সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৬ পূর্বাহ্ন

সোনার কেল্লার দেশে

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০২৩

মাঘপূর্ণিমার  সময় জয়সলমির যাওয়ার একটি প্রধান আকর্ষণ হলো, দেশ-বিদেশের পর্যটকরা সারা বছর ধরেই যে দিনগুলোর জন্য অন্তহীন অপেক্ষা করে থাকে, সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত বর্ণময় মরু উৎসবে শামিল  হওয়া। গত বছরে উৎসব ছিল ফেব্রুয়ারির চার থেকে ছয় তারিখ। কোলকাতা থেকে সেই মতো আমরা ৫ জন  রওনা দিই  জানুয়ারির শেষ দিনে। ২৩০৭ যোধপুর এক্সপ্রেসে। হাওড়া থেকে যোধপুরের দূরত্ব ১৯৩০ কি, মিঃ। মাঝে একটা দিন ট্রেনে কাটিয়ে ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে মধ্যাহ্নের কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে যোধপুরে পা রাখলাম। নতুনভাবে সাজানো গোছানো হয়েছে স্টেশন। ওভার ব্রিজ থেকে যে ছবি দেখলাম,তাতে মন ভরে গেল। হালকা ধোঁয়াশার আস্তরণ ভেদ করে দেখা যাচ্ছে, একদিকে মেহেরনগড়, অন্য দিকে উমেদভবন প্যালেস। স্টেশনের সামনে একটি ধর্মশালায় উঠলাম। আয়োজন ভালো।

রাতের ৪৮১০ জয়শলমির এক্সপ্রেস ট্রেনটি ধরবো। জিনিসপত্র রেখে বাজারে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। সোজাতি গেটের কাছে দোকানগুলিতে চোখে লাগার মতো বিপুল সম্ভার নিয়ে শীতবস্ত্রের অসংখ্য সারি সারি বিপনণ কেন্দ্র দেখলাম। মরুভূমির শীতের কথা ভেবে আমরা পঞ্চপান্ডব রেজাই কিনতে বাধ্য হলাম। রাতের ট্রেন ধরে পরের দিন ভোর  পাঁচটায় পৌঁছলাম জয়শলমিরে। হাড়হিম করা শীতের কামড়। কাবু  হওয়ার আগে ধূমায়িত চায়ের সন্ধানে।  ওয়েটিং রুমের সামনেই পেলাম ধূমায়িত চায়ের দোকান। তৃপ্তি নিয়ে চা পান করলাম দু’বার।

চারদিকে কিছুটা পরিস্কার হলো। একটা পছন্দ মতো থাকার জায়গার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। ভরা সিজিনে খালি পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।টোটোতে মালপত্র তুলে হোটেল খুঁজতে গিয়ে  বিরাট অভিজ্ঞতা লাভ হলো। মরু উৎসবে হোটেলের রেট আকাশ ছোঁয়া। সাধারণ মানের হোটেল গুলো বিদেশীদের  লোভনীয় ডলারের লোভনীয়  স্বাদ    পেতে মুখিয়ে আছে। আমাদের  অবস্থা ‘ঠাঁই নাই ছোটো সে তরী’। অবশেষে রামগড় রোডে ঘর পাওয়া গেল। শীতের কুয়াশা ছিঁড়ে সূর্য উঠছে। উল্টোদিকে হোটেল জওহর নিবাস প্যালেস। কিছু দূরে টিলার উপর থেকে হাতছানি দিচ্ছে ব্যাসছেত্রি, তার মনোমুগ্ধকর নাম সানসেট পয়েন্ট। নীচে দৃষ্টি নন্দন পোলো গ্রাউন্ড, যেখানেই তিন দিন পর উটের পিঠে বসে পোলো খেলা,উটের দৌড় প্রতিযোগিতা দেখার দুর্লভ সুযোগ পাব। উৎসবের শুরু যেহেতু পরশু দিন,তাই হাতের সময় নষ্ট না করে  বেরিয়ে পড়লাম  পুরো শহর পরিদর্শনে। সংস্কৃতিও আভিজাত্যের  ছোঁয়া পরতে পরতে।

৩০০ টাকায় একটি টোটো ভাড়া করলাম। একে একে দেখলাম-

সোনারকেল্লাঃ ইতিহাস জয়সলমির শহরের পরতে পরতে এমন ভাবে  মায়াচুম্বক হয়ে মিশে আছে যে এই শহর থেকে বেড়িয়ে ফিরে আসার পর তা যেন এক রূপকথার মায়াবী স্বপ্নের মতোই মনে হয়। ভারতবর্ষের পশ্চিমদিকের এই  শহরে একটু হেঁটে বেড়ালেই  মধ্যযুগের এক বর্ণময় রাজস্হানকে  অনুভব করা যায়। যাদব বংশোদ্ভুত ভাট্টি রাজপুত রাওল জয়শল প্রাচীন রাজধানী লোদুর্ভা ছেড়ে এসে ১১৫৬ খ্রিস্টাব্দে ত্রিকুট পাহাড়ের উপর বর্তমান জলশলমিরের ভিত্তি স্হাপন করেন। ভারত থেকে পশ্চিমে পারস্য  হয়ে আরব,মিশর, আফ্রিকা হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত যে বিস্তৃত বাণিজ্য পথ  তারই পথের উপর প্রতিষ্ঠিত হল জলশলমির শহর। বণিকদের দেওয়া সমস্ত অর্থ দিয়েই এই শহরের সমৃদ্ধি ঘটানো হয়েছিল।বদলে যাওয়া সময়ে সামুদ্রিক বাণিজ্যের বাড়বাড়ন্তের ফলে স্হল পথের বাণিজ্য ক্রমশ কমে যায়।

আজও শহরের সরু সরু গলিপথ, রাস্তার দুপাশে দোকানিদের পসারি সাজিয়ে বসার সনাতনী ঐতিহ্যের মধ্যে আরব্য রজনীর হলুদ পাতা থেকে উঠে আসা এক  রহস্যময় রোমাঞ্চকর শহরের স্বাদ  পাওয়া যায়। এই শহরের প্রধান আকর্ষণ ভ্রমণপিপাসু বাঙালির অতি পরিচিত ভালোবাসার জায়গা সোনার কেল্লা।কেল্লার  পুরোনো  নাম  ভুলে সত্যজিৎ রায় কৃত নামটি মান্যতা পেয়েছে ও সরকারি ভাবে আজ তার  স্বীকৃত। সোনালী হলুদ বেলে পাথরে তৈরি ৮০০বছরের পুরানো এই ঐতিহাসিক দুর্গ ।

মধ্যযুগে উটের ক্যারাভান নিয়ে সূদূর মধ্য এশিয়া যাবার পথে ধনী ব্যবসায়ীরা উটের পিঠ থেকে এই দুর্গকে যেমন   দেখতেন, আজ ও  একই  ভাবে তা আকর্ষণ করে পর্যটকদের। বিরাট প্রাচীর ঘেরা সোনার কেল্লা দুর্গটি আধুনিক জলসলমির শহরের প্রায় এক চতুর্থাংশ। অসাধারণ স্হাপত্যের নিদর্শন ও ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। কেল্লাটা লম্বায় ৪৫৭ মিটার, চওড়ায়  ২২৮মিটার। প্রথম রক্ষণ প্রাচীর ১৫ফুট উঁচু। কেল্লার মূল প্রাচীর ধরে রাখার জন্য ৯৯টি বুরুজ আছে।টারেটের উপর সাজানো পাথরের গোলা। চোখ ধাঁধানো গঠন শৈলী। মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।

চড়াইভাঙা পথে অক্ষয়পোল, গণেশ পোল, সূরজপোল আর হাওয়া পোল নামে ৪টি তোরণ পেরিয়ে পৌঁছলাম  দশেরা চক ও  রয়েল প্যালেসে। এটাই দুর্গের ভিতরের দিকে। দেখলাম মিউজিয়াম। মুগ্ধ হলাম।হলুদ পাথরের অপূর্ব জারির কাজ। কিছুটা উঁচুতে বিরাট শ্বেতপাথরের সিংহাসন। এরপর আমরা এলাম দেওয়ান-ই-আমে। সেখানে দেখলাম আর একটি বিরাট পাথরের সিংহাসন। জানলায় লাল, সবুজ, নীল বেলজিয়াম কাঁচের কাজ। ইন্টার লকিং পদ্ধতি তে পাথরের সঙ্গে পাথর জুড়ে পুরো দুর্গ তৈরি হয়েছে।  এই সব  দেখে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লাম। কেল্লার মধ্যে আম-জনতার বসবাস।কাফেটেরিয়া, কিউরিও শপ, হোটেল, স্কুল, মন্দির, বাজার, মুদিখানা, খোলা নর্দমা, যত্রতত্র গবাদিপশুর বিষ্ঠা নিয়ে  জয়শলমিরের নিজস্ব মেজাজে  আস্ত একখানা বিস্ময়কর মনোমুগ্ধকর শহর।

অপরূপ কারুকার্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি জৈন মন্দির। মন্দিরের বেসমেন্টে দ্বাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত পণ্ডিত জিনভদ্র সুরির জ্ঞানভাণ্ডার বা লাইব্রেরিটি বিশেষ আকর্ষণীয়। কেল্লার ভিতর পনের শতকের তৈরি বেশ কিছু ভাস্কর্য আছে। এক-একটি অখণ্ড পাথরের উপর ভাস্কর্য, ভাস্করের উৎকর্ষের পরিচায়ক। রামের মূর্তি, আবেগপ্রবণ মা-ছেলের মূর্তি বেশ সুন্দর। দুর্গের উপর থেকে সার্থকভাবে উপভোগ করা যায় সোনালীশহর জয়শলমিরের বর্ণময় প্রাকৃতিক রূপ। শুধু কেল্লাই নয়, কেল্লার বাইরে ও যে সব আলিশান হাভেলি  আছে, সবগুলোই তৈরি হয়েছে এখানকার নিজস্ব সম্পদ হলুদ বেলেপাথর দিয়ে। দিনভর রোদের তারতম্যে হলুদ পাথরের বুকে নেমে আসে অদ্ভূত দ্যোতনা। স্বর্ণালী মায়াজাল ভেদ করে, অতীত সন্ধানী দৃষ্টিতে বারবার ধরা দেয় জয়শলমিরের একদা বিভাব-বৈভব।

দুপুরের খাওয়া সারলাম সাধারন একটি হোটেলে। কোন বিশ্রাম না নিয়ে আবার পথে নামলাম। কেল্লার বাইরে দেখবার মতো যে সব স্মৃতি-সৌধ আছে, তার নান্দনিক সৌন্দর্য অসাধারণ। এক এক করে দেখলাম, তাজিয়া টাওয়ার, পাটোয়াধ-কি-হাভেলি, নাথমলজি-কি-হাভেলি, সেলিম সিং-কি-হাভেলি এবং গাদিসর লেক।

এর মধ্যে তাজিয়া টাওয়ার বয়সে নবীন। এই মহল্লার নামকরা  মুসলিম স্হপতি সিলাভার্টস দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে যায়। যাবার  আগে রাজার উদ্দেশ্যে নির্মিত তাঁর এই শেষ দান অনুপম কীর্তির সাক্ষর। প্রতিটি সৌধর নির্মাণ শৈলী অনবদ্য।নাথলজি ছিলেন রাজ্যের অমাত্য। তাঁর  হাভেলি  তৈরির বরাত পেয়েছিল লালু আর হাতি নামে দুই ভাই। কিন্তু কাজের ধারায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট। প্রশ্নাতীত মুনশিয়ানায় কাঠের মতো ব্যবহৃত হয়েছে হলুদ পাথর। ঝরোকার উপরে সূক্ষ্ম লেসের মতো পাথরের জাফরি অত্যন্ত নয়ন সুখকর ও মনোমুগ্ধকর। দিনের আলো শেষ   হওয়ার  বেশ কিছু আগেই চললাম গাদিসর লেকের উদ্দেশ্যে। এটি যে কোন পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় স্হান । খুব সামান্য সময়েই পৌছে গেলাম। মূল শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ১০ কি, মি । আমাদের মন আনন্দে ময়ূরের নেচে উঠল, মরূভূমির বুকে অনন্ত  জলরাশি দেখে।

জলশলমির শহরের বিশেষ দ্রষ্টব্য এই মনোমুগ্ধকর লেকের দৃশ্য। বিশেষ করে পড়ন্ত বিকেল  বেলায়  এর  নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আমরা পঞ্চপান্ডব সৌভাগ্যবান, এবছর প্রচুর বৃষ্টিপাত  হওয়ায় লেক জলে টইটুম্বুর। মরুভূমির বুকে স্বচ্ছ জলের এই  রকম বিশালাকৃতির হ্রদ এক অত্যাশ্চার্য  সৃষ্টি। হ্রদের জলে দেখলাম রাক্ষোসী বড় বড় মাগুর মাছ। খাবার ছুড়ে দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে মাগুর মাছ গুলো ছুটে এলো। সে এক অনবদ্য দৃশ্য। নয়ন যুগল  সার্থক হলো। বেশ কিছু সময়  কাটালাম। সূর্য দেব  ডোবার জন্য সাজগোজ করছেন। জানান দিচ্ছে আর নয়,এবার ফেরার পালা। ক্লান্ত দেহ নিয়ে ফিরলাম হোটেলে। অপার্থিব তৃপ্তি লাভ করলাম সবাই। তখন সময় সন্ধ্যা ৭ টা। টিফিন পর্বশেষ শেষ করে হোটেলের ব্যালকোনিতে এসে সবাই জড়ো হলাম। চেয়ারে বসে রাতের মায়াবী জয়শলমির কে দুচোখ ভরে দেখছি। দিনের সঙ্গে রাতের জয়শলমিরের তফাৎ পর্যালোচনা করছি আপনমনেই। কেবলমাত্র সোনার কেল্লাই নয়, সোনালী শহর জয়শলমির  আরও হাজারো রকমের সৌন্দর্য দিয়ে আমাদের মন ভরিয়ে দিল। রাস্তার আলো গুলোর সৌন্দর্য ও মুগ্ধ হয়ে দেখলাম।এক শিল্পরূপময় ঐতিহাসিক ও আভিজাত্যের শহর। এখানকার  আলোক উজ্জ্বল রাত যেন আরব্যরজনীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রাত দশটায় রাতের খাওয়া পর্ব সারলাম। প্রথম দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। আগামী কাল আবার নতুন পথে, অন্য কোন জায়গায় নতুন কিছুর সন্ধানে বেড়িয়ে পরতে হবে।

মরুভূমির রাজ্যে নতুন সকালের অপেক্ষা। আমরা পঞ্চপান্ডব ঘুমের রাজ্যের বাসিন্দা। দ্বিতীয় দিন, সকাল হলো। মরূভূমির বুকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য অনন্য সাধারণ। শুধুই মুগ্ধতা । এই প্রথমবার এইধরনের অপার্থিব সৌন্দর্যের লীলাভূমি চর্মচক্ষে অবলোকন করলাম। সকাল ৮টায় টিফিন পর্ব সংক্ষেপে সেরে, শহরের প্রাণকেন্দ্র হনুমান চকে গেলাম জিপের খোঁজে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, দ্বিতীয় দিনে ঘুরবো–বড়াবাগ, লোদুর্ভা, রূপসি, লোধুরবা, অমরসাগর এবং সবশেষে তৃতীয় দিনে সাম স্যান্ড ডিউন্স। ১০০০টাকার একটি জিপ ভাড়া করে যাত্রা শুরু করেদিলাম। কিছু সময়ের মধ্যেই পৌছলাম বড়়াবাগে। জয়শলমিরের বর্ণময় এক  ভ্ররণের জায়গা। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সুন্দর মেলবন্ধন। বড়বাগ হলো সবুজ গাছগাছালির মাঝে রাজাদের সমাধিক্ষেত্র। সারিবদ্ধ ছত্রী বড়়ো  ফোটোজিনিক।

নিরিবিলিতে বিরাজমান। জানলাম, রাজাদের মৃত্যুর পর এখানে মৃতদেহ দাহ করে- তাদের উদ্দেশ্যে ছত্রি বানানো হতো। হলুদ পাথরের ছত্রিগুলি একসাথে দেখতে খুবই ভালো লাগলো। রহস্যময়়তা ও নান্দনিকতার অপূর্ব  ছোঁয়া। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা, এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। স্মৃতি সৌধ হলেও  এ-এক পবিত্র প্রত্নভূমি। বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা পঞ্চপান্ডব যাত্রা করলাম। পরবর্তী গন্তব্য স্হল লোদুর্ভা। জয়সলমির থেকে দূরত্ব মাত্র ১৫ কি,মিঃ। এটি জৈন  জনপদ ভূমি ও এক সময়ের সুপ্রাচীন রাজধানী। দেখলাম, হাজার বছরের জৈন মন্দির। অসাধারণ স্হাপত্যের নিদর্শন। সোনালী হলুদ পাথরের  অসামান্য সব ভাস্কর্য। পাথরের জালির অপূর্ব কাজ। পাথরের বহু মূর্তি দর্শন করে তৃপ্ত হলাম। এবার যাত্রাপথ রপসির দিকে। রূপসি এমনই এক রূপকথার মায়াবী গ্রাম, যেখানে মরুভূমিকে হার মানিয়ে সবুজায়নের লক্ষ্যে মানুষজন নিরন্তন সচেষ্ট। মন ভরে গেল। সবুজের সমারোহ নিয়ে এক নির্মল প্রকৃতি, আমাদেরকে আলিঙ্গন করতে চাইছে। মন না চাইলেও বদল করতে হোল যাত্রাপথ। কিছু পরে উপস্থিত হলাম, ভাট্টি রাজপুতদের অতীত রাজধানী লোধুরবাতে। বিখ্যাত একটি নান্দনিক সৌন্দর্যের জৈন মন্দির দেখলাম।

তারপর অমরসাগরে পৌঁছলাম। এখানকার জৈন মন্দিরের পাথরের নকশা দেখার মতো। কাছেই মূলসাগর,মরুর মাঝে মরুদ্যান। মরুভূমির গ্রাম গুলোর চেহারা কেমন হয় তা সামে  যাওয়ার পথে দামোদরাতে নেমে এক ঝলক দেখে নিলাম। যাত্রা  পথের রূপ বদলাচ্ছে খুব দ্রুত।মন আনন্দে ভরে উঠছিলো। ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দুপুরের খাবার পর্ব গাড়িতে সারলাম। আমাদের এবার গন্তব্য স্হল সামে, যার জন্য মূলত রাজস্হানে আসা। জয়শলমির থেকে দূরত্ব ৪৫ কি, মিঃ। গাড়ির ড্রাইভার আমাদের বলেছিলেন, পূর্ণিমার রাতে সামে, রাত না কাটালে এতদিনের ভ্রমণের স্বপ্ন স্বার্থক হবে না। কথাটাকে মান্যতা দেওয়ার জন্য আমরা রাতে ওখানেই থাকার পরিকল্পনা করি। এটি একটি বালিয়াড়ি। ভাবলাম, এখানে এক রাত কাটানো হবে, আমাদের সারা জীবনের এক পরম সঞ্চয়। গাড়ি আমাদের এক জায়গায় নামিয়ে দিল।

উটের পিঠে চেপে চললাম বালিয়াড়ির মধ্য দিয়ে। সামনে-পিছনে দুলতে দুলতে এগোতে থাকলাম। সে-এক রোমাঞ্চকর যাত্রা, কোন দিন হয়তো ভুলতে পারবো না। কিছু সময়ের মধ্যেই আকন্দ গাছের ঝোপ আর কাঁটা গাছের মধ্য দিয়ে এগিয়ে পড়লাম বালির রাজত্বে। শুধুই বালি আর বালি। সূর্য এখন অস্তাচলে।বালিয়াড়ির বুকে ধীরে ধীরে অন্ধকার নামতে চলেছে। অস্তগামী সূর্যের মনোরম মায়াবী আলোয় চারিদিক ভরে যাচ্ছে। নরম-মোলায়েম আলোর ভিতর দিয়ে  আরব বেদুইনদের মতোই আমরা চলেছি। সাম বালিয়াড়ির নির্জনতা এখন  লেশমাত্র নেই । উট আর দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্টের ভিড়ে ও ক্যামেরার ঘন ঘন ঝলকানিতে পরিবেশের  সেই নির্জনতা একেবারেই অনুপস্থিত। সামনে গিয়ে দেখি দেশি-বিদেশি মানুষের থিকথিকে ভিড়। মরু উৎসবে মেলা বসেছে। মাঝখানে একটা জায়গায় বালি স্তূপ করে স্টেজ বানানোর কাজ চলছে।

একটা কৌতূহল জাগল মনের মধ্যে।পরে শুনলাম মরু উৎসবের শেষ দিন সারারাত ধরে এখানে জলসার আসর বসবে। এর ই মধ্যে অস্তরাগে আকাশ, মরুভূমির বালিয়াড়ি রাঙিয়ে গেল। অসম্ভব ভালো লাগছে, এই বর্ণময় মুহূর্তে। যা ভাষাতীত। স্মৃতিরোমন্হন করতে  করতে আমরা আমাদের কটেজে চললাম। রাজস্হান ট্যুরিজিম পরিচালিত কটেজ। সব রকমের সুযোগ-সুবিধা ছিল। এরপর শুরু হলো লোকসংস্কৃতি ও লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। ঐতিহ্যবাহী রাজপুতনা সংস্কৃতি এক জায়গায় দেখতে পাওয়ার দুর্লভ সুযোগ এই উৎসবের বড় প্রাপ্তি।মেজাজে যেমন রাজসিক, তেমনি বৈচিত্র্যময় ও নান্দনিক। মরু উৎসবের শুভ সূচনা হয় গাদিসর  লেক  থেকে। এটাই রীতি। শোভাযাত্রা শেষ হয় শহীদ পুনম সিং স্টেডিয়ামে। সমস্ত প্রতিযোগিতা মূলক অনুষ্ঠান এখানে হয়।উৎসব চলাকালীন সময়ে প্রতিদিন রাতে রং-বেরঙের আসতবাজি  পোড়ানো হয়। চা-টিফিন পর্ব সেরে উপস্থিত হলাম আমরা। স্হানীয় শিল্পীদের গান এবং বহুল প্রচারিত রাজস্হানী  নৃত্য উপভোগ করতে করতে সময় যেন কোথা দিয়ে কেটে গেল, বুঝতে পারলাম না। নানান বাদ্যযন্ত্রের সুমধুর আওয়াজ, তার সঙ্গে তাল-লয়ের সুসমন্বয়ে এক নতুন ধরনের মূর্ছনার সৃষ্টি করছিল। নিজেদের অতীত গরিমার গৌরব গাঁথা কীর্তন যেমন গানের ভাষায় উঠে এসেছে, তেমনি ধোলা-মারুর রূপকথা বা মুমল-মহেন্দর প্রেমগাথাও বাদ যায় নি। শিল্পীদের জোরটা পরম্পরাগত সুমহান ঐতিহ্যের । দেহ-মনে এক অনির্বচনীয় আনন্দ সৃষ্টি হলো। রাজস্হানী  মেয়েদের নৃত্যশৈলী আমাদের মুগ্ধ করলো। পরিবেশ হয়ে উঠেছিল এক অসাধারণ মাদকতাময়। আকাশ জুড়ে চাঁদের আলো-চারপাশে কুঁড়েঘর আর তার মধ্যে এরকম লোকসঙ্গীত–নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম এক অলৌকিক কল্পনার জগতে।

রাত দশটা নাগাদ ডিনার সেরে ফিরে এলাম নিজেদের কটেজে। আসল বিস্ময় তখনও অপেক্ষা করছিল। চাঁদনি রাতে খোলা বালিয়াড়ির উপর চেয়ার পেতে আমরা পঞ্চপান্ডব বসলাম। চারিদিকে শুধু মুগ্ধতার রেশ আর সীমাহীন নির্জনতায় এক অন্যভুবনে চলে গেলাম। দিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা বালিয়াড়ি, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। রাতের আকাশটা যেন সালমা চুমকি কাজের এক অনন্য নিদর্শন। জ্যোৎস্নায় স্নাত রূপসী মরু তার রুপটান সেরে তৈরি পথিকের মন ভোলাতে। তঙ্গায়িত বালির চিকন শরীরে বাসা বেঁধেছে কুহকিনী আলো-অন্ধকার। ভাবখানা এমন যে উটের পায়ে পায়ে ভেঙে যাওয়া বালির আলপনা পরতে মিলিয়ে দিতে হবে ভোর  হওয়ার আগেই।

প্রকৃতির এ-এক বিচিত্র বিনির্মাণ। রাত বাড়ছে। সময়  তখন রাত ১২টা। বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র–সামনে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি।প্রবল ঝোড়ো বাতাস বইছে। একটা শিহরণ জাগানো অনুভূতি গ্রাস করলো। বাতাসের তীব্র গর্জন শুনে মনে হচ্ছে সামনে যেন  সুবিশাল মরু সমুদ্র, যার কোন ভৌগোলিক সীমানা নেই। ভূগোল বই থেকে জেনেছিলাম, এক সময় থর মরুভূমি সমুদ্রের তলায় ছিল। জুরাসিক যুগে এখানে সমুদ্র ছিল, এটা ইতিহাস ও ভৌগোলিক সত্য বলে অনেকেই মনে করেন। উডফসিল পার্কে গিয়ে এর সত্যতা পেয়েছি। এই নির্জনতায় উঁচু টিলার উপর দাঁড়িয়ে একেবারে সামনের দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমির প্রান্তরকে  মন হতে লাগলো যেন জুরাসিক যুগের সেই রহস্য-রোমাঞ্চকর সমুদ্রকে চর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করছি। গভীর রাতে নিজদের কটেজে ফিরে আসলাম। চোখে ঘুম আসছে না। নানান ভাবনার স্রোত বয়ে চলেছে মনের অন্দরে।

কয়েক ঘণ্টা পরই মরুভূমির বুকে সকাল দেখার অপেক্ষায় রইলাম। পরদিন, তৃতীয় দিন। তারপর ফেরার পালা। রাত বিদায় নিল, ভোর হল। ভোরের মরুভূমির অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য ভোলার নয়। হয়তো বহুদিন, মনের মণিকোঠায় চিরজাগরূপ হয়ে থাকবে। বাতাসের মিষ্টি আমেজ, মন ভাল করে দিল। পূর্ব দিগন্ত রঙের হোলি খেলছে, সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই  বালিয়াড়ির বুকে এক মনোমুগ্ধকর আলোছায়ার খেলা শুরু হলো। আমরা নীরব সাক্ষী।

এবার ফিরতে হবে জয়শলমিরে, তারপর রাতের ট্রেনে কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেবো, তার পর সেই কেজো জীবনে প্রত্যাবর্তন।জিপে ফিরতে ফিরতে কয়েক দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগলাম। মনে মনে বিদায় জানালাম মরুভূমির প্রান্তরকে। সুযোগ হলেই আবার আসিব ফিরে,এই মরুভূমির বুকে, কোন এক সময়ে, হয়তো অন্য ভাবে ও রূপে। সেবার ছুঁয়ে যাবো সেই সব জায়গায়, যেখানে মানুষের পা বড় একটা পড়েনা। যেখানে পৃথিবী আরো আদিম। জয়শলমিরে ভ্রমনের আদর্শ সময় মরু উৎসবের সময়। জানুয়ারি-ফ্রেব্রুয়ারি মাস। এছাড়াও অক্টোবর থেকে মার্চ মাস। ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং শিল্প-স্হাপত্যের সোনালী  শহর জয়শলমির যে, কোন ভ্রমণপিপাসু মানুষ কে নিয়ে যায় আরব্য রজনীর পাতা থেকে উঠে আসা এক অনির্বচনীয় কল্পনার ভুবনে। সব মিলিয়ে বর্ণময় মরু উৎসবে এক অনন্য অভিজ্ঞতা লাভ। হয়ত অনেক দিন মনের মণিকোঠায় চিরজাগরূপ হয়ে থাকবে।

পথনির্দেশ- হাওড়া থেকে ট্রেনে যোধপুর। তারপর যোধপুর এক্সপ্রেসে জয়শলমির। প্রত্যেক জায়গায় অনলাইনে বুকিংয়ের সুযোগ আছে।রাজস্হান ট্যুরিজিম পরিচালিত কটেজ ও হোটেলে থাকতে পারেন। সব জায়গাতেই থাকার সুযোগ ও সুবিধা আছে। মরুভূমির বালিয়াড়ির উপর ভ্রমণে সময় কিছু  সাবধানতা অবলম্বন  করা উচিত। ক্যাম্ফ ফায়ারের উপকরণ সামগ্রী নিয়ে যাওয়া উচিৎ জয়শলমির থেকে ও সঙ্গে অবশ্যই মিনারেল ওয়াটার থাকা দরকার। প্রশাসনিক সহযোগিতা অসাধারণ।

ডঃ সুবীর মণ্ডল

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com