1. [email protected] : চলো যাই : cholojaai.net
স্বর্গের মতো দ্বীপে ১০৭ বাংলাদেশি দাস
সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ০৭:২৬ অপরাহ্ন

স্বর্গের মতো দ্বীপে ১০৭ বাংলাদেশি দাস

  • আপডেট সময় সোমবার, ২ অক্টোবর, ২০২৩

বিদেশে ভালো চাকরির আশায় দেশ ছেড়েছিলেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মুস্তাফিজুর শাহীন (৫০)। পাড়ি জমিয়েছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতুতে। তবে শিকদার সুমন নামে এক বাংলাদেশি পাচারকারী শাহীনদের মতো ভুক্তভোগীদের ওই দ্বীপে নিয়ে যেত মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে। পরে তাদের বন্দি করে রেখে মারধর করে বিনা পারিশ্রমিকে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নিত। দেওয়া হতো হত্যার হুমকিও। আর এভাবেই শাহীনের মতো অনেকেই পরিণত হতেন আধুনিক দাসে। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের মধ্যে ভানুয়াতুতে আসা ১০৭ ভুক্তভোগী বাংলাদেশির মধ্যে শাহীন একজন। বাকিদের পরিণতিও শাহীনের মতোই। এটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোতে আধুনিক দাসত্বের সবচেয়ে বড় ঘটনা। অবশেষে ২০২২ সালে পাচারকারী সুমন ও তার তিন সহযোগীকে সাজা দেন ভানুয়াতুর আদালত। গত ৩০ সেপ্টেম্বর কাতারভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরায় এ ঘটনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

নিজেকে জীবন্ত লাশ মনে হতো শাহীনের। জীবনের এই করুণ পরিণতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জানান শাহীন। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের জুনে এই ঘটনার সূত্রপাত। টাঙ্গাইলের একটি বাস স্টেশনে পাচারকারী শিকদার সুমনের এক সহযোগীর সঙ্গে তার দেখা হয়। শাহীনকে বলা হয়, সুমন মাল্টিমিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী, বিশ্বব্যাপী তার পোশাকের ব্যবসা রয়েছে। সুমন দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড মিস্টার প্রাইসের হয়ে কাজ করে বলে জানানো হয়। শাহীন ভানুয়াতুর স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে কিছুদিন আগেই প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন

দেখতে পান, যার শিরোনাম ‘ভানুয়াতুতে আসছে মিস্টার প্রাইস’। সেখানে সুমন এবং ভানুয়াতুর একজন মন্ত্রীর উদ্ধৃতিও ছিল। ফলে বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য হয় শাহীনের কাছে।

দেশে শাহীনের পোশাকের ব্যবসা ভালোই চলছিল। তার পরও আরও ভালো জীবনের প্রত্যাশায় ঋণ নিয়ে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেন শাহীন। স্ত্রী-সন্তানকে বিদায় জানিয়ে কাজ করতে ভানুয়াতুর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাড়েন শাহীন। ভানুয়াতুর রাজধানী পোর্ট ভিলায় আসার পর শাহীনের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। সমুদ্রতীরবর্তী একটি বাংলোতে তাকে আটকে রাখা হয়। ভাত আর বাঁধাকপি খেয়ে বেশিরভাগ দিন কাটিয়েছেন তিনি। চলাফেরা ছিল সীমাবদ্ধ। হঠাৎ কোনো অনুষ্ঠানে মাংস খেতে দেওয়া হতো। সেখানে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই দিনের পর দিন তাদের দিয়ে কাজ করানো হতো।

২০২২ সালে এসে ভানুয়াতুর পাবলিক প্রসিকিউটর সুমন, তার স্ত্রী এবং দুই সহযোগীকে মানবপাচার, দাসত্ব, অর্থপাচার, হত্যার হুমকি ও দেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন। ভানুয়াতুর প্রধান বিচারপতি ভিনসেন্ট লুনাবেক রায় ঘোষণার সময় বলেন, শিকদার সুমন ভুক্তভোগীদের গাড়ির নিচে চাপা দেওয়া হবে, কুপিয়ে মারা হবে বা গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে, জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে তাদের ফ্রিজারে ঢুকিয়ে রাখা হবে, লাশের ছবি তুলে পরিবারের কাছে পাঠানো হবেÑ এসব হুমকি দিত।

শাহীন জানান, এসব হুমকি তারা বিশ^াস করেছেন এবং তার কারণও রয়েছে। ভানুয়াতুতে আসার পর সুমনের হয়ে কাজ করা এক বাংলাদেশি তাকে ঘুষি মারে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার কাছ থেকে জোর করে ১৪ হাজার ডলার নিয়ে যায়। আর টাকা দিতে না পারায় তাকে উল্টো ঝুলিয়ে ও রক্তাক্ত ছবি তুলে বাংলাদেশে পরিবারের কাছে পাঠানো হবে জানানো হয়। একদিন সুমনের লোকজন ঘুমাচ্ছিল, সেই সুযোগে শাহীন ও আরও দুজন সেই জেলখানার মতো বাংলো থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এরপরই পুলিশের কাছে গিয়ে সব খুলে বলেন ভুক্তভোগীরা।

জাল ব্যবসায়ী নথি, লাইসেন্স এবং ঘুষের মাধ্যমে পাচারকারীরা ভানুয়াতুর ইমিগ্রেশন পার হওয়ার ব্যবস্থা করে দিত। এরপর ভুক্তভোগীরা হয়ে যেত সুমনের দাস। স্থানীয় সংবাদপত্রের মতে, ভানুয়াতুতে আসার পর তাদের দিয়ে জোর করে নির্মাণকাজ, কাঠের আসবাব তৈরি ও বিক্রি করানো হতো। কাজ করতে অস্বীকার করলেই মারধর চলত। প্রতিশ্রুত চাকরি কিংবা বেতন কখনই দেওয়া হয়নি তাদের।

তদন্তে উঠে আসে, মূলত শাহীনের মতো লোকদের থেকে টাকা নিয়ে তাদেরকে সুবিধাবঞ্চিত অবস্থায় রেখে যাওয়াই ছিল সুমনের লক্ষ্য। শহরের কেন্দ্রে মি. প্রাইসের একটি দায়সারা গোছের শোরুম তৈরি করেছিল সুমন। আসলে সুমন দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানিটির ব্র্যান্ড আর লোগো বিনা অনুমতিতেই ব্যবহার করছিল। গ্রেপ্তার হওয়ার পর সুমন নিজেকে জিম্বাবুয়ের নাগরিক বলে দাবি করে। যদিও তদন্তকারীরা পরে আবিষ্কার করেন, তার পাসপোর্ট আদতে জাল।

বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের ষষ্ঠ বৃহত্তম উৎস বাংলাদেশ। এসব অভিবাসীর অনেকেই দালালদের ওপর নির্ভর করেন। প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশিকে বিদেশে ভালো চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করে এসব দালাল। বাংলাদেশের পাচার হওয়া ব্যক্তিদের ওপর ২০২২ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, বিশ্বব্যাপী পাচারের সবচেয়ে বেশি শিকার বাংলাদেশিরা।

ভানুয়াতুর ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান চার্লি উইলি রেক্সোনা বলেন, সুমন তার স্ক্যামটি আরও কয়েকটি দেশে চালু করার চেষ্টা করেছিল। কয়েকটি দেশে তারা এটি পরীক্ষাও করেছিল। এরপর তারা ভানুয়াতুর আইনে ফাঁক খুঁজে পেয়ে এখানেই প্রতারণামূলক কারবার চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

ওই ১০৭ ভুক্তভোগী বাংলাদেশি এই মামলার মূল সাক্ষী। কিন্তু ভানুয়াতু সরকারের কাছে তাদেরকে খাওয়ানো এবং রাখার ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়া সুমন ও তার সহযোগীদের বিচার করতেও অসুবিধার মুখে পড়তে হয়। ভানুয়াতুতে দাসপ্রথা এবং পাচারকে সংজ্ঞায়িত করার কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। তাই ভানুয়াতুর পাবলিক প্রসিকিউটর জোসিয়া নাইগুলেভু চার আসামির বিরুদ্ধে তার অভিযোগ গঠনে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক কনভেনশনের ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

সুমন এখন ভানুয়াতুর কারাগারে ১৪ বছরের সাজা ভোগ করছে। তার স্ত্রী এবং দুই সহযোগীকে এর অর্ধেক বছর সাজা দেওয়া হয়েছিল। তবে এ বছরের শুরুতে তাদেরকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয় এবং জরিমানা দেওয়ার পর বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শাহীন এ মামলার অন্যতম প্রধান সাক্ষী। তাই তার আশঙ্কা বাংলাদেশে ফিরে এলে সুমন এবং তার সহযোগীরা তার ক্ষতি করতে পারে। তাই ভানুয়াতুতে থাকা নিরাপদ মনে করে শাহীন তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে সেখানে নিয়ে গিয়েছেন। ভানুয়াতুতে তার অভিবাসন মর্যাদা এখনো মেলেনি। এছাড়া জাতিসংঘের মাধ্যমে শরণার্থী মর্যাদা অর্জনের জন্য তার আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। তবে তিনি আশা ছাড়েননি। ভবিষ্যতে কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোনো দেশে স্থায়ী হতে চান শাহীন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Developed By ThemesBazar.Com