সুনামগঞ্জ

আনকনভেনশনাল ঘোরাঘুরিতে সবসময়ই পয়সা কম লাগে, ক্ষেত্রবিশেষে অনেক নতুন কিছু জানাও যায়, চেনাও যায়।  এই ট্রিপে আমরা হাওরের এক মাছ-ধরা ট্রলার ভাড়া করেছিলাম (মানে তাদের রাজী করিয়েছিলাম আর কি)। ছইয়ের উপরে বসে আছি আমরা, আর নিচে তারা মাছ-টাকা ভাগাভাগি করতেছেন অনেকটা এই ধরনের ব্যাপার। মাছের আঁশটে গন্ধটুকু বাদ দিয়ে হাওরের মানুষজনের জীবনযাত্রা, একেবারে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানাদি এবং কালচার-টালচার নিয়ে অনেক কিছুই জানা গেল।

রুট ছিল মোটামুটি এইরকমঃ ঢাকা – সুনামগঞ্জ – জাদুকাটা নদী – বারিক টিলা – টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি – লাকমাছড়া – শ্রীপুর – টাঙ্গুয়ার হাওর – মাটিয়ান হাওর – তাহিরপুর – সুনামগঞ্জ – ঢাকা।

এই ট্রিপে আমাদের চারজনের পারহেড খরচ পড়েছিল ১৯৭৭ টাকা।

ঢাকার কমলাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে রাতের শেষ শ্যামলী ধরে আমরা শুরু করলাম যাত্রা; ফজর নাগাদ নেমে গেলাম সুনামগঞ্জ শহরে। টমটমে উঠে নতুন ব্রিজের কাছে চলে আসলাম, এরপর দু’টো বাইক নিয়ে উঁচু নিচু মেঠো রাস্তা দিয়ে যাত্রা হলো শুরু – গন্তব্য জাদুকাটা নদী আর বারিক্কা টিলা।

নদীর নাম জাদুকাটা – এই নদী পার হলে নাকি জাদুটোণা কেটে যায় ! আমার দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর নদী

অদ্ভুত নীল পানির এই নদীতে খেয়া পার হয়ে আমরা চলে আসলাম বারিক্কা টিলায়। এইখান থেকে পুরো এলাকার যে একটা ভিউ পাওয়া যায়, সেটা কোন ক্যামেরা ধারণ করতে পারবে না।

বারিক্কা টিলা থেকে দেখা সকাল বেলার ব্যস্ততা – জাদুকাটা নদী

সেখান থেকে আমরা চলে গেলাম খনিতে; বাংলাদেশের একমাত্র চুনাপাথর খনি টেকেরঘাটে, যেটা পড়েছে একেবারে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বর্ডারে।

টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি এলাকা। বাংলাদেশ সাইডে অবশ্য মাইনিং বন্ধ দেখলাম, ইন্ডিয়ান সাইডে ধুমসে কাজ হচ্ছে

টেকেরঘাট লাইমস্টোন লেক; অনেকে এইটাকেই আদর করে নীলাদ্রি নামে ডাকে আজকাল। এডিটেড ফোটোর সৌন্দর্য আমার এই র’ ফোটোতে পাওয়া যাবে না, তবে জায়গাটা খুবই সুন্দর

টেকেরঘাট এলাকায় মন খারাপ করা ধ্বংসস্তুপ, অকেজো রেল লাইন আর খনির ক্রেন টেন দেখে অনেকটা জুলভার্নের উপন্যাসের ভৌতিক অ্যাবারফয়েল কয়লাখনি আর ফায়ারমংক সিলফ্যাক্সের কথা মনে পড়ে গেল। আমরা সেদিক থেকে চলে গেলাম পাশের একটা অপরিচিত জায়গায়, যেটাকে কেউ কেউ বলেন বিছানাকান্দি-জাফলং এর হারিয়ে যাওয়া ছোট বোন। জায়গাটার নাম, লাকমাছড়া।

লাকমাছড়া – শান্ত সমাহিত অদ্ভুত সৌন্দর্য

লাকমাছড়ার পাশের বাংলাদেশ সীমানার শেষ গাছ – দুর্দান্ত একটা ক্যাম্পসাইট হতে পারে। তবে পাশেই একটা বিএসএফ ক্যাম্প আছে

এরপর সেখান থেকে খুবই অদ্ভুত একটা রাস্তা ধরে মানুষের বাড়ীর ওপর দিয়ে টিয়ে আমরা চলে আসলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্পূর্ণ বিপরীত একটা সাইডে। সাধারণত সবাই তাহিরপুর হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে ঢোকেন; আমরা উলটো পথে শ্রীপুর নামের একটা বাজার থেকে একটা জেলে নৌকাকে রাজী করালাম হাওরে ঘুরবার জন্য।

এরপর বিপুল জলরাশি, পরিবেশ প্রকৃতি আর স্তব্ধভাষ বিস্ময় – তার নাম টাঙ্গুয়ার হাওর !

টাঙ্গুয়ার হাওর

পানকৌড়ির দল

সুদূরপুরের গ্রাম

ঘন্টা তিনেকের এই এক্সপ্লোরেশন শেষ করে এরপর আমরা শনির হাওর দিয়ে ঢুকে পড়লাম মাটিয়ান হাওরে। সেখান থেকে রক্তি নদীতে পড়ে উঠে আসলাম আরেকটা বাজারে। তাহিরপুর এইখান থেকে খুব বেশি দূরে না।

হাওর থেকে তোলা জ্যান্ত মাছের লাফালাফি – দুপুরের খাবারটা হতে পারে জম্পেশ

যারা এক-দুইদিনের ছুটি পেলেই শহর থেকে কেটে পড়তে চান, আবার খুব বেশি সাগর-পাহাড় দেখাটাও সময়-শ্রম-খরচ মিলিয়ে হয়ে ওঠে না, আবার সিলেটকেন্দ্রিক চিন্তা করলে রাতারগুল আর বিছনাকান্দি দেখতে দেখতে ত্যাক্ত হয়ে গেছেন, তারা ট্রাই করতে পারেন সুনামগঞ্জ।

সুরমা নদী, পাতলাই নদী, রক্তি নদী, জাদুকাটা নদীতে ঘুরবেন, টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর সহ আরও শত হাওরের স্বচ্ছ পানি দেখবেন, টেকেরঘাট চুনাপাথরের খনি, শান্ত সমাহিত লাইমস্টোন লেক আর বারেক টিলার উপর থেকে জাদুকাটা নদীর অদ্ভুত চেহারা মুগ্ধ করে রাখবে, এইটা নিশ্চিত। শীতের সিজনে গেলে তো হাওর মানেই পাখি, আর পাখি মানেই হাওর।

পাখি শিকার/ খাবার অপচেষ্টায় না গিয়ে বরং হাওরের ফ্রেশ মাছ খান, মাঝির সাথে গল্পে গল্পে জেনে নিন কিভাবে এই অসীম জলরাশির মাঝে সংগ্রামী মানুষেরা বেঁচে থাকে। (তাদের বিয়ের উৎসবের গল্প শুনবেন মাস্ট ? )

অনকনভেনশনাল এই জেলে নৌকায় ঘোরাঘুরিতে সমস্যা ছিল খালি একটাই……… আমরা যতই স্বচ্ছ নীল পানি, পাখি আর প্রকৃতি দেখে অবাক হই, আমাদের এই অবাক হওয়াটাতেই তারা আরও বেশি অবাক হন।

মাছ পাখি পানি দেখে অ্যাতো অবাক হওয়ার আছে টা কি !

-মাহদি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: