শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৮ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

সুইৎজ়ারল্যান্ড

  • আপডেট সময় শনিবার, ১২ জুন, ২০২১

ইউরোপের সব থেকে লম্বা গ্রাম। আলপ্স পর্বতের উপর এঁকেবেঁকে তার বিস্তৃতি দৃষ্টির পরিসীমার বাইরে চলে গিয়েছে। ট্রেনের জানলা থেকে তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। নাম বীতেনবার্গ। ইন্টারলাকেন স্টেশনে নেমে ট্যাক্সি নিলাম। বিশাল লেক ,ওপার দেখা যায় না।তার ধারে পাহাড় ।পাহাড়ের  গায়ে  আমাদের ঝোলা আস্তানা — ডরিন্ট হোটেল।বাসস্টপের নাম হুবেল।আমরা এই হোটেলের সঙ্গে যুক্ত একটি আ্যাপারটমেন্ট ভাড়া করেছি বুকিং ডট কমের মাধ্যমে।হোটেলের যাবতীয় সুযোগ সুবিধাও এর সঙ্গে যুক্ত।ঝাচকচকে চারিধার।মালপত্র নিয়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যস্থলে।

কাঠের দরজা খুলতেই আবার আর এক জগত-এবার সোজা সিনেমার পর্দায়।হলিউডের কাউবয় ছবির রাজ্যে।কাঠের দেয়াল,সূক্ষকারুকার্য খচিত আসবাবপত্র,দরজা জানলা।মাঝখান দিয়ে ঘোরানো সিড়ি।দোতলাত উঠে গেছে।হলঘর ঘিরে মেঝে থেকে ছাদ পর্য্যন্ত কাচের জানলা,আর তার  বাইরে? শুধু ধপধপে সাদা বরফের পাহাড় আর নিচে সুগভীর নীল লেক।তার মাঝে চোখ জুড়ানো সবুজ পরিসর।কিছুক্ষন থমকে দাড়ালাম।হাতের মাল নামিয়ে ধীর পায়ে কাচের দরজা খুলে গিয়ে বসলাম  ঝুলবারান্ডায়।ঠান্ডা কনকনে বাতাস এসে মুখে ঝাপটা দিল।কি এক আবেশে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিলাম।কোথা থেকে অজানা এক ফুলের সুবাস -মিষ্টি আবেশে মন ভরে গেল ।


আমার পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে এসেছি।এর সঙ্গে গ্রুপ ট্যুরের অনেক তফাত।আমি দুটিতেই অভ্যস্ত।পাঁচজনের ছোট্ট দলটির কর্ণধার আমার ছেলে।তাকে সাহায্য করছে গুগুল দাদা।কি যানবাহনের সময়সূচি,কি পথনির্দেশ -সব কিছু তার নোখ দর্পনে।প্রযুক্তির এই প্রগতি বড়ই আরামদায়ক ।সবসময় কোনো না কোনো সাহায্যর হাত পেয়ে যাচ্ছিলাম ।একটু হাত পা এলানো ব্যাপার।রিল্যাকস্ড হলিডে।

বাসস্থান টি অসম্ভব সুন্দর ও গুছিয়ে সাজানো।১৫জনের ডিনার সেট থেকে আরম্ভ করে রান্নাঘরের খুঁটিনাটি সমস্ত কিছু।দেখলেই রান্না করার ইচ্ছাটা জেগে ওঠে।হোটেলের পাশেই দোকান।বিকেল বেলা কিছু কেনাকাটা করে ডিনার বানিয়ে ফেললাম।যতক্ষন রান্না হচ্ছে ,ততক্ষন ছোট্ট কিচেন জানলা দিয়ে বাইরে সবুজের সমারোহে চোখ হারিয়ে গেল।

হোটেলের রিসেপশন থেকে আমাদের পাঁচটি বাসের পাশ দিয়েছিল।বাস স্টপ মানে কারুকার্যখচিত রট আয়রনের লম্বা চেয়ার। সরু আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা।উল্টো দিকে ঢেউখেলানো সবুজের ওপর

ছড়ানো ছিটানো লগ হাটস্। গায়ে খয়েরী ও কালো ছোপ কাটা গরু ও  ফোলা ফোলা সাদা পশমের কোট পরা ভেড়ার পাল ঘাস খাচ্ছে।অসংখ্য না না রঙের বনফুল সবুজ পাহাড়ের গায়ে বিচিত্রবর্নের নক্সা বুনেছে।ওপরে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা।আমি বাসস্টপটিকে ভালোবেসে ফেলেছি।বাসের আসন্ন আগমন মন মানতে পারছে না।কিন্তু আমার ছেলের মোবাইলে গুগল দাদা তার পদধ্বনির সংবাদ ঘোষনা করছে।উঠে পড়লাম। হাতে ধরা বাসের পাশ ড্রাইভার দেখল না,শুধু  মিষ্টি হেসে  অভিবাদন করল।বিনাটিকিট কথাটি বোধহয় তাদের অভিধানে নেই।

বিশাল ঝা চকচকে বাস।প্রত্যেক সিটের পাশে কলিং বেল। প্রয়োজনে বাজানো যায়।একবার এক হুইলচেয়ার বাউন্ড প্রতিবন্ধি বাসে উঠলেন। দরজা খুলে যেতেই দেখি বাস ড্রাইভার নেমে এসে তাকে বাসে উঠতে সাহায্য করছেন। বাসে একটি সংরক্ষিত জায়গা আছে যেখানে হুইল চেয়ারটি রাখা যায়।প্রতিবন্ধীর নিজের ইচ্ছা মত চলাফেরা করার কোনো সমস্যা নেই।ভাবা যায়! একেই বলে সভ্য দেশ।


জানালার বাইরে তখন  হলিউড রাজ্য করছে।ঢেউখেলানো সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর জুলি আ্যান্ড্রিউজ তার সেই বিখ্যাত সাউন্ড অফ মিউজিকের গান গুলি গাইছেন,কোথাও বা কাম সেপ্টেম্বারের দৃশ্যাবলী।গরুগুলির গলায় অত্যন্ত সুদৃশ্য নক্সাকাটা ঘন্টা।এরই ছোট অনুকরণ দোকানে মেমেন্টো হিসাবে বিক্রী করা হয়।একটি জায়গায় দেখলাম বহু লোক প্যারা গ্লাইডিং করছে।আমার দলের কচিকাঁচাদের ইচ্ছা হল তারাও আকাশে ভেসে বেড়াবে।ইন্টারলাকেন পৌঁছে ট্যুরিস্ট অফিসে যাওয়া হল।জনাপ্রতি একজন করে ইন্স্ট্রাকটার বা গাইড।আমার দুই নাতনি তাদের সঙ্গে বীর বিক্রমে পাড়ি দিল এই আকাশভ্রমনে। গাড়ি করে তাদের নিয়ে যাওয়া হল আকাশচূড়ায় যেখান থেকে  প্যারা গ্লাইডার টেক অফ করবে।আমরা একটি বিশাল পার্কের ধারে বসে অপে ক্ষা করতে লাগলাম।আধঘন্টা পর এখানেই অবতোরণ করবে।দুটি ল্যান্ডিং দেখলাম।পা দুটি  সোজা করে মাটি  স্পর্শ করে কিছুটা দৌড় দিয়ে থামা।সঙ্গের পরিজনেরা রেডি ক্যামেরা নিয়ে।একটি ছেলে ছবি তোলার ব্যস্ততায় গাইডের নির্দেশ মানেনি।প্রচন্ড বকুনি খেলো ও ব্যাথাও পেলো । উৎসুক দৃষ্টিতে আকাশে তাকিয়ে আছি ।আগের চেয়ে প্যারাগ্লাইডার দের সংখ্যা কম।ক্রমশ দেখি কে উ নেই। আকাশ ভোঁ ভা ! কি হল?চিন্তায় পড়লাম । কোথায় গেল সব? ফোন করা হল অফিসে।নির্দেশ এল  –পিছনে তাকান।দুই বীরাঙ্গনা এক গাল হাসি নিয়ে গাড়ি থেকে নামছে।হাওয়ার  গতি পরিবর্তনের জন্য অন্য একটি স্পটে অবতোরণ করেছে।পুরো অভিজ্ঞতার ভিডিও রেকর্ডিংকরা একটি পেনড্রাইভ কিনলাম।অবাককরা কারিগরি ব্যবস্থা-শুধু প্রশ্ন ক্যামেরা টি কোথায় ছিল?


যতটা সম্ভব খাওয়া দাওয়া আ্যাপার্টমেন্টেই করছিলাম।রান্না করতে খুব ভালো লাগছিলো।আমি সময় পেলেই পাহাড়ী রাস্তা ধরে হাঁটতে বার হতাম।সঙ্গে রোষ্ট চিকেন স্যান্ডউইচ(নিজের বানানো) আলু চিপস্ ও আপেলের  জুস্।মাথায় টুপি হাতে ছাতা।তারপর জুতসই একটি বেন্চ দেখে গুছিয়ে বসে পড়া।সামনে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য।সময়ের সাথে তার রূপ বদল।কি শান্ত  সমাহিত পরিবেশ। সবুজ ঘাসের চাদরে মনে মনে শরীর এলিয়ে দিই।চিন্তা ভাবনা তখন নীল আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হারিয়ে গেছে মেঘের রাজ্যে।শুধু আমি আর সামনে শ্বেত শুভ্র জুম ফ্রাও ।সুইটজারল্যান্ডের বহু প্রসিদ্ধ স্কী রিসর্ট।সব পরিযায়ী মানুষের পরিচিত স্থান।কিন্তু এখন তার কথা নয়।এখন আমি শুধু আমার দেখা ,শুধু আমার চেনা,শুধুই একান্তভাবে আমার একটি পাহাড়ের কোল বেছে নিয়েছি।প্রকৃতি শুধু আমার জন্যই সেজেছে।

একবার পাহাড়ের ফাঁকে এক সুবৃহৎ ল্যাম্প পোস্টের মত ভর্টিকাল রামধনু দেখলাম।গ্রামের মেলাতে এরকম আলোক সজ্জা দেখা যায়।কয়েক মাইল দূরে পাহাড়ের গুহার ভিতরে বিশাল জলপ্রপাত। জলের গর্জন পাথরে গায়ে প্রতিধ্বনি তুলছে। সাদা বৈদ্যুতিক আলো ও ইস্পাতের হাতলওলা সিড়ির ব্যবস্থা থাকার জন্য চলা ফেরা খুব সুব্যবস্থা।কথিত আছে যে সেন্ট বিয়াটাস নামে এক সন্যাসী এখানে তপস্যা করতেন। তাঁরই নামে গুহার নাম।

কাছেপিঠে বহু পৃথিবী বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট যেমন জুম ফ্রাও,মাউন্ট টিটলিস,হ্যারি পটার খ্যাত হলবার্গ।সব দেখা।আবহাওয়া প্রতিকুল থাকার জন্য প্রথম দিন যাওয়া হল না। ট্যুরিস্ট অফিসে জায়ান্ট স্ক্রীন টেলিভিশনের সাহায্যে দেখা যায় গন্তব্য স্থলের চেহারা সেই মুহূর্তে কেমন।একেবারে অন্ধকার।ওখানকার আধিকারিকরা মানা করলেন।একেই বলে ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি।পরের দিন উজ্জ্বল আকাশের দিকে এক ঝলক দেখে ই সোজা ট্রেনে চেপে বসলাম।সবুজের রাজ্য পার হয়ে প্রবেশ  শ্বেত শুভ্র বরফের জগতে। কিন্তু এসব জায়গা ত জনগনের  ,অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে।সর্বোপরি তা সবার জানা। কিন্তু পাহাড়ের ধারের সেই রট আয়রনের বেন্চিটি,যার সামনে বুনো ফুলের নক্সাকাটা সবুজ ঘাসের কার্পেট ,সেটি একান্তই আমার । তার সঙ্গে আর কারও তুলনা চলে না ।সে আমার একান্তই আপন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com