখে বললেন, সে এক অপার্থিব রঙের খেলা। বিশ্বাস করবেন? সূর্যের আলো একেক দিক থেকে একেক সময় একেক হ্রদের গায়ে পড়লে তার রং আলাদা হয়ে যায়। কখনো সবুজ, কখনো নীল। কখনো নীলেরই আরেক রূপ! এ জন্যই কাশ্মীরের এ পথকে বলে গ্রেট লেকস ট্রেক। কতগুলো হ্রদ আছে এখানে বলা মুশকিল। তবে সাতটা বড় হ্রদের কথা বলা হয়। সেগুলোই দেখতে যান পর্যটকেরা।

 

৭ থেকে ১৩ আগস্ট কাশ্মীর গ্রেট লেকস ট্রেক করে ফিরেছেন আসাদুজ্জামান আসাদ। ছিলেন সে দলের ট্রেকিং লিডার। জানালেন, একেকটা ট্রেক শেষ করেন ঠিক পরের ট্রেকটা আরও ভালোভাবে শেষ করবেন বলে। প্রতিটি ট্রেক তাঁর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ।

পেশাগত জীবনে আসাদ যুক্ত আছেন বেঙ্গল ট্রেকার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানে হাই অলটিচুড ট্রেকিং অ্যান্ড ক্লাইম্বিং লিডার হিসেবে। আবার প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও জড়িত তিনি। জানতে চাইলাম, নিরাপদ সরকারি চাকরি কিংবা উচ্চ বেতনের করপোরেট চাকরি আপনার ভালো লাগেনি? হাসলেন। বললেন, ‘মনে হয় না। আর সবাই যদি চাকরিই করি, এসব করবে কে?’ সে তো প্রশ্নই বটে। ভাবনা এক, আর সেই ভাবনাকে বাস্তব করতে তার পেছনে ছুটে চলা, সে আরেক বিষয়। আসাদ ভাবনাকে বাস্তব করার পেছনে ছুটে চলা মানুষ।

শুরুর দিনগুলো
যেমন হয় আরকি, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের অপার স্বাধীনতার দিনে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে আবিষ্কার করা— আরে ভালো লাগছে তো ঘুরতে! তারপর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ করতে করতে কতবার কোথায় গেলাম, তার হিসাবটাই ভুলে যাওয়া। সেভাবেই আসাদও ভ্রমণের মায়ায় আটকে যান। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন বা সিলেটের মতো জায়গায় মামুলি ঘোরাঘুরি করতে করতে একদিন চলে গিয়েছিলেন হামহাম জলপ্রপাত দেখতে। তারপর আর থামা হয়নি। সেটা ২০১৪ সালের ঘটনা। সে ঘটনার প্রায় ৯ বছর পর যখন আমি তাঁর মুখোমুখি, আসাদ জানান, ৫ হাজার ফুট উচ্চতা না হলে এখন ট্রেকিং করে আনন্দ পান না তিনি! সে কারণেই হয়তো ২০১৮ সালে ট্রেকিং করতে গিয়েছিলেন ভারতের সান্দাকফু। সেখান থেকে ফিরে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছিলেন আসাদ। পাহাড়কে কেন্দ্র করেই হবে তাঁর জীবন ও ক্যারিয়ার। ২০১৯ সালে রোপ-৪ আয়োজিত ‘মিশন হিমালয়া-২০১৯’ জিতে চলে গেলেন নেপালের লাংটাং ভ্যালির প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ফুট উচ্চতার ইয়ালা পিক সামিট করতে। সফল হয়ে ফিরে এলেন। এরপর বহুবার বহু ট্রেকে গেছেন দলবল নিয়ে।

ভ্রমণে কেন
নিজেকে জানতে! হ্যাঁ, আসাদ জানালেন, ভ্রমণ হলো নিজেকে জানার এক দারুণ মাধ্যম। কোন অবস্থায় কোথায় আছেন, কার সঙ্গে কীভাবে কোন ঘটনায় সাড়া দিচ্ছেন, মানুষ হিসেবে সেগুলো আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো স্বাভাবিক জীবনে আমরা সেটা বুঝি না। কিন্তু ভ্রমণে গেলে সেটা বোঝা যায় গভীরভাবে।

গত দুই বছরে
২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত চারটি হাই অলটিচুড ট্রেক করেছেন আসাদ। এগুলোর মধ্যে আছে ২০২২ সালে প্রায় ৬ হাজার ২৫০ মিটার উচ্চতার মার্খা ভ্যালি ও কাংইয়াৎসে ট্রেক, সে বছরই ভারতের উত্তরাখন্ডের কেদার কান্থা ট্রেক, এ বছরের এপ্রিল-মে মাসে প্রায় ৫ হাজার ১০০ মিটার উচ্চতায় অন্নপূর্ণা ও কাঞ্চনজঙ্ঘা নর্থ বেস ক্যাম্প এবং ৭ থেকে ১৩ আগস্ট কাশ্মীর গ্রেট লেকস ট্রেক।

ব্যক্তিগত
শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার গোয়ালকোরা গ্রামে আসাদের দাদার বাড়ি। তবে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জ শহরে। বাবা মো. আবুল হাশেম ও মা জাহানারা খাতুন, দুজনই সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। আসাদের এক ভাই বর্তমানে ফ্রান্সপ্রবাসী। স্ত্রী আঁখি আকতার। আসাদ ও আঁখির রয়েছে দুই সন্তান—সাজিদুর ইসলাম আবরার ও সাবিকুন নাহার অদ্রি। একজনের বয়স দুই বছর, আরেকজনের দেড় মাসের কাছাকাছি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com