সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪১ অপরাহ্ন

হেনরীর হাজার কোটি টাকা

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী। এক আলোচিত-সমালোচিত নাম। ছিলেন উচ্চবিদ্যালয়ের গানের শিক্ষিকা। আয় বলতে ছিল স্কুলের বেতন। সেই হেনরী গত দেড় দশকে শূন্য থেকে হয়েছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। প্রতি বছর আয়কর দেওয়ার সময় কালো টাকা সাদা করার তালিকায় নাম থাকত তার। ২০০৮ সালে সিরাজগঞ্জ সদর (সিরাজগঞ্জ-২) আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন পেলেও সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। অবশ্য তার পরাজয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের এক বড় নেতাকে দায়ী করা হয়। পুরস্কার স্বরূপ হেনরীকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক করা হয়। এখান থেকেই জান্নাত আরা তালুকদার হেনরীর উত্থান শুরু। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ঋণপ্রদান ও মওকুফ, চাকরিবাণিজ্য, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, বদলিসহ নানা কর্মকাে র মাধ্যমে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে কোটিপতি বনে যান স্থানীয় সবুজ কানন উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক হেনরী।

শুধু নিজ জেলা সিরাজগঞ্জ নয়, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, পটুয়াখালী ও ঢাকায় তার অঢেল সম্পদের ছড়াছড়ি। নামে-বেনামে খুলেছেন বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান। এ যেন হাতে আলাদিনের চেরাগ। সিরাজগঞ্জে কথিত আছে, ‘টাকার জোরেই’ ২০২৩ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন তিনি। শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও কোটি কোটি টাকা খরচ করে হয়ে যান এমপি। এমপি হয়েই জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। রাজনীতির পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, অফিসে ছড়ি ঘোরান তিনি। টেন্ডার, নিয়োগ, বদলি সবকিছুই তার ইশারায় চলে আসে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর পর ফাঁকা হয় জেলা পরিষদ পদ।

জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেয়নি। সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এ পদের জন্য জেলা আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র ও ত্যাগী রাজনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু হেনরীর খায়েস হয় জেলাকে নিয়ন্ত্রণ করার। সে কারণে তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবুকে প্রার্থী করেন। জেলার প্রবীণ রাজনীতিবিদরা তাকে প্রার্থী না করতে অনুরোধ করলেও টাকা ও ক্ষমতার দাপটে কর্ণপাত করেননি হেনরী। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে জানা যায়, কয়েক কোটি টাকা খরচ করে স্বামী লাবুকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানান হেনরী। এর পর জেলার রাজনীতির পাশাপাশি সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্যদের মতো গা ঢাকা দেন হেনরীও। এদিকে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ ছাড়ার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও লাপাত্তা হেনরী। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ।

অনলাইনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার একাধিক ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে কথা বলেও অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়নি কিছু। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য জমা দেওয়া হেনরীর নির্বাচনি হলফনামা পর্যালোচনা করে জানা গেছে, গত ১৪ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে ৮২০ গুণ। এই সময়ে কালো টাকা সাদা করেছেন তিন দফায়। বাড়ি, গাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, রিসোর্টসহ গড়েছেন শত শত কোটি টাকার সম্পদ। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকার। শিক্ষকতা ও কৃষি থেকে আয় ছিল ১ লাখ ২২ হাজার টাকা। বার্ষিক খরচ দেখানো হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা। আয়কর নথির হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১৪ বছরে তার সম্পদ ৮২০ গুণ বেড়ে হয়েছে ৫১ কোটি ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। জানা গেছে, ২০০৮ সালে সিরাজগঞ্জ-২ আসন থেকে নৌকার টিকিটে এমপি হতে না পারা হেনরীকে পুরস্কার স্বরূপ সোনালী ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠে হেনরীর।

সে কারণে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। সোনালী ব্যাংকের আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে তার নামও আসে। কারাগারে থাকা হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে তার কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের কথা বলেন। এর মধ্যে হেনরীর নাম ছিল। পরে দুদক তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে। পর্যায়ক্রমে তিন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিলেও অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। অবশেষে তাকে অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। হেনরীর আয়কর নথিতে ২০১৯ সালের ৩০ জুন নিট সম্পদ দেখানো হয় ১১ কোটি ৬৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

এর মধ্যে জমির দাম হিসেবে ২ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার কালো টাকা সাদা করা হয়। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত নিট সম্পদ দেখানো হয় ৪৭ কোটি ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকার। এর মধ্যে তিনি ৩২ কোটি ৫০ লাখ কালো টাকা সাদা করেন। ২০২১ সালের ৩০ জুন আয়কর নথিতে নিট সম্পদ উল্লেখ করা হয় ৪৭ কোটি ৭১ লাখ ৮৮ হাজার টাকার। ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর নথিতে আবার ১ কোটি ৩০ লাখ কালো টাকা সাদা করা হয়। নিট সম্পদ দেখানো হয় ৫১ কোটি ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকার। হেনরীর স্বামী শামীম তালুকদার লাবুর আয়কর নথিতেও রয়েছে নানা গরমিল। নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, তিনি ১ কোটি ৩০ লাখ কালো টাকা সাদা করেছেন।

গাড়ি-বাড়ি স্থাবর সম্পদের তালিকাও বেশ দীর্ঘ।

সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ নেত্রীর বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারে রয়েছে নানা কাহিনি। তার ব্যবহৃত তিনটি গাড়ির মধ্যে আছে হুড খোলা (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-৮১০২) কালো রঙের ল্যান্ডক্রুজার। ৭ আসন বিশিষ্ট ২৭০০ সিসির গাড়িটি রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে জেসমিন কনস্ট্রাকশন টেক লিমিটেডের নামে। ঠিকানা দেওয়া হয়েছে প্লট নম্বর ২, রজনীগন্ধা, মেইন রোড, রূপনগর, ঢাকা। আছে দুটি দামি প্রাইভেট কারও।

তবে ব্যবহৃত এসব গাড়ির একটিও তার নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন করা নয়। অন্যের নামে সম্পদ করে বহাল তবিয়তে ভোগ করছেন তিনি। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রো গ-১৫-৩৯৯০ নম্বর ১৫শ সিসি প্রাইভেট কারটি ড. মো. জামাল উদ্দিন, পিতা-মিয়া হোসেন, ১৭৭ তুলাশার শরীয়তপুরের ঠিকানা রয়েছে। অপর কার ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-৩৮৩২ নিশান ২০০০ সিসির গাড়িটি রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে লাম ট্রান্সপোর্টের নামে। ঠিকানা দেওয়া হয়েছে অ্যাপার্টমেন্ট নম্বর ৩০৪, প্লট-২, রজনীগন্ধা, রূপনগর। ঢাকা মেট্রো গ-৩২-২২২৭ নম্বর প্রিমিও মডেলের মেরুন রঙের প্রাইভেট কারটি ২০১৭ সালে কেনেন জান্নাত আরা হেনরী। এই কারটি স্থায়ীভাবে সিরাজগঞ্জের গজারিয়ায় অবস্থিত কিছুক্ষণ রিসোর্টের সামনে রাখা হয়েছে।

এই কারটি তার নিজের নামে পাওয়া গেছে। জান্নাত আরা হেনরীর বিষয়ে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, মূলত ২০১৮ সাল থেকে আয়কর নথিতে তার স্থাবর সম্পদ দৃশ্যমান হতে থাকে। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর ৬৬৮৮ নম্বর দলিলে সিরাজগঞ্জের বাহুকা মৌজায় ১৬ শতক জমি কেনেন ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকায়। পরদিন ২৭ নভেম্বর ৬৬৩৯ নম্বর দলিলে একই মৌজায় ৫১ শতক জমি কেনেন ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি ৮২২ নম্বর দলিলে ৩৪ শতক ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা, ওই বছরের ২১ মে একই মৌজায় ৫৮৬৯ নম্বর দলিলে ৩ লাখ টায় ১৮ শতক, ২০১৯ সালের ২০ জুন পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ৯ নম্বর জেএল রজপাড়া ২৫৭৪ নম্বর দলিলে ২ একর ৫১ শতক কিনেছেন ১ কোটি ১০ লাখ ৯২ হাজার টাকায়, তিন দিন পর ২৪ জুন সিরাজগঞ্জের রতনকান্দিতে ৯ শতক জমি কেনেন দেড় লাখ টাকায়, একই বছরের ২ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কামতা আবাসিক এলাকায় ৪৫৩৬ নম্বর দলিলে ২২ লাখ ৭০ হাজার টাকায় ৫ কাঠা জমি কেনেন।

এই সময়েই ঢাকা মেট্রো চ-১৯-০৫৯১ নম্বর মাইক্রোবাস ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ঢাকা মেট্রো চ-৫৬-২৮৯৫ নম্বর মাইক্রোবাস কেনা হয় ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ঢাকা মেট্রো ঝ-১১-১১৩২ মিনিবাস ৩২ লাখ টাকায় কেনেন। ২০০৮ সালে দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করা হয় ২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। সেই স্বর্ণ এখন ফুলেফেঁপে ১০০ ভরিতে ঠেকেছে। সিরাজগঞ্জ ও গাজীপুরে হেনরীর নামে সাইন বোর্ড দেওয়া স্থাবর অনেক সম্পদ আছে। নানা স্থানে একের পর এক গড়ে তুলেছেন প্রতিষ্ঠান।

সিরাজগঞ্জের গজারিয়ায় রিসোর্ট ‘কিছুক্ষণ’, জেলার নলিছাপাড়ায় জান্নাত আরা হেনরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ এবং হেনরী ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্স টেকনোলজি ভবন আছে। সিরাজগঞ্জের স্টেশন রোডে ছয়তলা বাণিজ্যিক ভবন এবং সেটির নিচতলায় মার্কেট করা হয়েছে। অন্য তলাগুলোতে আবাসিক হোটেল ‘আলীশান’। সিরাজগঞ্জ সদরের মুজিব সড়কে ‘রাস মেডিকেয়ার’ নামে ক্লিনিক, জেলার গজারিয়ায় ‘হেনরী ভুবন’ নামে বৃদ্ধাশ্রম, গজারিয়ায় মোতাহার হোসেন তালুকদার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ফজল খান রোডে হেনরী স্কলাসটিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ গড়া হয়েছে।

২০২৩ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ সদর আসন থেকে এমপি হয়ে তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। সদর আসনের সাবেক এমপি হাবিবে মিল্লাত মুন্নার অনুসারীদের কোণঠাসা করতে দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর চালান স্টিমরোলার। সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে জেলার রাজনীতি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে হেনরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com