কিছুদিন আগেও কেউ জানত না রাঙামাটির গভীরে লুকিয়ে আছে একটা সোয়াম্প ফরেস্ট। হরিনাছড়ার এই সোয়াম্প ফরেস্ট বলতে গেলে একেবারেই নতুন। গবেষকরা রীতিমত গুপ্তধনের সাথে তুলনা করছেন এই বনকে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে প্রথম এই এডভেঞ্চারের সাথে একদল অভিযাত্রীর পরিচয় ঘটে। এর আগে এখানে বলতে গেলে বাইরের কারোই পা পড়ে নি! এরপর কিছু কিছু এডভেঞ্চার প্রেমী মানুষ আসা যাওয়া করলেও সাধারণ ট্যুরিস্টদের আনাগোনা এখনো শুরু হয় নি।
কোন এক ভর জ্যোৎস্নারাতে, আরাকান রাজকণ্যা তার কানের দুলের জন্য নেমে পড়েছিলেন নদীর বুকে। তাকে বাঁচাতে প্রেমিক আদিবাসী রাজপুত্রও ঝাঁপিয়ে পড়ল অতল জলে। মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা সেই প্রাচীন নদীটির নাম এখন কর্ণফুলি। কর্ণফুলির উৎসমুখের কিছুটা পরেই ছোট্ট এক পাহাড়ি জনপদ ও বাজার- ছোট হরিনা । আরাকান রাজকণ্যা তার কানের ফুল খুঁজে পেয়েছিলেন কিনা, সে কথা জানা হয় নি। কিন্তু, সেদিনের সেই নদীপথ ধরে আমাদের গন্তব্য এবার ছোট হরিনা সোয়াম্প ফরেস্ট।
ছোট হরিনায় যাওয়ার জন্য রাঙামাটির সমতাঘাট থেকে আপনাকে নৌকায় উঠতে হবে। প্রতিদিন ঘাট থেকে সকাল সাড়ে সাতটা ও দুপুর বারোটায় লঞ্চ ছেড়ে যায় ছোট হরিনার উদ্দেশ্যে। এছাড়া, রাঙামাটির রিজার্ভ বাজার থেকেও ছোট হরিনার উদ্দেশ্যে জলযান ছেড়ে যায় প্রতিদিন। রিজার্ভ বাজার থেকেও ট্রলার ও নৌকা পেতে পারেন। সরাসরি ছোট হরিনার নৌকা-ট্রলার না পেলে সমতাঘাট থেকে বরকলের ট্রলারে উঠতে হবে। তারপর ওখান থেকে ছোট হরিনা। সারাদিনে মাত্র দুটো লঞ্চ এই রুটে আসা-যাওয়া করে।
মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা জল, কর্ণফুলিতে গড়িয়ে পড়ছে ছোট হরিনার সন্নিকটে। লেকের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়, দলছুট পাহাড়ি ছোট্ট বাড়ি, নীল জলরাশির উপরে রোদের ঝিকমিক, উড়ে বেড়ানো পাখির ঝাঁক দেখে মুগ্ধ হবেন, এই কথা নিশ্চিত বলা যায়। হরিণাছড়া সোয়াম্প ফরেস্টের প্রকৃতি অন্য আর দশটা সোয়াম্প ফরেস্টের মতোই। নীরব সোয়াম্পের কুয়াশামাখা পরিবেশের মাঝে বৈঠা-নৌকায় ভেসে বেড়ানো একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি।
শেষ বিকেলের মায়াবী আলোয় পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট জুমঘর, তুলোটে মেঘের ছায়ায় ঢেকে থাকা গ্রাম, শান্ত জলপথ, সন্ধ্যার সোনালী উজ্জ্বল আকাশ আপনাকে মনে করিয়ে দিবে যে, আপনি এই প্রকৃতির সন্তান! দুপাশে পাহাড়ের দেয়াল তৈরী করে ছুটে চলা চঞ্চল কর্ণফুলির বুকে পুরনো লঞ্চ কিংবা ট্রলারে বসে নিজেকে কখনো প্রাচীন সময়ের অভিযাত্রী মনে হবে। কিংবা, নিজেকে মনে হতে পারে আরাকান রাজকণ্যার হারানো নাকফুলের খোঁজে অভিযানে আসা কোন রাজপুত্র। শুধু সোয়াম্প ফরেস্ট নয়, বরং পুরো জার্নিটা মিলে আপনার পয়সা উসুল হয়ে যাবে।

রাঙামটি সদর থেকে ছোট হরিনা পৌঁছতে আপনার সময় লাগতে পারে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা। সেদিনই সোয়াম্প ফরেস্টের দিকে যাত্রা করা সম্ভব হবে না। রাত কাটাতে হবে ছোট হরিনাতে। একপাশে পাহাড়, মাঝে কর্ণফুলি নদীর তীরবর্তী পাহাড়ি জনপদ ছোট হরিণা- এক কথায় অসাধারণ। ছোট হরিণা বাজারটি খুব বড় নয়। কিছুক্ষণ হাঁটলেই দেখা শেষ হয়ে যাবে। দুপুরের পর থেকে প্রায় তিনঘন্টা বাজার বন্ধ থাকে। বিদ্যুৎ বলতে জেনারেটরেই ভরসা। জেনারেটর থাকে সন্ধ্যে ছয়টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। ঠেগামুখের আগে এটাই এই এলাকার শেষ জনবসতি। ছোট হরিনাতে বিজিবির আরেকটি ক্যাম্প আছে। এখানে পৌঁছে প্রথমেই আপনাকে ক্যাম্পে হাজিরা দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে রাখতে ভুলবেন না।
ঠেগামুখ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শেষ গ্রাম। ঠেগামুখ থেকে কয়েকশ গজ সামনেই ভারতের মিজোরাম। ঠেগামুখের আগেই ছোট হরিনার অবস্থান। সীমান্ত এলাকার বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা অসহিষ্ণু হওয়ায় ছোট হরিনার পরে বাংলাদেশিদের যাওয়ার অনুমতি নেই। এমনকি ছোট হরিনাতে যেতে হলেও বেশ বাঁধার মুখোমুখি হতে হবে।
এইসব বাধা বিপত্তি পার করে আগে অনেক অভিযাত্রী ছোট হরিনায় এসেছেন। গিয়েছেন সেখানকার সোয়াম্প ফরেস্টেও। তানভীর নামের একজন অভিযাত্রীর কথা শোনা যায়। তিনি ২০১৪ সালে একা এসেছিলেন ছোট হরিনার সোয়াম্পে। সারারাত কলা ব্যবসায়ীর নৌকায় ভ্রমণ, পরদিন বিজিবির হাতে ধরা পড়া, তারপরে কারবারির সহায়তা নিয়ে হরিনার সোয়াম্প ফরেস্টও ঘুরে এসেছিলেন তিনি।
সাইদুল ইসলাম সোহান, বিজয় বাবু, সমীর মল্লিক নামের আরো তিনজন অভিযাত্রী বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে বিভিন্ন সময়ে এসেছেন হরিনা ও থেগামুখের এই অঞ্চলে।
অপু নজরুল নামের আরেকজন অভিযাত্রী বিজিবির সহায়তায় এই অঞ্চলে সময় নিয়ে ভ্রমণ করেছেন।
শাকিল অরণ্য নামের একজন গবেষক তার রিসার্চ-টিম নিয়ে গিয়েছিলেন হরিনার সোয়াম্প এবং থেগামুখ ও কর্ণফুলির উৎসমুখের এই জলমগ্ন এলাকায়।
এছাড়াও অনেক এডভেঞ্চার প্রেমী নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন সময় ভ্রমণ করেছেন হরিণা ছড়া সোয়াম্প ফরেস্ট ও আশেপাশের অঞ্চলে। এনজিও ও সরকারি কাজে দায়িত্বশীল বিভিন্ন টিম এই অঞ্চলে এসেছে মাঝেমধ্যেই। কিন্তু পপুলার কালচারে এই বন এখনো একদম নতুন।
বাংলাদেশের যেকোন স্থান থেকে প্রথমে রাঙামাটি আসতে হবে। ঢাকার সায়েদাবাদ, কলাবাগান, ফকিরাপুল অথবা গাবতলি থেকে শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, এস আলম , বিআরটিসিসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস ছেড়ে যায় রাঙামাটির উদ্দেশ্যে।
চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটিতে যাওয়ার সরাসরি দুটি বাস আছে। একটি হলো পাহাড়িকা। এই বাস সার্ভিসটি প্রতি ১ ঘন্টা অন্তর অন্তর স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় এবং গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় নেয়। পাহাড়িকা বাস সার্ভিসের টিকিট মুরাদপুর ও অক্সিজেন মোড় থেকে সংগ্রহ করা যায়। আরেকটি বাস হচ্ছে বিআরটিসি বাস সার্ভিস। এটি রাঙামাটির একমাত্র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিস। এই বাসের টিকিট চট্টগ্রাম শহরের বটতলী রেলওয়ে স্টেশনের বিআরটিসি কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করা যাবে।
রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণা পর্যন্ত ৭৬ কিলোমিটারের জলপথ। প্রথমে রিজার্ভ ট্রলার, লাইনের লঞ্চ কিংবা ভাড়ার ট্রলারে যেতে পারেন রাঙামাটি থেকে বরকল। বরকল সদর ইউনিয়ন বা বরকল উপজেলা পরিষদ ঘাটে অথবা বরকল বাজার ঘাটে নামতে হবে আপনাকে। সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। বরকলে বিজিবি ক্যাম্প আছে। ছোট হরিনা যেতে হলে টুরিস্টদের এখানে নাম-ঠিকানা এন্ট্রি করে যেতে হবে।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকেও ছোট হরিনা যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে খুব সকালে দীঘিনালা থেকে মোটর বাইকে লংগদু রওনা দিতে হবে। দীঘিনালা থেকে লংগদু যেতে সময় লাগবে ১ ঘন্টার মত, দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। লংগদু থেকে ট্রলারে করে শুভলং বাজার। শুভলং বাজার থেকে দুপুর আড়াইটায় ছেড়ে যায় বরকলের শেষ লঞ্চ। বরকল হয়ে হরিণা যেতে সময় লাগবে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। লঞ্চ না পেলে শুভলং বাজার থেকে ট্রলারে করে বরকল ও বাঙালটিলা হয়ে আপনি পৌঁছতে পারবেন ছোট হরিনায়। সেখান থেকে সোয়াম্প ফরেস্ট।
তবে, শুকনো মৌসুমে এই যাত্রার মাধ্যমগুলোতে কিছুটা ব্যতিক্রম আসে। তখন রাঙামাটি থেকে সরাসরি কান্ট্রি বোটে বরকল । বরকল থেকে ভূষণছড়া। ভূষণছড়া থেকে ভাড়ায় চালিত বাইকে ছোট হরিণা ঘাট। তারপর নৌকায় পার হলেই ছোট হরিণা বাজার। ছোট হরিনা থেকে পাশের লুসাই পাড়া হয়ে নৌকায় সোয়াম্প ফরেস্ট।
কোথায় থাকবেন
প্রাথমিক পর্যায়ে রাঙামাটি এসে খানিকটা বিরতির জন্য রাঙামাটি শহরে থাকতে পারেন । হোটেলের মধ্যে অন্যতম হোটেল সুফিয়া, সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল প্রিন্স ইত্যাদি। হোটেলের নন এসি সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা এবং ডাবল রুম ৮০০-১৫০০ টাকার মধ্যে। আর এসি সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ১০০০-১৮০০ টাকা, ডাবল ১৫০০-২৫০০ টাকার মধ্যে।
ছোট হরিনায় থাকার তেমন ভালো আয়োজন নেই। থাকতে হবে বাজারের কোন বোর্ডিংয়ে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে, বাজারের কাছেই লুসাই পাহাড়ের কোলে ছোট একটি পাড়া আছে। ওখানকার আদিবাসী চাকমা বা মারমাদের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা যায়। এখানে থাকা ও খাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করার জন্য আপনার নৌকার মাঝি আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। স্থানীয় আদিবাসী বাথুয়া রাখাইনের ঘরে থাকতে পারেন রাতে। ওখানে খাওয়ার সুবিধা নিলে, থাকা ফ্রিতে পেয়ে যেতে পারেন।
খাওয়া দাওয়া
রাঙ্গামাটিতে বিভিন্ন মানের খাবার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। রেস্টুরেন্টে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী বাঙালী, পাহাড়ি সব খাবার পাওয়া যায়। আপনি যেকোন রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিতে পারেন। তবে, অর্ডার করার আগে মেনুতে দাম দেখে নিলে ভালো করবেন।
ছোট হরিনায় কয়েকটি খাবারের হোটেল আছে। কিন্তু, আগে থেকে জানিয়ে না রাখলে খাবার পাওয়া মুশকিল হবে। বাজারে বাথুয়া রাখাইনের ওখানে ভালো খাবার পাবেন। বাঙালি স্বাদের খাবার রান্নায় বাথুয়া বেশ পারদর্শী। কর্ণফুলির টাটকা মাছের সঙ্গে ঝাল করে রান্না করা দেশি মুরগি দিয়ে খাওয়া দাওয়া বেশ উপভোগ্যই লাগবে।
খরচ
ঢাকা থেকে সরাসরি নন এসি বাস ৬২০ টাকা । এসি বাসে ভাড়া ১৫০০ টাকা। সাধারণত সকাল ৮ টা, ৯ টা এবং ১০ টায় প্রতিটি কোম্পানির ২ টা করে বাস ছাড়ে। আবার রাতে ৮ টা থেকে ১০ টার মধ্যে প্রতি কোম্পানির দুইটা করে বাস ছাড়ে।
চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটির পাহাড়িকা সার্ভিসের টিকিটের মূল্য ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটির বিআরটিসি বাসের ভাড়া ১৫০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে হবে।
তারপর, রাঙ্গামাটি শহরের সেনানিবাস এলাকা থেকে রিজার্ভ বাজার পর্যন্ত অটোরিকশা ভাড়া পড়বে ১০০ টাকা। ছোট হরিনায় যাওয়া-আসা মিলে রিজার্ভ ট্রলার তিন দিনের জন্য নেবে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। লঞ্চের ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
ছোট হরিনা বাজার ও পাশের লুসাই পাড়ায় প্রতিদিন খাওয়া-দাওয়া ও রাতে থাকার জন্য জনপ্রতি খরচ হতে পারে ২৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকার মতো।
ছোট হরিনা থেকে সোয়াম্প ফরেস্ট যাওয়ার নৌকা ভাড়া, স্থানীয়দের সাথে দরদাম করে নিতে হবে। পাড়ার কারবারি কিংবা ছোট হরিনা বিজিবি ক্যাম্প থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে।
২ থেকে ৩ দিনের ট্রিপে সাধারণভাবে খরচ করলে ৬ থেকে ৮ জনের গ্রুপে জনপ্রতি খরচ পড়তে পারে ৩৫০০ থেকে ৪০০০ টাকার মতো। রাঙামাটি শহরে হোটেলে বিশ্রামের জন্য বিরতি দিলে এই খরচের সাথে হোটেলের বিল যুক্ত করে হিসাব করতে হবে। তবে, অবশ্যই মৌসুমভেদে এবং নানা জরুরী পরিস্থিতিতে এই খরচের মাত্রা বেশি হতে পারে।