শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩৪ অপরাহ্ন

সি পার্ল হোটেল: সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যেভাবে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন

  • আপডেট সময় বুধবার, ১০ মে, ২০২৩

শেয়ারবাজারে লোভে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বড় অঙ্কের লোকসানের কথা প্রায় সময় শোনা যায়। বিশেষ করে কারসাজির শেয়ারে বিনিয়োগ করে এ ক্ষতিতে তাঁরা বেশি পড়েন। লাভের আশা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য কীভাবে লোকসানের কারণ হয়, তার সর্বশেষ উদাহরণ হতে পারে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড হোটেল।

সি পার্ল কীভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য লোকসানের ফাঁদে পরিণত হলো, চলুন সেই হিসাব মিলিয়ে দেখা যাক। এ জন্য মেলাতে হবে কোম্পানিটির গত ৯ মাসের লেনদেন ও মূল্যবৃদ্ধির তথ্য। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত বছরের ১০ আগস্ট সি পার্লের প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৫৬ টাকা। ১০ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর প্রায় এক মাস এটির শেয়ারের দাম সর্বনিম্ন ৫৪ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫৭ টাকায় ঘুরপাক খায়। এ সময়ে কোম্পানিটির প্রায় ৩ কোটি শেয়ার হাতবদল হয়।

কোম্পানিটির মোট শেয়ারের সংখ্যা ১২ কোটি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা–পরিচালকদের হাতে রয়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশের মতো শেয়ার। বাকি ৫৫ শতাংশ বা প্রায় ৭ কোটি লেনদেনযোগ্য শেয়ার। এ লেনদেনযোগ্য শেয়ারের একটি বড় অংশই গত আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর—এ সময়ে হাতবদল হয়।

এরপর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ৯ মার্চ—এ ছয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য একটানা বেড়ে ৫৭ টাকা থেকে ৩২০ টাকায় উঠে যায়। তাতে মাত্র ছয় মাসে সি পার্লের শেয়ারের দাম ২৬৩ টাকা বা ছয় গুণ বেড়ে যায়।

লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়তে শুরু করলে অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী লাভের আশায় এ শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো লাভে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। যাঁরা বিক্রি করে দিয়েছেন, তাঁরা মুনাফা তুলে নিয়েছেন। আর যাঁরা বেশি লাভের আশায় শেয়ার ধরে রেখেছিলেন, তাঁরা পড়েছেন লোকসানের ঝুঁকিতে। কারণ, যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছিল, সেভাবেই এখন দাম কমতে শুরু করেছে।

গত সাত কার্যদিবসে সি পার্লের শেয়ারের দাম ৯৩ টাকা কমেছে। গতকাল সোমবার লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম নেমে এসেছে ২১০ টাকায়। অস্বাভাবিক উত্থানের পর দ্রুত যখন দাম কমতে থাকে, তখন দেখা দেয় ক্রেতা–সংকট। ফলে বিক্রি করতে চাইলেও অনেকে শেয়ার বিক্রি করতে পারেন না। তাতে লোকসানের বৃত্তে আটকা পড়েন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

গতকালও বাজারে কোম্পানিটির সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে। লেনদেন শুরুর অল্প সময়ের ব্যবধানে এটির বাজারমূল্য দিনের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। তখন বাজারে শেয়ারটির ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা ছিল অনেক বেশি। ফলে দাম কমলেও অনেকে শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি।

মূল্য সংবেদনশীল তথ্য

গত সেপ্টেম্বর থেকে কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছিল বেশ কিছু মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। এর মধ্যে ছিল ভালো মুনাফার খবর। তালিকাভুক্তির পর গত বছর সর্বোচ্চ লভ্যাংশ ঘোষণা ও পর্যটনসংক্রান্ত নতুন ব্যবসার সফলতা এবং উদ্যোক্তাদের শেয়ার কেনার ঘোষণা দেওয়া হয়। কোম্পানিটি জানিয়েছে, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ২০২২ সালে তারা ভালো ব্যবসা করেছে। পাশাপাশি ওয়াটার পার্ক ও পর্যটকবাহী জাহাজের ব্যবসায়ও তারা ভালো করেছে। এ কারণে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে মুনাফা বেড়েছে।

২০১৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছিল কক্সবাজারের একসময়কার রয়েল টিউলিপ নামে পরিচিত হোটেলটি। যদিও সেটির নাম বদলে এখন সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা করা হয়েছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর প্রথমবার ২০১৯ সালের জন্য কোম্পানিটি ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছিল। এরপর ২০২০ ও ২০২১ সালে ১ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল।

সর্বশেষ ২০২২ সালে জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছরের জন্য কোম্পানিটি সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে বিনিয়োগকারীদের জন্য। ভালো মুনাফা ও ভালো লভ্যাংশের এসব খবর কোম্পানিটির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছিল।

জানা গেছে, সি পার্লের শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইর পক্ষ থেকে একটি তদন্ত করা হয়েছে। সেখানে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের কিছু ঘটনা ঘটেছে বলে উঠে এসেছে। বর্তমানে তদন্ত প্রতিবেদনটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছি। ডিএসইর পক্ষ থেকে এরই মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনও কমিশনে দাখিল করা হয়েছে। সেটি এখন ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।’

রেজাউল করিম বলেন, সাধারণত কোনো কোম্পানির মূল্যবৃদ্ধি ও কমার বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিছু করে না। তবে এর পেছনে কোনো আইন লঙ্ঘন, কারসাজি ও ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের মতো ঘটনা থাকলে সেগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

সি পার্লের শেয়ারের দামের অস্বাভাবিক উত্থান ও এখন দ্রুত পতনের বিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক মোহাম্মদ মুসা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও দ্রুত পতন কোনোটাই যৌক্তিক নয়। আমাদের বাজার এখনো একটি অদক্ষ বাজার। অদক্ষ বাজারেই এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে।’

মোহাম্মদ মুসা বলেন, কিছুসংখ্যক মানুষ তাদের নিজেদের মুনাফার জন্য অস্বাভাবিক দাম বাড়ায়। আর দাম বাড়তে থাকলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে এসে তাতে সহায়তা করেন। বাজারে যদি ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীর চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বেশি থাকত, তাহলে এ ধরনের ঘটনা কম হয়। কিন্তু এখানে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারী বেশি বলে বিভিন্ন সময় শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com