সভ্যতার বিকাশের জন্য মানব জাতি কি করেনি!! কখনো কখনো সভ্যতার বিকাশে প্রকৃতির সাথে জুড়ে দিয়েছে কৃত্তিমতাকে। যে কারনে প্রকৃতির শেই অভাবনীয় স্থানটি হয়ে উঠেছে আরও বেশি প্রানময়, বিশ্ব অর্থনীতিকে করেছে আরও সমৃদ্ধ এবং সৃষ্টি হয়েছে মানব সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন। ঠিক তেমনি একটি নিদর্শনের নাম হল সুয়েজ খাল ।
ছোটবেলায় অনেকেই হয়ত সুয়েজ খাল সম্পর্কে পড়েছি, কিন্তু কতটুকুই বা জানি মানুষের তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ এই খালটি সম্পর্কে ? পৃথিবীর অন্যতম এক সম্পদ সুয়েজ খাল সম্পর্কে জানব শুকতারা Tv র এই পর্বে।
মিশরের সিনাই উপদ্বীপে মরুভূমির বালি খুড়ে সুয়েজ খাল তৈরী করা হয়েছে। সুয়েজ খালের শুরুতে দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ কিলোমিটার এবং গভীরতা ছিল ৮ মিটার। বেশ কিছু সংস্কার ও সম্প্রসারণের পর ২০১০ সালের হিসাব মতে এর দৈর্ঘ্য ১৯০.৩ কিলোমিটার, গভীরতা ২৪ মিটার এবং সর্বনিম্ন সরু স্থানে এর প্রস্থ ২০৫ মিটার ।খালটি মিশরের সুয়েজ ক্যানেল অথোরিটির মালিকানাধীন ।
প্রায় দেড়শ বছর যাবৎ ভূমধ্য সাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে চলেছে সুয়েজ খাল। মিশরের সিনাই উপদ্বীপে মরুভূমির বালি খুড়ে এ খাল তৈরী করা হয়েছে। এখানে দেখা যায় পৃথিবীর অন্যতম এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, বিশাল বিশাল সামুদ্রিক জাহাজ ভেসে যায় মরুভূমির মাঝখান দিয়ে। সুয়েজ খাল তৈরী হবার পর ইউরোপ ও ভারতের মাঝে সমুদ্রপথের দূরত্ব প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার কমে যায়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ সমুদ্র বাণিজ্য শুধুমাত্র সুয়েজ খালের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
সুয়েজ খাল খননের ফলে নৌপথে পণ্য বহনকারীদের অর্থনৈতিক প্রভাব দেখা যায়।
সুয়েজ খাল তৈরির আগে কোনো জাহাজকে ইউরোপ থেকে দক্ষিণ এশিয়া আসতে হলে আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হতো । যার ফলে পৃথিবীর বড় বড় জাহাজ কোম্পানিগুলোকে জ্বালানি তেল বাবদ গুনতে হতো মোটা অঙ্কের টাকা।তাছারাও নৌপথে পণ্য বহনকারী জাহাজ গুলও ভারত মহাদেশ থেকে ইউরোপে যেতে সময় নিত প্রায় ৪০-৫০ দিন ।এ খালের কারণে ইউরোপ ও ভারতের মাঝে সমুদ্রপথের দূরত্ব প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার কমে গেছে। আগে যেখানে লাগত ৪০-৫০ দিন এখন সেখানে মাত্র ২০ দিনেই জাহাজ পৌঁছে যেতে পারে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ সমুদ্র বাণিজ্য শুধুমাত্র সুয়েজ খালের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৯শতকে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় সুয়েজ খালের মতই একটি খাল ছিল। তৎকালীন মিশরের ফেরাউন প্রথম সেসসট্রিস লোহিত সাগর থেকে নীল নদ পর্যন্ত একটি খাল খনন করার নির্দেশ দেন। এরপর তার পরবর্তী ফেরাউনরা ভূমধ্য সাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে তৎকালীন নৌকা চলাচলের উপযোগী খাল খনন করে। এ খাল তারপরও প্রায় ১২শ বছর সচল ছিল। কিন্তু খালটি শুধুমাত্র মিশরীয়রাই তাদের বানিজ্যের জন্য ব্যবহার করতে পারত। পরবর্তীতে মরুঝড়ের ফলে এ খালের বেশকিছু অংশ ভরাট হয়ে বিটার হ্রদ ও তিমশা হ্রদের সৃষ্টি করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬শতকে ফেরাউন নিকো পুনরায় আবার এ খাল খনন করতে চায়। কিন্তু সে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক অনাহারে মারা যায়। এর প্রায় ১০০ বছর পরে পারস্যের রাজা দারিয়ুস ভূমধ্যসাগরের নিকটবর্তী অংশ খনন শুরু করে। এবং দুই শতাব্দী পরে দ্বিতীয় টলেমির শাসন আমলে এ খাল খনন সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে পুনরায় মরুভূমির বালি দ্বারা ভরাট হয়ে প্রায় এক হাজার বছর চাপা পড়ে ছিল খালটি। বর্তমান সুয়েজ খালটিও টলেমির আমলের সেই খালের উপর নির্ভর করেই গড়ে তোলা হয়েছে।
১৪৯৮ সালে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো দা গামা আফ্রিকা মহাদেশের কেপ অব গুড হোপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন। ভাস্কো দা গামার আবিস্কৃত পথে ইউরোপ থেকে ভারতে আসতে সময় লাগত প্রায় ৪ মাস। এরপর প্রায় ৪শ বছর ধরে ব্রিটিশ, ওলন্দাজ ও পর্তুগীজ জাহাজ এ সমুদ্রপথে রাজত্ব করে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি শুরু হওয়া শিল্প বিপ্লবের ফলে, ইউরোপে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিরাট পরিবর্তন আসে। পুরনো অভিজাত শ্রেণীর পতন ও নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাবের ফলে, দূর প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের বানিজ্য তখন বিলাসিতার গন্ডি ছাড়িয়ে অতি জর্যুরি বিষয়ে পরিণত হয়। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড সহ সমগ্র ইউরোপে সৃষ্ট কলকারখানার জন্য দরকার পড়ে নানা রকমের কাঁচামাল। তাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল বিভিন্ন ধরনের খনিজ আকরিক, পাট ও তুলা। ঠিক একই সময়ে সামুদ্রগামী জাহাজের নির্মান পদ্ধতিতেও আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এসময় প্রাচীন কাঠের জাহাজের বদলে, আধুনিক স্টীলের বিশাল বিশাল জাহাজ তৈরী হতে থাকে। এসব স্টীলের জাহাজ ভারত তথা এশিয়া থেকে প্রচুর কাঁচামাল নিয়ে যেতে সক্ষম ছিল। কিন্তু সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে এ সব আধুনিক জাহাজের যাত্রায়ও অনেক বেশি সময় লাগত। তাই বাধ্য হয়ে তখন ইউরোপের মনোযোগ যায় সুয়েজ উপকূলে।
ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগরের উচ্চতা ১০ মিটার বেশি থাকায় সেসময় খাল খননের চিন্তা বাদ দেয়া হয়। পরবর্তীতে ফার্দিনান্দ দে লেসেপ্স নামক একজন ফরাসি প্রকৌশলী সুয়েজ খাল খননের উদ্যোগ নেন। সুয়েজ খাল খনন করতে ১৮৫৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর সুয়েজ খাল কম্পানি গঠন করা হয়। লেসেপ্স চেয়েছেন সুয়েজ খাল কম্পানি যেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। তাই এ খাল প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তি অনুযায়ী সকল দেশ শান্তি ও যুদ্ধকালীন সময়ে বৈষম্যহীনভাবে সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। কিন্তু তখন ব্রিটিশরা সুয়েজ খাল খননের বিরোধীতা শুরু করে। ব্রিটিশরা ভাবছিল, যেহেতু ফরাসিরা এ খাল খননের দ্বায়িতে রয়েছে, তাই খাল খনন সম্পন্ন হবার পর, ফরাসিরা হয়ত পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ব্রিটিশদের এ পথে যাতায়াত করতে দিবে না। এছাড়াও ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজত্বে অন্য কোন ইউরোপীয় দেশকে ভাগ দিতে চায়নি। খাল খনন যাতে বাধা প্রাপ্ত হয় সেজন্য ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংককে ব্রিটিশ সরকার এ প্রকল্পে ঋণ দিতে নিষেধ করে। সেসময় মিশর ছিল ওসমানিয় সাম্রাজ্যের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। তৎকালীণ মিশরের শাসক মোহাম্মদ সাঈদ পাশা, ইউরোপের কিছু ব্যাংক থেকে অতি উচ্চ সুদে বহু টাকা ঋণ নিতে সক্ষম হন। ১৮৬৩ সালে মোহাম্মদ সাঈদ এর মৃত্যুর পর তার ভাতিজা ইসমাইল পাশা মিশরের ক্ষমতায় আসেন। দশ বছর ধরে খননের পর তার আমলেই সুয়েজ খালের নির্মান সম্পন্ন হয়।