ভিয়েনা থেকে ব্রুনো হয়ে প্রাগে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। হোটেলে মালপত্র রেখে ডিনার খেয়েই শুরু হল আমাদের বোহেমিয়ান ট্রিপের অন্যতম সফর “নাইট ওয়াক ইন দ্যা সিটি অফ প্রাগ”। মনে মনে বলি কোথায় রাত ? এ যে দেখি পড়ন্ত বিকেল গো! সাত তাড়াতাড়ি ডিনার খেয়েই ছুট? আকাশে তখনো কটকটে রোদ। বাতাসে যেন বসন্তের রেশ। প্রথমে বাসে চড়ে নামা হল পাহাড়ের মাথায় স্ট্রাহভ মনাষ্ট্রি দেখতে। মনাষ্ট্রিতে আবার বিয়ার ব্রুয়ারি! ভাবা যায়? সেখান থেকে দুর্গ শহর প্রাগের অতি সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়।এই ভিউপয়েন্টে গিয়ে সেন্ট নরবার্টিনের বেত্তান্ত শোনা হল স্থানীয় গাইডের মুখে।
স্ট্রাহভ মনাস্ট্রিতে সেন্ট নর্বার্টিনের রেলিক্স রাখা রয়েছে। আছে প্রকান্ড লাইব্রেরীতে বিশাল বইয়ের সম্ভার আর ব্যাসিলিকায় ফ্রেসকো এবং ভার্জিন মেরীর মোটিফ থেকে সবকিছুই সযত্নে সংরক্ষিত। রাখা রয়েছে প্রকান্ড এক অর্গ্যান যা বাজিয়ে মোত্জার্ট বলেছিলেন এমন বড় ও সুন্দর অর্গ্যান তিনি আর কোনোদিনো বাজাননি।
পশ্চিম ইউরোপ যেমন জার্মানিক, পূর্ব ইউরোপের প্রাগ শহরে তেমনই প্রধানত স্লাভিক ট্রাইবদের বাস। চেক ভাষায় প্রাগের নাম প্রাহা। যার অর্থ হল ‘ford’ বা ‘rapid’। আক্ষরিক অর্থে ভ্লাতাভা নদীর ব্রিজের ওপর দিয়ে পেরোতে হয় এই অঞ্চল যেখানে নদীর গভীরতা অত্যন্ত কম। মানুষ ও ঘোড়াও সেই তিরতির করে বয়ে চলা অগভীর নদীর মধ্যে দিয়ে অনায়াসে এককালে পেরিয়ে চলত। এখন সেখানে ছোট্ট ব্রিজ হয়েছে। তবে প্রাহা নামটির উৎসমূল জেনে বেশ লাগে।
এবার পিটার শোনায় চেক কিংবদন্তির কড়চা। বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানী স্লেভিক রাজকন্যা লিবিউসে অসাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী করতেন । পাহাড়ের মাথায় তিনি আর তার স্বামী রাজপুত্র প্রেমিস্ল শান্তিপূর্ণভাবে রাজ্য শাসন করত। একদিন পাহাড়ের মাথায় উঠে, ভ্লাতাভা নদীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে তিনি বললেন, অদূর ভবিষ্যতে এই শহর হয়ে উঠবে পূর্ব ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শহর। খ্যাতির শিখরে পৌঁছবে তার শিল্প-কলা-কৃষ্টির উত্কর্ষতায়। একজন মানুষ তাঁর দৃষ্টিপথেই একটি বিশাল দুর্গ বানিয়ে চলেছিল। রাণী বললেন আর ওইখানেই সেই চরম শহরায়ণের সব লক্ষণ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এবং ফলেও গেল তাঁর কথা। তাই তো এই শহর চেক রিপাব্লিকের রাজধানী শহর যার নাম প্রাহা।
আবারো পায়ে হেঁটে প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারে ঘোরা। এই প্রাগ আমাদের নিয়ে গেল ফিজিক্স বইয়ের পাতায়। জোহান কেপলার ও টাইকো ব্রাহের জ্যোতির্বিদ্যার অনেক কিছু আবিষ্কার ঘটেছিল এখানে। পথের ধারে দুজনার স্ট্যচুটি প্রমাণস্বরূপ আজো সেখানে। দুই দিকপাল জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে আর জোহানেস কেপলার আসেন প্রাগে। টাইকো ব্রাহে ছিলেন উৎকৃষ্ট পর্যবেক্ষক আর কেপলার ছিলেন গণিতজ্ঞ। এই প্রাগেই টাইকো ব্রাহে কেপলারকে তাঁর সহকর্মী করলেন। আকাশে হঠাৎ টাইকো দেখতে পেলেন অদ্ভুত সুপারনোভা। কেপলার তা থেকে অঙ্ক কষে সূত্র তৈরী করলেন। হয়ত একে অপরের পরিপূরক ছিলেন কিম্বা তাঁদের মধ্যে ছিল চরম ইগোর দ্বন্দ। কিন্তু সেই মূহুর্তে আমার কাছে এঁদের গল্প শোনা মানেই আমার ফিজিক্স বইয়ের সেই ছবিদুটিতে মনে মনে প্রণাম জানানো আর প্রাগের রাস্তায় এঁদের স্ট্যাচু দেখে আকুলিবিকুলি প্রাণ।
এরপর সেন্ট নিকোলাস চার্চ। কোবলস্টোনের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় এদের সবকিছু সংরক্ষণই এত সুন্দর? এরা দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরেও তো এরা নিজেদের অনেক ভেঙেচুরে আবারো গড়ে তুলেছে। আর সর্বোপরি রেখেছে কি চমত্কার!
রাস্তা পেরোই ট্রামলাইনের ওপর দিয়েই। কি অপূর্ব এই স্ট্রীটকারের মায়াবী নেটওয়ার্ক। সারা শহরের অলিগলি রাজপথ থেকে ক্রিসক্রস ভাবে রঙীন সুন্দর সুন্দর ট্রাম চলে যাচ্ছে অনবরত। আর এরা কত সুন্দরভাবে এই যানটিকে ব্যাবহার করে সেটাই দেখবার। প্রাগের ট্রামের নেটওয়ার্ক চেক রিপাবলিকের মধ্যে সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে বৃহত। রাস্তায় হাঁটি অবলীলায়। জেব্রাক্রসিংয়ে পা দিয়ে, ট্র্যাফিক লাইট মেনেই। আর চোখে পড়ে অসাধারণ রেনেসাঁ স্থাপত্য। মনে মনে ভাবি সমগ্র ইউরোপটাই কি এত সুন্দর! কাকে দেখি আর কার থেকে মুখ ঘোরাই? এবারে গাইডের ধারাভাষ্যে কান পাতি আর শুনি প্রাগের লেসার( Lesser) টাউনের কথায়। এই লেসার টাউন স্কোয়ারের ল্যান্ডমার্ক হল রাজকীয় সেন্ট নিকোলাস চার্চ। ওল্ড টাউন স্কোয়ারের কেন্দ্রবিন্দুতে এই চার্চ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চেক আর্মির ঘাঁটি ছিল এই নিকোলাস চার্চ। চার্চটির সংরক্ষণের জন্য এই সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রম আর সেই সাথে নামীদামী স্থপতিদের শিল্পকলায় ভরে উঠেছিল চার্চের অন্দর ও বাইরের মহল। সেন্ট নিকোলাস চার্চটি একাধারে গীর্জা অন্যধারে ক্লাসিকাল কনসার্টের অন্যতম প্রেক্ষাগৃহ বা মঞ্চ।
বাইরে থিকথিক করছে রেস্তোঁরা, পাব, দোকানপাট, ব্যুটিক আর প্রাগের বিখ্যাত মানুষ, ধনী লোকজনের ব্যারক স্টাইলের ঘরবাড়ি। ইন্টারন্যাশানাল এমব্যাসিগুলিও এখানে। এই ব্যারক স্টাইল হল অত্যন্ত সুন্দর স্থাপত্যে নির্মিত বাড়ি। জানলার নীচে খোদাই করা মানুষের মুখ, বাড়ির ছাদের প্যারাপেটে পরী কিম্বা প্রবেশ পথে জীবজন্তুর অসামান্য আর্কিটেকচার। পুরণো শহরের অনুপাতে অনেকটাই ছোট বলে এর নাম লেসার টাউন।
এবার একফালি অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে আবারো বড় রাস্তায় গিয়ে পড়ি। গাইড মোবাইলে ডেকে নিলেন সেদিনের জন্য বুক করা প্রাইভেট ট্রামের একটি কামরাকে। ম্যাজিকের মত ট্রাম এসে দাঁড়ালো সামনে। উঠে পড়লাম টুক করে। কি সুন্দর অনুভূতি। স্বপ্নের মত সেই সন্ধ্যেয় প্রাগের ট্রামে চড়া আর একটা গলির মুখে অবতরণ করে পাথরের রাস্তা দিয়ে এক বিয়ার ব্রুয়ারীর মধ্যে প্রবেশ করা। বোহেমিয়ান বিয়ার নাকি বিখ্যাত। তেমনি এক বিয়ার পাবে সেদিনের সান্ধ্য আড্ডা জমে গেল। বিশাল সুদৃশ্য কাটগ্লাসের মাগে বিয়ার হাজির হল সাথে টুকটাক ।
এককোণায় প্রৌঢ় বাজিয়ে চলেন একর্ডিয়ানে চেনাঅচেনা গানের সুর। আলো আঁধারিতে মায়াময় পরিবেশ। ঘন্টাখানেক পর পাব থেকে বেরিয়ে পড়ি সকলে মিলে। আবার পায়ে হেঁটে আলোকমালায় সজ্জিত রোমান্টিক প্রাগের রাজপথে উঁকি দি। পথ হয় গাইডের ধারাভাষ্যে গল্পমুখর।চোখ রাখি সেই বিখ্যাত জার্মাণ ইউনিভাসিটি অফ প্রাগে যেখানে এলবার্ট আইনস্টাইন থিওরিটিকাল ফিজিক্সে অধ্যাপনা করেছিলেন। পেরুতেই চোখ রাখতে হয় চারজন মিউজিশিয়ানের অনবদ্য স্ট্যাচুতে। প্রাগের বিখ্যাত স্থাপত্যগুলির একটি। চারজনের হাতে চারটি বাদ্যযন্ত্র। স্থপতির কল্পনায় বিশ্বের বৃহত্তম চারটি নদী আমাজন, মিসিসিপি, গঙ্গা এবং দানিয়ুব এর এক একরকম কলতান নাকি এই চার বাদ্যশিল্পী চোখ বন্ধ করে বাজিয়ে চলেছে । চার নৃত্যরত শিল্পীর চোখ বাঁধা। তাদের হাতে ম্যান্ডোলিন, ভায়োলিন, বাঁশী ও ট্রামপেট।
এবার গিয়ে উঠি ভ্লাতাভা নদীর ওপরে চার্লস ব্রিজের ওপরে। বিশাল চওড়া হাঁটার পথ। ব্রিজের ডাইনে বাঁয়ে সব পিলারের মাথায় দন্ডায়মান সারেসারে স্থাপত্য। রাজ পুরোহিত সেন্ট জন নেপোমুকের স্ট্যচুটির সামনে গিয়ে থামি।স্ট্যাচুর মাথার চারিপাশ দিয়ে একটি ধাতব রিংয়ে পাঁচটি সোনালী স্টার খচিত। ভ্লাতাভা নদীর ব্রিজের ঠিক ওই স্থানটি থেকে তাঁকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন রাজা কারণ পুরোহিতের কাছে রাজা তাঁর রাণীর স্বীকারোক্তির কথা জানতে চেয়েছিলেন এবং পুরোহিত তা জানাতে চান নি। অতি জাগ্রত এই স্ট্যাচুটি ছুঁলে নাকি মনোস্কামনা পূর্ণ হয়। স্থানীয় মানুষ ব্রিজের গায়ে ছোট ছোট তালা লাগিয়ে দেয়, অনেকটা আমাদের ঠাকুরের থানে গিয়ে লাল সূতো বাঁধার মত। নদীর ওপরে পুরণো ব্রিজ, নতুন ব্রিজ একই সময়ে অর্থাৎ ওই রাতেই ক্রস করছি, বেশ লাগল ভেবে।
আকাশে তখন কৃষ্ণা চতুর্থীর চাঁদ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পায়ে হেঁটে রূপসী প্রাগের পথ চলার শেষে এবার ভৌতিক অনুভূতি। ছমছম করে ওঠে গা। চোখের পলক পড়েনা গাইডের গল্প শুনে। মাথাকাটা এক সাধুর গল্প বলে চলে সে। তার অতৃপ্ত আত্মা নাকি এখনো ঘুরে বেড়ায় মনাষ্ট্রির সিঁড়িতে। সেই সাধু অভাবের তাড়নায় কি যেন বেচার চেষ্টায় ছিলেন তাই তার মাথা কেটে দেন অন্য সাধুরা। হেডলেস মঙ্কের গল্প শুনেই মনে হয় কখন বাড়ি থুড়ি হোটেল যাব।
পৌঁছে যাই সেন্ট অ্যাগনেস মনাষ্ট্রির মধ্যে। বেরিয়েই পাউডার গেট ( চেক ভাষায় যার নাম Prašná brána)। প্রাগের এক গথিক টাওয়ার সহ প্রবেশদ্বার যেন আমাদের গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া বা ইন্ডিয়া গেটের মত। এই প্রবেশদ্বার প্রাগের ওল্ডটাউনকে নিউটাউন থেকে পৃথক করেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে গল্প শুনি সেন্ট এগনেস নামে এক রাজকন্যার যে অটবছর বয়সে বাগদত্তা ছিল আরেক দশবছরের রাজপুত্রের সঙ্গে। আর তারপর তার সংসারে বীতরাগ জন্মানো আর কৃচ্ছ্রসাধনে ব্রতী হয়ে ভক্তিমার্গে বিচরণের গল্প শুনতে শুনতে ওল্ড টাউন স্কোয়ারের Wensessler স্কোয়ারে পা বাড়ানো। বোহেমিয়ার প্যাট্রন সেন্ট Wenceslas এর নামে এই স্কোয়ারের নাম। এই ঐতিহাসিক স্থানটি হল প্রাগের হেরিটেজ সাইট। মধ্যযুগে এখানে ঘোড়ার বাজার ছিল। এবারে বোহেমিয়ান রাজা চতুর্থ চার্লসের নিউ টাউন স্কোয়ার বানানোর গল্প শুনে পথ চলি। আলোয় ঝলমলে তখন প্রাগের নিউটাউন। রাতের আলোয় ন্যাশানাল মিউজিয়াম, Wenceslas মনুমেন্ট এক অদ্ভূত রোমান্টিক স্থান।
ওল্ড টাউন স্কোয়ার থেকে প্রাগ কাসল যাবার পথেই পড়ল “নাইটস অফ দ্যা ক্রস স্কোয়ার”… প্রাগের বিখ্যাত রাজপথ, টুরিষ্টদের অন্যতম গন্তব্য। ডিজিটাল ক্লিকে, সেলফি স্টিকে রাজকীয় রাতপরী প্রাগের ছবি তখন ক্যামেরায় ধরে নেবার পালা। সেই স্কোয়ার অন্যদিকে চার্লসব্রিজকেও ছুঁয়েছে। স্কোয়ারের মধ্যিখানে রাজা চতুর্থ চার্লসের বিশাল সেমি-গথিক স্ট্যাচু । শহরের আলোয় ঝলমলে প্রাগ তখন যেন যৌবনউদ্ভিন্না। চালর্স ইউনিভার্সিটির ৫০০ বছর পূর্তিতে রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এই স্মারক নির্মিত হয়েছিল।
স্কোয়ারের আশপাশের গথিক স্টাইল অট্টালিকার প্যারাপেটে দাঁড়িয়ে সারে সারে ভাস্কর্য। কি অপূর্ব তারা ! পেছন থেকে আলো এসে পড়েছে সর্বাঙ্গে।
আবারো মোবাইলে ডেকে নেওয়া হয় ট্রামকে। সে রাতের মত প্রাগ শহরকে বিদায় জানিয়ে হোটেলে গিয়ে ঘুমে ঢলে পড়ি আর আমার স্বপ্নে এসে তখনও ধরা দেয় সেই প্রাগসুন্দরী। মনে হয় তার সাথে হাঁটতে পারি আরও আরও পথ, অনায়াসে, অবলীলায়।
কখন যাবেন: মে থেকে অগস্ট
কিভাবে যাবেন: চেক রিপাবলিকের ক্যাপিটাল প্রাগে যেতে যেকোনো ইউরোপিয়ান শহর থেকেই ফ্লাইট নেওয়া যায়। অথবা টুরগ্রুপের সাথে গেলে তারা বাস প্রোভাইড করে।
কোথায় থাকবেন: টুরিস্টপ্লেস প্রাগে সবধরণের হোটেলের রমরমা। টুর কোম্পানির সাথে যাওয়াই ভাল। আমরা ট্রাফালগার টুর কোম্পানির সঙ্গে ঘুরেছিলাম। প্রত্যেক হোটেলেই বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট ইন্ক্লুডেড।