“ভয়ংকর সুন্দর” তকমাটা শুধুই সুন্দরবনের অধিকার। মনে হয় এই জন্যই বন বিবির অভিশাপে অনিমেষ আইচের সিনেমাটা ফ্লপ হয়েছে। কথা হচ্ছে এই বন বিবি কে? আর তাঁর সাথে সুন্দরবনের মৌয়ালদের সম্পর্ক কই? “Seven Wonders of Commonwealth” এ জায়গা করে নেয়া এই মধু সংগ্রহের বিষয়টা আসলে এত সোজা না। প্রায় ৭০০ বছর ধরে সুন্দরবনে মৌয়ালদের বসবাস। আর এই ৭০০ বছরে মামার সংখ্যা কমলেও, মধু সংগ্রহের সিস্টেমে একটুও পরিবর্তন আসে নাই। এখন প্রশ্ন করবেন, “ভাই, মামা কে?”। চলেন তাহলে। আমাদের যেতে হবে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে।
শ্যামনগর নেমে সুন্দরবন কে সুন্দরবন বলবেন না। লোকালদের ভাষায় সুন্দরবন হচ্ছে “ব্যাদাবন” বা “প্যারাবন”। আশেপাশের প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস এই সুন্দরবন। এর একটা হচ্ছে বন থেকে মধু সংগ্রহ করা। যারা এই কাজের সাথে যুক্ত তাদের কেই বলা হয় মৌয়াল।
মৌয়ালদের বিচিত্র জীবন ধারা খুবই ইন্টারেস্টিং। মধু সংগ্রহের মৌসুমে এরা নানা রকম নিয়ম কানুন মেনে চলেন। এ সময় যেহেতু বাড়ির পুরুষেরা বনে থাকেন তাই বাড়ির নারীদের নানান নিয়ম পালন করতে হয়। তারা এ সময় বাড়ির বাইরে খুব একটা দূরের এলাকায় যান না। নারীরা এ সময় মাথায় তেল-সাবান ব্যবহার করেন না। দুপুরবেলা কোনোভাবেই চুলায় আগুন জ্বালান না। কারণ তারা বিশ্বাস করেন বাড়িতে এ সময় আগুন ধরালে বন এবং মধুর চাকের ক্ষতি হবে। মধু কাটার মাসে মৌয়ালরা কারো সাথে ঝগড়া বিবাদও করেন না।

মধু সংগ্রহের কাজটা কেবল যে মধু সংগ্রহেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, এর আগে ও পরে বেশকিছু ঝামেলা পোহাতে হয় মৌয়ালদের। একদিকে বন বিভাগের অনুমতি অন্যদিকে বন-দস্যুদের খপ্পর। তবে সবচেয়ে বড় আতংক হল “মামা”। “মামা” হচ্ছে বাঘ। হ্যা, স্থানীয়রা রয়েল বেঙ্গল টাইগারকেই “মামা” বলে ডাকে।
প্রতিবছর প্রায় ৮০ জন মৌয়াল মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের হাতে প্রাণ হারায়। এদিকের বেশির ভাগ মৌয়াল মুসলিম হলেও প্রচুর মৌয়াল রয়েছে যারা হিন্দু এবং তাদের রয়েছে নিজস্ব দেব দেবী। “বনবিবি” হল তাদের প্রধান দেবী। দক্ষিণরায়ের মূর্তিতেও তাঁকে দেখা যায় বাঘের পিঠে বসা অবস্থায়। এছাড়াও আছে নারায়ণী, বিশালক্ষী,কালুরায় সহ আরও অনেক দেব-দেবী। এইসব দেব দেবীর আশীর্বাদের পরেও বাঘের হাতে প্রাণ হারানোকে মৌয়ালরা এই ২০১৯ সালে এসেও নিয়তি হিসেবেই মেনে নেয়। তাদের মতে যখন তাদের হায়াত শেষ হয়ে যায় তখনই তারা বাঘের কবলে পড়ে।

লঞ্চে পিকনিক করতে গিয়ে যে সুন্দরবন দেখেছেন, মধু সেখানে নাই। যে সুন্দরবনে মধু আছে, সেটা ভয়ংকর সুন্দর, একই সাথে ভয়ংকর এবং সুন্দর। গভীর সুন্দর সুন্দরবনের মধু মৌসুম চৈত্র থেকে বৈশাখ পর্যন্ত। এসময় খলিশার মধু বেশি পাওয়া যায় যেটা “পদ্ম মধু” নামেও পরিচিত। তারপর গেওয়ার মধু এবং এর কিছুদিন পর বাইন, কেওড়ার মধু পাওয়া যায়। মধু সংগ্রহের সময় মৌয়ালরা বেশকিছু নিয়ম পালন করেন।
মধু সংগ্রহের সময় মৌয়ালদের একদল খেজুর পাতা-লাঠি দিয়ে বানানো এক প্রকার মশাল দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে মৌমাছিকে দূরে রাখে। আরেকদল পটকা-বাজি ও মহিষের শিং দিয়ে তৈরি শিঙায় ফু দিয়ে বাঘকে দূরে রাখে। কেউ কেউ গায়ে ছাই মেখে /কেউ গামছা পড়ে গাছের ঢালে উঠে যায় ধারালো অস্ত্র হাতে। চাকের প্রথম কিছু অংশ বনবিবির নামে উৎসর্গ করে ফেলে দেয় তারা। মধু নিয়ে খুব দ্রুতই নৌকায় ফিরে যায় তারা। এরপর ন্যাকড়া বা এমন কাপড় দিয়ে ছাঁকন প্রক্রিয়ায় মধু ও মোম আলাদা করে বাড়ির পথ ধরে।
একটা মজার তথ্য দেই দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী একটা মৌ-পোকা মারলে ৫০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে যদিও এসব আইনের কথা মৌয়াল দের কাছে একেবারেই অজানা।
মৌয়াল দলের প্রধানকে বলা হয় “সাজুনী”। আপনাকে জঙ্গলে যেতে হবে এই ভদ্রলোককে কনভিন্স করে। সেই আপনার গার্জিয়ান। নৈতিক অনৈতিক বিভিন্ন উপায়ে অসংখ্য মানুষ মধু সংগ্রহে নামে। তবে নিয়ম মেনে যেতে হলে আপনাকে বেশ কিছু টাকা গুনতে হবে। ৭-৯ জনের নৌকার ফি দিতে হবে ৭০০০ টাকা। একটি সিঙ্গেল পাস এবং একটি BLC(Boat license certificate) পাস নিতে হবে। সেটার জন্য চেয়ারম্যান থেকে ছবি,জন্ম-নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র এসব কিছুর সত্যায়িত কপি লাগবে। এগুলো জোগাড় ও কম খাটনির কথা নয়।
দলের সবাই সাজুনীর নেতৃত্বে আগের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী মৌমাছির গতিপথ দেখে বনের কিনারে নৌকা রেখে বনের ভেতর চাকের সন্ধান করেন। চাক খোঁজার সময় মৌয়ালদের দৃষ্টিটা উপরের দিকে থাকে বলে মৌয়ালরাই বাঘের আক্রমণের শিকার হন সবচে বেশি। মৌচাক পাওয়া মাত্র আল্লাহ আল্লাহ বলে চিৎকার করে বাকিদের জানিয়ে দেয়া হয়। তাছাড়া মামাকে দূরে রাখারও একটা কৌশল এই চিৎকার।
তবে হ্যাঁ কেউ ই ৭৫ কেজির অধিক মধু সংগ্রহ করবে না, কেবল এই শর্তে তাদের অনুমতি দেয়া হয়। আর BLC দেয়া হয় সাজুনীকে। বনবিভাগই ঠিক করে দেয় কোন দল কোন অংশে মধু সংগ্রহে যাবে। প্রতি ২০ কেজির অধিক মধু স্থানান্তরেও লাগে ট্রানজিট পার্মিট।

সহজ কথা হচ্ছে আপনি যদি মৌয়ালদের সাথে মধু সংগ্রহ করতে যেতে চান, আপনাকে কোন সাজুনী’র ধারস্থ হতে হবে। আপনি তাকে কথা দিয়ে কনভিন্স করতে পারেন, টাকা পয়সা দিয়েও করতে পারেন। কিন্তু সাজুনী ছাড়া আপনার এই থ্রিলারের অংশ হবার কোন সুযোগ নাই। মূলত দাতিনাখালী, বুড়িগোয়ালিনী,শ্যামনগর: সাতক্ষীরা এই চারটি অঞ্চলেই মৌয়ালদের বসবাস, অর্থাৎ মধু সংগ্রহের জন্যে বনে ঢুকতে হবে এই চারটি পয়েন্ট দিয়েই।
গহীন অরণ্যে মধু সংগ্রহের বিষয়টি আর দশটা টুরিস্ট স্পট ভ্রমণের মত নয়। এই এক্সপেরিয়েন্সের প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে এডভেঞ্চারের গন্ধ। মোটরচালিত নৌকায় আট দশ জনের একটা দলে বিভক্ত হয়ে প্রথমে যেতে হবে বনের ভেতরে। নৌকা থেকে নামতেই পা হয়ত চলে যাবে এক হাত কাদার ভেতরে, ঘন শ্বাসমূলে ভরা কাদামাখা পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে কিন্তু চোখ থাকবে গাছে গাছে, হয়ত কোথাও বুক সমান পানি, গন্তব্যের ঠিক নাই।
কিন্তু এত কষ্টের পরেও মৌমাছি বিহীন চাক থেকে ঝর ঝর করে মধু ঝরে পরার দৃশ্যের থ্রিল আসলে লিখে বুঝানো সম্ভব না। যে ভয়, সে থ্রিল আপনি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করবেন, সেটাও এই ব্লগ লিখে বুঝানো সম্ভব না। কখনো বাঘ, কখনো জলদস্যু, কখনো ঝুম বৃষ্টি; এই থ্রিল, অস্বাভাবিক সুন্দরের মধ্যে এই ভয় শুধু নিজে গিয়ে অনুভব করা যায়। বলে বুঝানো যায় না।

যারা ঢাকা থেকে যাবার কথা ভাবছেন তারা ঢাকার কল্যাণপুর,গাবতলী থেকে নিয়মিত বিরতিতে সাতক্ষীরা যাবার বাস পাবেন। ট্রেনে সরাসরি সাতক্ষীরা যাবার কোন উপায় নেই তবে ট্রেনে খুলনা পর্যন্ত গিয়ে বাকিটা পথ বাসে করে যেতে পারবেন। সাতক্ষীরা নেমে সেখান থেকে শ্যামনগরের লোকাল বাস পাবেন।
থাকার কোন আলাদা জায়গা নাই। আপনাকে মৌয়ালদের সাথে তাঁদের গ্রামে থাকতে হবে। তাঁদের সাথেই খাওয়া দাওয়া করতে হবে। এরা খুবই সহজ সরল, অভাবী এবং অতিথি পরায়ণ মানুষ। পুরা ব্যাপারটাকে একটা AirBnb হিসাবে ট্রিট করেন এবং থাকা খাওয়া বাবদ তাঁদের বেশ কিছু টাকা দিয়ে আসতে পারেন। গুগল ম্যাপে শ্যামনগরের অবস্থান দেখে নেয়া যাক।
- এই থ্রিল সবার জন্য না। শুধু শারীরিক না,মানসিকভাবে প্রচুর শক্ত এবং কঠিন এডভেঞ্চারের পোকা মাথায় না থাকলে এই এক্সপেরিয়েন্সে যাওয়ার কোন দরকার নাই।
- প্রতিবছর প্রায় ৮০ জন মৌয়াল মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের হাতে প্রাণ হারায়। এছাড়া জলদস্যুদের প্রতাপ তো আছেই। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, পুরা এক্সপেরিয়েন্সে প্রচুর রিস্ক আছে। আপনি গেলে নিজ দায়িত্বে যাবেন।
- বনের ভেতরে ভুলেও সিগারেট খাবেন না। সামান্য অসাবধানতা বড় কোন ক্ষতির কারণ হতে পারে।
- বনের ভেতরে মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই।
আসল সুন্দরবন আসলে শুধু সুন্দর না, আসল সুন্দরবন ভয়ংকর ও। এখন আপনার ডিসিশন যে আপনি সুন্দর দেখবেন নাকি ভয়ংকর সুন্দর দেখবেন।