শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১১:২১ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

স্বপ্ন দেখতে শিখুন

  • আপডেট সময় শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১

সাধারণত স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে পড়লে আমরা যে সব দৃশ্যকল্প দেখি তা-ই স্বপ্ন বলে জেনে এসেছি। জানাটা সত্য বটে। আমরা সারাদিন কাজ করে পরিশ্রান্ত হই। এই সব কর্মক্লান্তি মস্তিষ্কে লোড হয়ে থাকে। এই স্বপ্ন মূলত ঘুমের সময় মস্তিষ্কে লোড কমাবার জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ারই ফলাফল। তবে আমি এখন এই স্বপ্নের কথা বলব না। বলব, জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্নের কথা। এই স্বপ্ন চোখে-মুখে লেগে থাকা এমন কোন স্বপ্ন। যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না। বরং এই স্বপ্নই মানুষকে জাগিয়ে দেবে। বলবে ওঠুন, কাজে লেগে পড়ুন। ফলে ভেতর থেকে একটা তাড়না অনুভূত হবে। এতে একটা দুর্দমনীয় আগ্রহ ও উদ্যোম সৃষ্টি হবে। এমন স্বপ্ন সম্পর্কেই ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও খ্যাতিমান পরমানু বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, “স্বপ্ন তা নয় যা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন হচ্ছে তা-ই যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।” অর্থাৎ শয়ন-স্বপনে, জাগরণে-কল্পনায়-ধ্যানে একটা লক্ষ্যের অনুরণন মানুষকে কর্মে উদ্দীপ্ত করে। কর্মব্যস্ত করে তুলে সার্বক্ষণিক, তা-ই হলো স্বপ্ন।

হ্যাঁ, কর্মব্যস্ত এই পৃথিবীতে মানুষের এই স্বপ্ন বা কল্পনাই মানুষকে আজকের এই সভ্যতায় এনে দাঁড় করিয়েছে। মানুষ বাঁচে এই স্বপ্নকে অবলম্বন করেই। তাই তো মানুষ তার মনের পর্দায় আঁকে ভবিষ্যতের সাফল্যের ছবি। অদূর ভবিষ্যতে নিজেকে কোন অবস্থানে বা কীভাবে দেখতে চায়। মন তা কল্পনার রং তুলিতে অবলোকন করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। কারণ, যুক্তি বা জ্ঞানের চেয়ে স্বপ্ন বা কল্পনা অনেক বেশি শক্তিশালী। তবে স্বপ্নের সাথে কল্পনা যখন বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয় তখনি তা পরিণত হয় মনছবিতে। অর্থাৎ ভবিষ্যেতের বাস্তবতায়। বলা যায়, মনছবি হচ্ছে মানুষ যা চান তা সুনির্দিষ্ট ভাবে চাওয়া। তা পাব বলে বিশ্বাস করা আর পাচ্ছি বলে অনুভব করা। অর্থাৎ চাওয়া-পাওয়ার যে প্রক্রিয়া এর সাথে নিজেকে পুরোপুরিভাবে সম্পৃক্ত করে ফেলা।

আসলে সাফল্যের প্রক্রিয়া সক্রিয় হয় আমাদের কল্পনার দ্বারা। কল্পনাই আমাদের লক্ষ্যের ছবি মনের মুকুরে এঁকে দেয়। আর অবচেতন মন স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য দিবানিশি কাজ করবে। এই ছবিই আপনার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পুরো পাল্টে দেবে। কারণ, আপনি যা সত্য বলে কল্পনা, চিন্তা ও বিশ্বাস করেন আপনার নার্ভাস সিস্টেম সেভাবেই প্রতিটি কাজ করবে। আর আপনাকে নিয়ে যাবে আপনার লক্ষ্য পানে।

এই স্বপ্নকে অনেকে দিবাস্বপ্ন বলে থাকেন। কারণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশী বা স্বপ্নদর্শী মানুষ জাগ্রত অবস্থায়ও দেখে কল্পনার রংয়ে রাঙিয়ে। আর তা গেঁথে দেন মস্তিষ্কে। তবে বিজ্ঞানী ডিরড্রি ব্যারেটেররের গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা নিখুঁত স্বপ্নের মতো মানসিক অবস্থায় উপনীত হতে পারে তাদেরই সাফল্যের জয়টিকা হাতের মুঠোয় ধরা দেয়। সত্যটা এই যে, মানুষ নিজেকে বিশ্বাস করলে সে একদিন অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।
এ পৃথিবীতে সফল মানুষের ইতিহাস পড়লে দেখা যায় যে, তাদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে এমনি গোটা বিশ্বাস নির্ভর চাওয়া। যেমন নেলসন ম্যান্ডেলা, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। তার আদর্শ ছিল শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনের অবসান। আর মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জন তথা কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তি। এ অপরাধে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের কারাগারে বন্দী ছিলেন ২৭ বছর। কারাগারে একটা নির্জন, অন্ধকার সেলে তাকে রাখা হয়েছিল। যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছত না। কারাগারে থেকে মুক্তির পর তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কারাগারে তিনি কী করতেন? তিনি বললেন, মনছবি। মনছবি মানে স্বপ্ন+ বিশ্বাস দৃপ্ততায় চাওয়া। সব সময় স্বপ্ন দেখেছি মুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার। আমরা কৃষ্ণাঙ্গরা দেশ শাসন করছি। আর আমি তার নেতৃত্ব দিচ্ছি। ম্যান্ডেলা আলোচনার টেবিলে শ্বেতাঙ্গদের পরাজিত করে। আর কৃষ্ণাঙ্গ শাসন কায়েম করেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই মহানায়ক, লাখো মানুষের মূর্তপ্রতীক।

চীন সাধারণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুং। একজন কৃষক পরিবারের সন্তান। তিনি স্বপ্ন দেখতেন শোষিত, বঞ্চিত চীনবাসীর মুক্তির। দেখতেন মনছবিও। স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এল বাঁধার পর বাঁধা। লং মার্চ-এ শতকরা ৯০ জন নিহত হল। তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। মনোবলও হারাননি। মনছবিতে তখনো তিনি বিশ্বাস দৃপ্ততায় ছিলেন অটল। অবশেষে এই অবিসংবাদিত নেতা দুই শতাব্দীর বঞ্চনার ব্যূহ ভেঙ্গে মুক্ত করলেন চীনকে। চীন আজ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির অধিকারী।

জর্জ ফোরম্যান ১৯৭৪ সালে মুষ্টিযুদ্ধের খেতাবী লড়াইয়ে মোহাম্মাদ আলীর হাতে নক আউট হন। বঞ্চিত হন হেভিওয়েট শিরোপা থেকে। ২০ বছর পর ১৯৯৪ সালে তার বয়স যখন ৪৫ বছর। তখন ২৬ বছর বয়েসী মাইকেল মুরারকে পরাজিত করেন। বক্সিংয়ে-এর খেতাবী লড়াইয়ে জিতে তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করলেন। সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে এই বিজয়ের স্বপ্নই তো সব সময় দেখেছি। হ্যাঁ, তিনি স্বপ্ন লালন করেছেন, বিশ্বাস দৃপ্ততায় মনছবি দেখেছেন। তবে তিনি মূলত এটাও প্রমাণ করলেন, বয়স বাড়লেই মানুষ তার স্বপ্ন বিসর্জন দেয় না। মানুষ মনে-প্রাণে যা চান তা-ই পান।

প্রখ্যাত লেখক জুলভার্ন জীবনের সবচাইতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই “আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ” (Around the world in 80 dayes) এই বইয়ের নায়ক ফিলিয়াস ফগ বাজি ধরে মাত্র ৮০ দিনে ভূ-প্রদক্ষিণ বা বিশ্বভ্রমণ করেন। পথে হাজার বাধাবিপত্তি, কত সমস্যাসংকুল দুর্ঘটনা! কিন্তু তার স্বপ্ন, তার কল্পনা এতটাই বিশ্বাস নির্ভর ছিল যে,সবকিছু  উৎরে মাত্র ৮০ দিনেই এক অসাধ্য তিনি সাধন করলেন।

আরো বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, এই বই পড়ে  নিশাত মজুমদার স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন। তার মনে হয়েছিল এত্ত কষ্ট-দুঃখ আর বাধাবিপত্তি পরও ফিলিয়াস ফগ যদি সফল হয় তবে আমি কেন চেষ্টা করলে একদিন এভারেস্টের চূড়ায় ওঠতে পারব না? শুরু হল তার স্বপ্ন দেখা।
আর তা বাস্তবায়নে প্রাণান্তকর চেষ্টা অব্যাহত রাখা। হ্যাঁ, এই স্বপ্নের আর আত্মবিশ্বসের জোরে একদিন সত্যি সত্যিই সে এভারেস্টের চূড়ায় উঠল নিশাত। বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী নারী নিশাত মজুমদার। কীভাবে পেরেছে? কারণ তার ভেতরে একটা তীব্র স্বপ্ন ছিল আর ছিল দুর্জয় আত্মবিশ্বাস। ফলে তা বাস্তবায়নের লক্ষে নিরলস নিবেদিত থেকেছে। মূলত স্বপ্নই তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে। ওর আগে এভারেস্ট – এ উঠেছিল মুহিত। হ্যাঁ, তার বুকেও একটা তীব্র স্বপ্ন  লালন করেছিল। আর সেটা হলো, আমি পারব।

আরো ছিল একটা দুর্জয় আত্মবিশ্বাস, আমি পারব, অবশ্যই পারব। হ্যাঁ সে পেরেছিল। তার উদ্যম, স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস তাকে এভারেস্টে শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল। তবে এটাও সত্য যে, স্বপ্ন দেখলাম কিন্তু তা পূরণে কাজ করলাম না। অলস আড্ডায় সময় পার করলাম। তাহলে সে স্বপ্ন কী সফল হবে? কখনো না। তাই তো বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেন, “স্বপ্ন মানে হচ্ছে লক্ষ্য, স্বপ্ন মানে গন্তব্য। আমি কোথায় যেতে চাই, তারই নাম স্বপ্ন।” আসলে, স্বপ্ন দেখা মানে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য উঠেপড়ে কাজে লেগে যাওয়া। হ্যাঁ, স্বপ্নের জন্য আমরা যতটুকু কাজ করি তা-ই আমাদর স্বপ্ন। মূলত স্বপ্ন বলে আলাদা কিছু নেই।

তবে আর দেরী কেন? আসুন, প্রচলিত ধ্যান-ধারনা আর ভাগ্যের ওপর দোষারোপের সংস্কৃতি ভেঙ্গে আমরাও স্বপ্ন দেখি গোটা বিশ্বাসকে একত্রিত করে। স্বপ্ন দেখব সোনালী ভবিষ্যতের। আমাদের তরুণ সমাজ মেধায়-মননে, বুদ্ধিতে- সম্ভাবনায় বিশ্বের উন্নত জাতিগুলোর সমতূল্য। তাদের এহেন অমিত সম্ভাবনা বিকাশের লক্ষ্যে তাদেরকে শৈশব থেকেই ভালো একটা লক্ষ্য দিন, একটা স্বপ্ন দিন। গেঁথে দিন তার মস্তিষ্কে। দেখবেন এই স্বপ্নই তাকে পৌঁছে দেবে তার আরাধ্য গন্তব্যে।

পিয়ারা বেগম

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com