রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:১৮ অপরাহ্ন

সোনমার্গ হয়ে শ্রীনগর

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

কলকাতা থেকে উড়ান ছিল রাত সাড়ে এগারোটায়। দিল্লিতে ঘন্টা চারেক লে-ওভার নিয়ে প্লেন ছাড়ল সকাল ৫:৫৫ মিনিটে, শ্রীনগর ঢুকলাম সকাল সাতটায়। রাতের উড়ান একদিক থেকে ভালো, তাতে করে সকাল সকাল মূল বেড়ানোর জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যায়। শ্রীনগরে নেমেই বিপদে পড়লাম, দুজনের ফোনেই জিও কানেকশন অচল হয়ে পড়ল। এখন বাইরে অপেক্ষমান ড্রাইভারের সাথে যোগাযোগ করবো কিভাবে! লাগেজ কালেক্ট করে বাইরে বেরিয়ে কাউকে দেখে মনে হলনা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন৷ মুষ্টিমেয় যে কজন গাড়িচালক যাত্রী প্রতীক্ষায় ছিলেন প্রত্যেকেই নিজের নিজের পার্টি নিয়ে এয়ারপোর্ট চত্বর পরিত্যাগ করেছে। অগত্যা অচেনা একজনকে অনুরোধ করে তাঁর ফোন ব্যবহার করে আমাদের ড্রাইভার মহাশয়ের হদিশ মিলল। সময় নষ্ট না করে একটা সাদা ইনোভায় উঠে বসলাম।

শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের যাত্রাপথটি এককথায় কাব্যময়। দূরত্ব আন্দাজ ৮৭ কিলোমিটার, উচ্চতা ৩০০০ মিটার। শ্রীনগর শহরকে বাইপাস করে ছোট ছোট গ্রাম, খেতখামার, সবুজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে পার হয়ে গেলাম নাগবল, আরও দশ কিলোমিটার পর এল অপেক্ষাকৃত বড় শহর গান্দেরবল। গান্দেরবল উপত্যকা থেকে সঙ্গী হল সিন্ধু নালা। সবুজ উপত্যকার বুক চিরে বয়ে চলা নালা কিছুদূর গিয়েই উচ্ছল নদীতে পরিণত হয়েছে। তরুণী নালাকে এক পূর্ণগর্ভা নারী হতে সাহায্য করেছে বর্ষণপুষ্ট একাধিক ঝর্ণা। এই রাস্তা শোনমার্গ ছাড়িয়ে দ্রাস-কার্গিল হয়ে চলে গেছে লে-লাদাখ। সিন্ধুনদীর পাড়ে একটা রেস্তোরাঁয় চা-নাস্তা করে কঙ্গন, গুন্দ ইত্যাদি জনপদ পেরিয়ে এগারোটা নাগাদ সোনমার্গ পৌঁছলাম।

ছবি: চশমাশহী, মুঘল গার্ডেন

ছবি: চশমাশহী, মুঘল গার্ডেন

বরফে ঢাকা উপত্যকা দিনের বিশেষ বিশেষ সময়ে সূর্যের কিরণে সোনা রঙে রেঙে ওঠে, তাই জায়গাটির নাম হয়েছে সোনামার্গ। পথের দুপাশে চির, পাইন, চিনার, আখরোট, আপেল আর চেরি গাছের উপস্থিতি। তবে এই মে-জুন মাস কোনও ফলেরই সিজন নয়, কিন্তু ঘন সবুজ ফলফুলহীন গাছগুলো গোটা উপত্যকা জুড়ে একটা নান্দনিক মন্তাজ তৈরি করেছে। দুপুরে খাওয়ার পর আকাশ ভাঙা বৃষ্টি শুরু হল, তার সাথে তাল মিলিয়ে ঠান্ডা বেড়ে চলল। বৃষ্টি থামল সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ। সাতটার সময় একটু বেরোলাম। এখানে সন্ধ্যে নামতে রাত আটটা বেজে যায়।

পরের দিন সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম৷ আসার পথে নদীর উল্টো পাড়ে আকাশজোড়া যে বরফপাহাড় দেখেছিলাম সেটা আমাদের হাট থেকে দেখা যায় না। আজ ইচ্ছে ছিল হেঁটে সেই জায়গায় গিয়ে কয়েকটা ছবি ক্যামেরাবন্দি করবো। সেই মতো বেরোলাম, কিন্তু বেরিয়েই সিদ্ধান্ত বদলালাম। এখানকার অবশ্যদ্রষ্টব্য হল শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরের ‘থাজিওয়াশ হিমবাহ’। পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে যেতে হয়। ঠিক করলাম সকাল সকাল ঠান্ডার মধ্যে ট্রেকটা করেই ফেলি। কিলোমিটার খানেক পিচরাস্তা ধরে এগিয়ে মাটির পথ শুরু হল। গতকাল বৃষ্টির কারুণ্যে পথ ভেজা। অত সকালে আশপাশে কোনও লোকজনও চোখে পড়ছে না। ধীরে ধীরে চড়াই বাড়তে লাগলো, জঙ্গল শুরু হল, তবে রাস্তা বলে কিছু নেই। কাদাময় আশপাশ, যদিও রাস্তা জুড়ে ঘন সবুজ বন আর ঝকঝকে পাহাড়চুড়ার অনবদ্য আর্তি শরীরের কষ্ট কমিয়ে দিচ্ছে। অনেকটা ওপরে উঠে দূরে জঙ্গলের মধ্যে একটা তাঁবু নজরে এল।

কাছে গিয়ে দেখলাম তাঁবু নয়, খুব বেসিক একটা থাকার আস্তানা। জম্মু থেকে বহু মানুষ ঘোড়া নিয়ে এখানে ট্যুরিস্ট সিজনে চলে আসে। তারা এই অস্থায়ী আস্তানা বানিয়ে থাকে। তাদের সবাইয়েরই একই প্রশ্ন, “ঘোড়ি লাওগে সাব?” আমি একই উত্তর মন্ত্রের মত জপতে জপতে এগিয়ে চললাম। আস্তে আস্তে জঙ্গল ঘন হয়ে উঠলো, কেউ কোথাও নেই! কি করবো, কোন পথে এগোব ভাবছি, এমন সময় চোখে পড়ল একটা ক্ষীণকায়া টলটলে স্রোত জঙ্গলের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। বুদ্ধি খুলে গেল, এই নালা নিশ্চয়ই গ্লেসিয়ার থেকে আসছে! শুরু হল আবার পথচলা। নালা বরাবর এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষণ হাঁচরপাঁচর করতে করতে একটা প্রশস্ত উপত্যকায় পৌঁছলাম, যেখানে হয় আকাশ এসে বরফমোড়া পাহাড়ে মিলেছে, কিংবা উত্ত্যুঙ্গ কিরীটচূড়া মাথা তুলতে তুলতে আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। পাহাড়ের চুড়া থেকে পাদদেশ বরফের সাদা চাদরে ঢাকা। এটাই গ্লেসিয়ার, চক্ষু সার্থক হল, যদিও বরফের কোলে পৌঁছতে তখনও অনেক চড়াই বাকি।

ছবি: শালিমার বাগ, শ্রীনগর

ছবি: শালিমার বাগ, শ্রীনগর

ভাঙাচোরা পুল আর ছোটবড় বোল্ডার পেরিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম৷ একটা সমস্যা দেখা গেল, বরফের রাজ্যে পৌঁছতে গেলে নদীর অন্য পারে পৌঁছতে হবে। এখানে নদী খুব চওড়া না হলেও ভীষণ খরস্রোতা। কোথাও পারাপারের জায়গা পেলাম না। ফিরবো মনস্থ করছি এমন সময় দেবদুতের মত উপস্থিত হল বারো বছরের ‘মেহনাজ’, সঙ্গে তার ঘোড়া ‘পালোয়ান’। চড়ে বসলাম ঘোড়ায়, তারপর এক ঘন্টা সময় এত আনন্দে কাটলো কহতব্য নয়। মেহনাজ এখানেই তাঁবুতে থাকে, শুধু সে নয়, তার গোটা পরিবারই সিজনে এখানে চলে আসে৷ পাঁচ ভাই আর এক বোন, বাবা দুবছর আগে মারা গেছেন। ভায়েরা একেকটা তাঁবুতে নিজের নিজের পরিবার নিয়ে থাকে। মাঝরাস্তায় মেহনাজের এক ভাই স্লেজকিট নিয়ে হাজির৷ তারপর স্লেজিং থেকে শুরু করে অনাত্মীয় বাচ্ছাগুলোর সাথে বরফ ছোড়াছুড়ি খেলায় মেতে উঠলাম। ফেরার পথে দেখলাম হাজার হাজার ট্যুরিস্ট ঘোড়া নিয়ে ওপরে উঠছে। সওয়া এগারোটা নাগাদ ফিরে হোটেলে ব্রেকফাস্ট সারলাম।

সোনমার্গের আরেকটা জনপ্রিয় ঘোরার জায়গা হল জিরো পয়েন্ট। দ্রাস-কার্গিলের পথে, জোজিলা পাস পেরিয়ে সোনমার্গ থেকে দূরত্ব চল্লিশ কিলোমিটার। পরের দিন ব্রেকফাস্ট সেরে ঠিক সকাল আটটায় খলিলজীর শেভরোলে চড়ে বসলাম৷ লে-লাদাখ যেতে হলে শ্রীনগর বা মানালি হয়ে যেতে হয়৷ শ্রীনগর হয়ে পথের সৌন্দর্য্য অনবদ্য। সেই সৌন্দর্য্যের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা ট্রেলার চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হল। আমরা আজ সেই পথেই ৪০ কিলোমিটার এগিয়ে গেলাম, ওই চল্লিশ কিলোমিটারেই যা দেখলাম সেটা আগামী চল্লিশ বছরেও ভুলবো না। সোনমার্গ শহরটি খুব ছোট্ট, যেন মুঠোয় ধরা যায়। সারা শহরে সাকুল্যে কুড়ি-পঁচিশটা হোটেল আর গোটা পঞ্চাশেক দোকান। বছরে ছয়মাস বন্ধ থাকার কারণে এখানে মানুষের স্থায়ী বসবাস সেভাবে গড়ে ওঠেনি। গাড়িতে ছোট্ট শহর কয়েক মিনিটে পেরিয়ে চোখের সামনে প্রতিভাত হল নীল সিন্ধুনদ, সবুজ বনভূমি, উষর উপত্যকা আর ‘কিরিট ধারিনী তুষারশুভ্র’ পাহাড়ের সারি। পথ যেভাবে বাঁক নিচ্ছে নিচের উপত্যকায় সিন্ধু নদও তার সাথে তাল মিলিয়ে গতিছন্দে বদল আনছে। আস্তে আস্তে জোজিলা পাস পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বালতাল, সোনমার্গ থেকে ১৫ কিলোমিটার। বালতাল বিখ্যাত জায়গা, এখান থেকেই পুণ্যতীর্থ অমরনাথ যাত্রা শুরু হয়।

বালতাল ছাড়তেই চোখে পড়ল অমরনাথ পাহাড়, বরফানি বাবা। এই পাহাড়চূড়া পুরোটাই বরফে ঢাকা, কোথাও এতটুকু ধুসরতা নেই। রাস্তা পাহাড়কে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক কিলোমিটার গোল গোল হয়ে ঘুরতে লাগল। মাথার উপর শ্বেতশুভ্র বরফানি বাবা আর অনেক নিচে বয়ে চলা ঘন সবুজ সিন্ধুনদের পাশ দিয়ে অমরনাথ যাত্রাপথ দর্শন আমাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত আধ্যাত্মিক শান্তি জাগিয়ে তুলল। অমরনাথ বা বরফানি বাবার ঠিক পাশের পাহাড়টির পাদদেশটি হল জিরো পয়েন্ট। এটা একটা গ্লেসিয়ার। গত দুদিন বৃষ্টির কল্যানে পাহাড় ও পাহাড়তলি নতুন বরফে সেজে উঠেছে৷ এখানকার উচ্চতা প্রায় সাড়ে এগারো হাজার ফিট। গ্লেসিয়ারকে কেন্দ্র করে দোকানপাট, গাইড, ফটোগ্রাফার, স্লেজওয়ালা, স্নো বাইকার্স, হেল্পার যে যার মত উপার্জনে নেমে পড়েছে। অকুস্থলে গামবুট পরে দুই মহারথী পায়ে পায়ে বরফ রাজ্যে প্রবেশ করলাম।

প্রথমে ভেবেছিলাম নিচেই বরফের ওপর হাঁটাহাঁটি করে কিছুটা সময় কাটিয়ে দেব। কিন্তু কালক্রমে স্নো-বাইক, স্লেজ গাড়ি কিছুই বাদ গেলনা। স্নো-বাইক একেবারে গ্লেসিয়ারের চূড়ার কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম আর তার চেয়েও বেশি আছাড় খেলাম এবং অন্যদের খেতে দেখলাম। হেল্পার আছে, হাত ধরে একদম চূড়ায় নিয়ে যাবে। জিরো পয়েন্ট থেকে ফেরার পথে থামলাম একটা ফিসিং পয়েন্টে। কৃত্রিম জলাশয়ে ব্রাউন ট্রাউট মাছের চাষ হচ্ছে। তবে এই জায়গার সৌন্দর্য্য শতগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে উল্টো দিকে বয়ে চলা সিন্ধু নদ। এ যাত্রায় সিন্ধুনদকে যতটুকু দেখেছি এখানেই সে সবচেয়ে বেশি প্রশস্ত, দুর্বার স্রোতের গর্জন পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসছে।

সোনমার্গে তিনদিন কাটিয়ে শ্রীনগরের হোটেলে চেকইন করতে পৌনে দুটো বেজে গেল। খাওয়া সেরে ঘণ্টাখানেকের বিশ্রাম নিয়ে শেষ বিকেলে ঘুরতে বেরোলাম। ইচ্ছে একটু শিকারা ভ্রমণ করার কিন্তু দেখলাম সরকার নির্দিষ্ট রেটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে যা পারছে চাইছে৷ বহু দরাদরি শেষে আধা ঘন্টায় চারশো টাকা রফা করে শিকারা ভ্রমণ সেরে হোটেলে ফিরলাম। হোটেলটা একদম ডাললেকের পারে হওয়ায় রাতের খাওয়া শেষে পনের নম্বর ঘাটে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। রাতের বেলা লেক তার সারাদিনের ব্যস্ততা হারিয়ে সমাহিত রূপ ধারণ করেছে, যদিও ইতস্ততঃ একটা-দুটো হাউসবোটের যাত্রীদের পারাপার করছে।

আমাদের হোটেলের ঠিক পাশ দিয়েই শঙ্করাচার্য্য মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা। স্মৃতিতে ছিল মন্দিরে উঠতে গিয়ে ২৭০ সিঁড়ি চড়তে হয়। সিকিউরিটি চেকিং পেরিয়ে নির্জন বনপথ। সিঁড়ির সংখ্যা মনে থাকলেও যেটা মনে ছিলনা সেটা হল মন্দিরের পাদদেশে পৌঁছতে ডাল লেক থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়৷ দেড় ঘন্টা লাগল মন্দিরের নিচে পৌঁছতে। এখানে আর্মির লোকজন গরম গরম চা, বিস্কিটস্ সার্ভ করছেন যেটা আমার ক্ষেত্রে অক্সিজেনের কাজ করলো। বহু বছর পর পাহাড়ি পথে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটলাম, যদিও চড়াই নেই বললেই চলে। এই সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার টপকাতে একহাজার ফিট উঠতে হবে। মন্দির দেখে ফেরার সময় একটা অটো পেয়ে গেলাম। হোটেলে ফিরে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে আমাদের দিনের ভ্ৰমন শুরু হল।

আজ আমরা দুটো মুঘল গার্ডেন দেখবো-শালিমার বাগ আর নিশাত বাগ। শালিমার বাগ এখান থেকে পনের কিলোমিটার দূরে, তাই আগে ওখানে যাওয়াই মনস্থ করলাম। চারধাপে বিন্যস্ত শালিমার বাগ ১৬১৯ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীর পত্নী নুরজাহানকে উপহার দেওয়ার জন্য বানিয়েছিলেন। গোটা বাগিচা ঘিরে চিনার, বার্চ, আর রংবেরংয়ের ফুলের গাছের ছড়াছড়ি। বাগিচা জুড়ে একাধিক জলধারা, শেষ ধাপে বসে সন্ধ্যার প্রাক্কালে জাহাঙ্গীর প্রিয়তমা পত্নীকে নিয়ে ভূস্বর্গের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতেন।

শালিমার দেখে এলাম নিশাত বাগে। এই উদ্যানটি মুঘল বাগানের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বারোটি ধাপে বিন্যস্ত উদ্যানে ঝর্ণা বয়ে গেছে সবকটি ধাপের মধ্য দিয়ে। ১৬৩২ সালে এই বাগান তৈরি করেছিলেন জাহাঙ্গীরের শ্যালক, নূরজাহানের ভাই আসফ খান। প্রকৃতি এই বাগান সাজিয়েছে চিনার, সাইপ্রাস, আপেল, চেরি, আর অজস্র ফুলের গাছ দিয়ে। এখান থেকে জাবারওয়ান পাহাড়ে ঘেরা ডাল লেক দেখলে মনে হয় শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি। নিশাতবাগ দেখে চলে গেলাম বাঙালি খাবারের দোকান ‘সোনার বাংলায়’। তৃপ্তি করে ডাল-ভাত-এঁচোর-পোস্ত-কাতলা মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খেলাম। তারপর টুকটাক শপিং সেরে দুপুর দুপুর হোটেলে ফিরলাম।

শ্রীনগরে আরও দুটো অবশ্যদ্রষ্টব্য মুঘল গার্ডেন হল চশমাশাহী এবং পরিমহল। সম্রাট শাজাহান ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে জাবারওয়ান পাহাড়ের কোলে তৈরি করেন চশমাশাহী। মুঘল উদ্যানগুলির মধ্যে সবচেয়ে ছোট হলেও নয়নাভিরাম। উদ্যানের শেষ ধাপে তিন খিলান যুক্ত যে মহলটি আছে সেখানে সম্রাট বেগমদের নিয়ে অবসর সময় কাটাতেন। চশমাশাহি থেকে দুই কিলোমিটার পাহাড়ের ওপরে পরিমহল। অতীতে এটা একটা বৌদ্ধ মঠ ছিল। এরপর শাজাহানপুত্র দারাশুকো ছয়মহলা স্থাপত্য নির্মাণ করেন। এটি প্রাথমিকভাবে জ্যোতিষচর্চা এবং সুফি পন্ডিতদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই উদ্যান থেকে ডাললেক সহ গোটা শ্রীনগর শহরের দৃশ্য অনবদ্য। চশমাশাহীর আগে চেক পয়েন্টে অটোকে আটকে দেয় সেখান থেকে গার্ডেনে পৌঁছতে আধা কিলোমিটার হাঁটতে হয়, আর অটোর পরিমহল যাওয়ার পারমিশন নেই। তাই অটো করে পরিমহলে যেতে হলে চশমাশাহী থেকে আপনাকে আড়াই কিলোমিটার চড়াই চড়তে হবে।

পরেরদিন নিজেদের মত করে ঘুরে নিলাম কয়েকটা জায়গা- ওল্ড শ্রীনগরের জামা মসজিদ, বাদামওয়ারি পার্ক, নিগিন লেক আর হজরতবাল দরগা। মনকাড়া স্থাপত্যের নিদর্শন হল ১৪০২ খ্রিস্টাব্দে প্রস্তুত জামা মসজিদ। এই মসজিদের নির্মাতা সিকন্দর বতশিকান। দুর্ভাগ্যবশত এই স্থাপত্য তিনবার অগ্নিকাণ্ডে বিধ্বস্ত হয়। বিভিন্ন সময়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর, শাজাহান এবং ঔরঙ্গজেব এই মসজিদ পুননির্মাণ করেন। ৩৭২টি দেওদার গাছের সুউচ্চ পিলার ধরে রেখেছে মসজিদের সামগ্রিক কাঠামোকে। রমজানের সময় প্রায় এক লক্ষ মানুষ একসাথে এই মসজিদে নমাজ পড়তে পারেন।

ওখান থেকে পৌঁছলাম বাদামওয়ারী বাগে। তথাকথিত মোঘল গার্ডেনের সঙ্গে টক্কর দিতে না পারলেও এটা একটা সাড়ে তিন কিলোমিটার প্রশস্ত বাগান। পাইন, দেবদারু, চিনার, সাইপ্রাস, বার্চ ইত্যাদির সাথে মরসুমি ফুলের বাহার প্রকৃতিকে ঐকান্তিক করে তুলেছে। তারপর এল নিগিন লেক। এটি একটি সুদৃশ্য লেক। এখানেও শিকারা আছে, হাউসবোট আছে। লেকের সৌন্দর্য্যও অনবদ্য। নিগিন লেকের পর হজরতবাল দরগা। দরগা দেখে বেরোলেই শ্রীনগর ইউনিভার্সিটি।

সন্ধ্যের প্রাক্কালে ডাল লেকের বুকে আরেকবারের জন্য শিকারা নিয়ে ভেসে পড়লাম। আজ সন্ধ্যে ঢলল শিকারার দোলনায়; পাহাড়, প্ৰকৃতি, হাউসবোট সবকিছু অন্ধকারে জারিয়ে নিয়ে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। ডিনারের পর লেকের পাশে আধা ঘন্টা বসে এবারের মত কাশ্মীর ভ্রমণ শেষ করলাম৷

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com