বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এদেশের ঋতু বৈচিত্র বড়ই মনোহর। প্রতিটি ঋতু তার আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ হেমন্ত, শীত ও বসন্তের আগমন মানুষ টের পায় প্রত্যেক ঋতুর সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে। ঋতু বৈচিত্রের এমন রূপ লাবণ্য পৃথিবীর আর কোন দেশে পরিদৃষ্ট হয় না। তাই হয়তো কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখছিলেন ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সেজে আমার জম্মভূমি।’ ঋতু বৈচিত্রের এ রূপ দারুণ ভাবে ধরা পড়ে বাংলাদেশের গ্রাম বাংলায়। বাংলাদেশের গ্রামগুলো যেনো একেক ঋতুতে এক এক রূপ ধারণ করে।
বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্রের চতুর্থ ঋতু হেমন্ত। এই হেমন্ত মানেই বাংলা বর্ষের কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস। এই হেমন্তে নেই তেমন কোন ফুলের অপার সৌন্দর্য, কিন্তু আছে সবুজ দোলানে মাঠের অপরূপ শোভা, শান্ত স্নিগ্ধ ঐশ্বর্যের এক প্রাণময় দোলা। এই দোলা ছবি হয়ে ধরা দেয় গ্রাম বাংলার পথ ঘাট মাঠ প্রান্তরে। শরতের মন কাড়া রূপের বিদায়ে আমাদের ঘর যেনো পাকা ধানে গোলায় ভরার এক চমৎকার বার্তা নিয়ে হেমন্ত আসে। সবুজে সবুজময় মাঠ ধীরে ধীরে সোনালী আভায় ভরে ওঠে। বাংলাদেশের প্রকৃতি যেনো সেজে ওঠে নতুন সাজে, আর এ যেনো হেমন্তরই পরিপূর্ণতা।
হেমন্ত কে আমরা বলতে পারি উৎসবের ঋতু। হেমন্ত মানে আনন্দের সমারোহ। হেমন্ত মানে উৎসবের আমেজ। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে নতুন ধানের ঘ্রাণ। নতুন ধানের ঘ্রাণে কৃষকের ঘরে ঘরে বয়ে যায় আনন্দ হিল্লোল। এ যেনো গ্রাম বাংলার চিরায়িত রূপ। বর্ষার সময় রোপন করা ধান বৃষ্টি জলে বেড়ে ওঠে,শরতে যেনো যৌবন প্রাপ্ত হয়ে হেমন্তে পরিপূর্ণতা লাভ করে। সবুজে সবুজময় ধান ক্ষেত হেমন্ত শেষে সোনালি রূপ ধারণ করে।
ক্ষেতে,আলে কিংবা দূর পথে দাঁড়িয়ে দেখে কৃষক। আর তা দেখে কৃষকের মুখে নেমে আসে অনাবিল হাসি। এমন রূপ সৌন্দর্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামবাংলা ছাড়া আর কোথায় মেলে ? গ্রামে গ্রামে, বাড়ির উঠোনে পথ প্রান্তরে দেখা মেলে ধান ভানার দৃশ্য। সারা বছরের অন্ন এ হেমন্তেই ঘরে ওঠে। ‘আমরা মাছে ভাতে বাঙালি’ নামে কথা প্রচলিত আছে। সেই ভাত বা অন্নের যোগানের অধিকাংশই হেমন্তে আসে। সে জন্যই হেমন্ত গ্রাম বাংলার কৃষকের কাছে এক আনন্দ, উৎসবের ঋতু। শরতের পরে হেমন্তের আগমনী সুর গ্রামেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, গ্রাম বাংলায় না গেলে তা কখন উপলব্ধি করা যাবে না।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় হেমন্ত যেনো প্রাণ পেয়েছে এভাবে, তিনি যখন বলেন,‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা / নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।’ হেমন্তের সৌন্দর্যের স্রোতে ভেসে কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/ কোন পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে।’ হেমন্ত প্রকৃতিতে গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের কবিতায়। তিনি লিখেছেন- ‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান/ সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান। ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা,গন্ধ উড়ায় বায়ু/ কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’ হেমন্তে চোখ-জুড়ানো মন-মাতানো ফুলের বাহারে সাজে অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি। ফুলের সৌরভে মাতামাতি না থাকলেও এ ঋতুতে ফোটে গন্ধরাজ,মল্লিকা,শাপলা,পদ্ম, কামিনীসহ নাম না জানা হরেক রকম ফুল। খালবিল, নদীনালা আর বিলজুড়ে দেখা যায় সাদা-লাল শাপলা আর পদ্মফুলের মেলা। হেমন্তে বৃষ্টি ও বন্যার পানি চলে যাওয়ায় এ সময় পুকুর,খাল-বিলে ধরা পড়ে নানা ধরণের মাছ।
গ্রামীণ জনপদে মাছ ধরার দৃশ্যও দেখা যায়। কারো কারো বাড়ির আঙিনায় সবুজ সবজি শোভা পায়। নদী চরে চাষাবাদ শুরু হয় বেগুন,মুলা, ফুলকপিসহ নানান ধরণের সবজি। কার্তিকের পরে তাইতো কৃষকের মনে এতো আনন্দ এতো সুখ। সোনা ধানের সমারোহ যেনো জানান দেয় নবান্নের আয়োজন। এ জন্যই গ্রামে গ্রামে প্রস্তুতি চলে বিভিন্ন উৎসব আয়োজনের। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই নবান্ন হেমন্তের অন্যতম উৎসব। নবান্ন উৎসব হল বাংলার প্রাচীন একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসবের নাম। আবহমান বাংলার কৃষিজীবী সমাজে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট যে সকল আচার অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন উৎসব তার মধ্যে অন্যতম। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুতকৃত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত এক গ্রাম বাংলার উৎসব।
এই নবান্ন উৎসবের মূল বিষয় হল ফসল তোলার পর ধানের নতুন চালে নানা ধরণের পিঠা ফিরনী-পায়েশ বা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে বিতরণ বা তাদের দাওয়াত করে খাওয়ানো হয়। এই নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করার একটি প্রথাও প্রচলিত আছে। অনেকে আবার নবান্ন উৎসবে মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি নিয়ে আসেন। নতুন চালে তৈরি করা হয় নানা ধরনের পিঠাপুলি, বাহারী খাবার,আর নানা ধরণের মুড়ি-মুড়কি। গ্রাম বাংলা হচ্ছে পিঠাপুলি তৈরির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। সারা বছর অনেক ধরনের পিঠা তৈরি হয় এ দেশে,তার অধিকাংশই তৈরি করা হয় এই হেমন্তের নবান্ন উপলক্ষে। হেমন্তের পরের ঋতু শীতকালেও পিঠা তৈরি হয় গ্রাম বাংলায়। নবান্ন উৎসব এখন আর গ্রামাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে ঢাকা চট্টগ্রাম শহরসহ অন্যান্য অনেক শহরেই এই উৎসব পালিত হয়। জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পরিষদ প্রতি বছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে নবান্ন উৎসব উদযাপন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুল তলায়।
এখন নবান্ন উৎসব দেশের অন্যতম বড় উৎসব। চট্টগ্রামের ডিসি হিলেও প্রতিবছর নবান্ন উৎসব হয় সাড়ম্বরে। আরো অন্যান্য জায়গায়ও এ উৎসব অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এই উৎসবে ফুটে ওঠে আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপ। ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে ভোরের নরম স্নিগ্ধ আলো গায়ে মেখে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। উৎসব উপলক্ষে পরিবেশিত হয় গান,আবৃত্তি, হেমন্তের কবিতা ও লোকনৃত্য আরো কত কিছু। বের করা হয় নবান্নের শোভাযাত্রা। সকলের পোষাকে থাকে উৎসবের ছোঁয়া। উৎসব উপলক্ষে মেয়েরা রঙিন শাড়ির সাথে খোঁপায় ফুল গুঁজে আর ছেলেরা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আসে এই নবান্ন উৎসব প্রাঙ্গনে। উৎসব যেনো রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। দেশের নানান অঞ্চলের নানান ধরনের পিঠার স্টলে ভরপুর থাকে নবান্ন উৎসব অঙ্গন।
পিঠা খেয়ে আগত লোকজন পায় গ্রামের স্বাদ। কারো স্মৃতি পটে ভেসে ওঠে সেই গ্রাম বাংলায় হাতে বানানো পিঠা খাওয়ার কথা। যেনো সেই ছোটবেলার অতীতে ফিরে যাওয়া। নবান্ন উৎসব বাংলার একটি প্রাচীন ও একান্ত আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। নবান্নের এই আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানমালা গ্রাম বাংলায় এখন আর দৃশ্যমান নয়। এটি এখন অনেকটা শহুরে সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। গ্রাম বাংলায় নবান্নের চিত্র ঘরে ঘরে উদ্যাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে শহরে নবান্ন উদযাপনের এই সংস্কৃতি আমাদের শহরে বসবাসরত শিশুকিশোরদের গ্রাম বাংলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করছে। নবান্ন উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই আমরা আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সাথে,যাদের সাথে বর্তমানে নানা কারণে গ্রামের দূরত্ব বিদ্যমান। হেমন্তের এই উৎসবটিই হতে পারে ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে একটি দেশীয় সর্বজনীন উৎসব।