আধুনিক সময়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে পড়তে যাওয়া খুব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই নিজস্ব ফান্ডিং বা টিচিং বা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্স নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে যান। কিন্তু ইউরোপে অ্যাসিস্ট্যান্সশিপ পাওয়া বেশ কঠিন আর নিজস্ব ফান্ডিংও সবার পক্ষে ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়াটা সবচেয়ে সুবিধাজনক। আশার কথা হলো, আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর বেশ কিছু শিক্ষার্থী বিভিন্ন স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়তে যান। তবে সংখ্যাটি খুব বেশি নয়। আমার মতে, আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল ও পটেনশিয়াল অনুযায়ী সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বড় একটি সমস্যা হলো যথাযথ জ্ঞান, পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনার অভাব। আজ বলব সুইডেনে এসআই স্কলারশিপ নিয়ে কিছু কথা।
উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যে সুইডেন খুবই চমৎকার একটি দেশ। এটি খুবই উন্নত ও নিরাপদ এবং দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা খুবই আধুনিক। সুইডিশ ডিগ্রির রয়েছে অত্যন্ত সুনাম ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা। তবে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই ব্যয়বহুল। তাই সুইডেনে পড়তে গেলে বেস্ট অপশন হলো স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়া। আর সুইডেনের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস স্কলারশিপ হলো এসআই স্কলারশিপ। আজ চেষ্টা করব এ স্কলারশিপ নিয়ে কিছু গাইডলাইন দিতে।
সুইডেনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় রয়েছে ইংরেজি ভাষায় প্রায় ৯০০ স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম। এসআই স্কলারশিপে আবেদনের জন্য প্রথমে সুইডেনে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির আবেদন করতে হবে। প্রায় সব বিষয়েই ভর্তির আবেদন করতে পারবেন। এ জন্য লাগবে ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং আইইএলটিএস। একটি অ্যাপ্লিকেশনে চারটি বিষয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। আপনার পছন্দের কোর্স এবং এ–সংক্রান্ত সব তথ্য খুঁজে পাবেন www.universityadmissions.se সাইটে। এসআই স্কলারশিপে আবেদনের জন্য বাড়তি হিসেবে লাগবে তিন হাজার কর্মঘণ্টা কাজের অভিজ্ঞতা, ফুলটাইম কাজ করলে যা প্রায় দেড় বছরের কাজের অভিজ্ঞতার সমতুল্য। এসআই স্কলারশিপপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে অনেক সুযোগ-সুবিধা। স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের পুরো টিউশন ফির পাশাপাশি প্রতি মাসে পাওয়া যাবে ১০ হাজার সুইডিশ ক্রোনার বা ১ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার। রয়েছে এককালীন ১৫ হাজার ক্রোনারের ভ্রমণ অনুদান এবং স্বাস্থ্যবিমা, ভিসা ফিসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সুযোগ। সঙ্গে পাবেন নেটওয়ার্ক ফর ফিউচার লিডার্সের মেম্বারশিপ, যা আপনাকে শক্তিশালী একটি নেটওয়ার্ক গঠন করার সুযোগ করে দেবে।
এসআই স্কলারশিপ ছাড়াও সুইডেনের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নন-ইউরোপিয়ান ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদাভাবে স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ বৃত্তি সাধারণত টিউশন ফি বহন করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেলে বিশাল অঙ্কের টিউশন ফি দেওয়া লাগবে না, যা একটা বড় প্রাপ্তি। যেহেতু টিউশন ফির চিন্তা নেই, সে ক্ষেত্রে শুরুতেই থাকা-খাওয়া বাবদ কয়েক মাসের টাকা সঙ্গে করে নিয়ে এলে পরবর্তী সময়ে একটা খণ্ডকালীন কাজ জোগাড় করে মাসিক খরচ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপের জন্য সাধারণত আপনার সিজিপিএর ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
এবার এসআই নিয়ে কথা বলা যাক। এসআই স্কলারশিপের জন্য আবেদন করব—এ সিদ্ধান্ত আমি নিই ২০২০ সালের মে বা জুন মাসের দিকে। সত্যি কথা বলতে, এ স্কলারশিপ সম্পর্কে আমার জ্ঞানের প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপ Bangladeshi Incoming Students in Sweden (BISS) এবং si.se সাইট থেকে অর্জন করা। তাই আমি প্রথমেই বলছি, এ দুই জায়গায় ফোকাস দিন। এসআই–সংক্রান্ত সব পোস্ট বা তথ্য খুব ভালোমতো পড়ুন, কী কী ডকুমেন্টস লাগবে, তার লিস্ট করুন এবং বুঝতে চেষ্টা করুন, এসআই অথরিটি সম্ভাব্য স্কলারশিপ হোল্ডার হিসেবে আপনার কাছ থেকে কী ধরনের যোগ্যতা আশা করছে। তাহলেই আপনি অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবেন। মনে রাখবেন, এসআই অথরিটি আপনাকে মনোনীত করবে আপনার লিডারশিপ পটেনশিয়াল দেখে, তাই তাদের কাছে আপনার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। আপনি কীভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করেন, তার ওপরই নির্ভর করবে আপনি সিলেক্টেড হবেন কি না।
আমার কথা বলি। আমি রাফাত, এ বছর বাংলাদেশ থেকে KTH Royal Institute of Technology–তে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করার জন্য এসআই স্কলারশিপ পেয়েছি। আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট, ২০১৫–তে পাস করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি থেকে। আমার সিজিপিএ একদমই এভারেজ। মোট কাজের অভিজ্ঞতা পাঁচ বছর, এর মধ্যে লিডারশিপ এবং এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপের অভিজ্ঞতা তিন বছরের। সঙ্গে বেশ কিছু এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি এবং সোশ্যাল ওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত আছি। আমার মনে হয়, এর কাছাকাছি বা এর চেয়ে বেশি যোগ্যতা নিয়েও অনেকে হতাশ হয়েছেন। তাই আমি চেষ্টা করছি, সফল হওয়ার জন্য আমার ফলো করা গাইডলাইন তুলে ধরতে। একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, এসআই স্কলারশিপের জন্য আপনার কোনো পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ দিতে হবে না। তাই আপনি যে ডকুমেন্টগুলো পাঠাবেন (সিভি, মোটিভেশন, রেফারেন্স ইত্যাদি), সেগুলোর কনটেন্ট এবং প্রেজেন্টেশন হতে হবে প্রথম শ্রেণির। আমার মতে, নিচের ফ্যাক্টরগুলো আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলে ধরতে পারে।
পড়াশোনা, কাজ এবং মাস্টার্সের সাবজেক্ট চয়েসের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা। হতে পারে আপনি এক সাবজেক্টে অনার্স করেছেন, অন্য বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, সে ক্ষেত্রে মোটিভেশন লেটারে এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
এই পার্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, অথরিটি অবশ্যই মোটিভেটেড ক্যান্ডিডেট খুঁজবে। কিন্তু আপনার মোটিভেশন হতে হবে আপনার দেশ বা রিজিওনের উন্নয়নের জন্য এবং তা অবশ্যই এক বা একাধিক জাতিসংঘের (ইউএন) সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আমার উপদেশ হলো ইউএনের সাইটে গিয়ে গোলগুলো অ্যানালাইসিস করুন এবং আপনার পড়াশোনা ও কাজের সঙ্গে রিলেটেড গোলগুলো খুঁজে বের করুন।
রেফারেন্স লেটার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চেষ্টা করবেন একটা লেটার নেটওয়ার্ক বা সোশ্যাল এনগেজমেন্ট থেকে নিতে। এটা আপনাকে ডিরেক্ট অ্যাডভান্টেজ দেবে। সিভি লেখার সময় ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স আর সোশ্যাল এনগেজমেন্ট সেকশনে বেশি গুরুত্ব দেবেন। খেয়াল রাখবেন রেফারেন্স ও সিভি যেন আপনার মোটিভেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
চেষ্টা করবেন ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করার সময় একই ধরনের সাবজেক্ট চয়েজ করতে। এটা প্রমাণ করে আপনি জানেন যে আপনি কী করতে চান এবং আপনি হাইলি মোটিভেটেড।
মোটিভেশন লেটার লেখার সময় দুনিয়া উদ্ধারের প্ল্যান দেবেন না। আপনার প্ল্যান যেন বাস্তবসম্মত হয় এবং বিশেষ করে আপনার দেশ আর রিজিওনের উন্নয়ন যেন আপনার প্রধান উদ্দেশ্য হয়।
আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে আপনার সব ডকুমেন্টস সামঞ্জস্যপূর্ণ। আপনার সব ডকুমেন্টস যেন আপনার মোটিভেশনকে সাপোর্ট করে।
আমার মনে হয় এ স্ট্র্যাটেজিই আমাকে সফল হতে সাহায্য করছে। এগুলো কেবলই আমার ব্যক্তিগত মতামত। আর একটি অনুরোধ করব সবাইকে, চেষ্টা করবেন এজেন্সিগুলোকে এভয়েড করতে। এ আবেদন প্রক্রিয়াগুলো খুবই সহজ, একটু চেষ্টা করলে নিজেই পারবেন। সবাই ভালো থাকবেন এবং নিজের ওপর বিশ্বাস রাখবেন, আর স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবেন। কারণ, আপনি আপনার স্বপ্নের সমান বড়। আশা করি, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে আরও অনেক বেশি এসআই স্কলারদের অভিনন্দন জানাতে পারব।
লেখক রাফাত খান