সিঙ্গাপুরের সরকারী নাম “রিপাবলিক অফ সিঙ্গাপুর”। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। দেশটি মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণতম প্রান্তে, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মাঝখানে অবস্থিত। এটি মালয়েশিয়া থেকে জোহর প্রণালী এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন।
ষাট বছর আগেও যে দেশটিতে কিছু গরীব জেলে বসবাস করতো, সেখানে এখন সুরম্য অট্টালিকা, বহুতল ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে যেন আকাশটা ছোঁয়া যায়। একটা সময়ে দরিদ্র্য আর বেকার লোকজনে ভর্তি ছিল যে সিঙ্গাপুর, তারাই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের দেশগুলোর মধ্যে একটি, এশিয়ার বুকে এক টুকরো ইউরোপ বললেও বোধহয় ভুল হবে না সিঙ্গাপুরকে।
১। ১৯৫৯ সালে লি কুয়ানের নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর অভ্যন্তরীণ স্বশাসনক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়ালমুক্ত হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া ফেডারেশনে যোগ দিয়েছিল সিঙ্গাপুর, কিন্তু ফেডারেল সরকারের সঙ্গে ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর ক্ষমতার ভাগাভাগির প্রশ্নে লি কুয়ানের অতিরিক্ত দর-কষাকষি ও ঝগড়াঝাঁটিতে রুষ্ট হয়ে দুই বছরের মধ্যেই তৎকালীন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টুঙ্কু আবদুর রহমান পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত নিয়ে সিঙ্গাপুরকে মালয়েশিয়া থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
বাধ্য হয়ে ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং এক মাস পর পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ওই ঘোষণা দেওয়ার সময় লি কুয়ান বিশ্ব মিডিয়ার সামনে কেঁদে ফেলেছিলেন সিঙ্গাপুরের ভবিষ্যৎ ভেবে। অথচ, গত ৫৬ বছরে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার এক অবিস্মরণীয় রচনাগাথা করেছে সিঙ্গাপুর, যার রচয়িতা ছিলেন লি কুয়ান।
২। ৭২২.৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে প্রায় ৫৬ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের বসবাস। আয়তনের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের ১৭৬ তম বৃহত্তম দেশ।
৩। সিঙ্গাপুরের ৪টি দাপ্তরিক ভাষা রয়েছে। এগুলি হলঃ ইংরেজি, মালয়, চীনা মান্দারিন এবং তামিল। তবে সাধারন ভাষা হিসেবে এখানে ইংরেজিই প্রচলিত। এছাড়াও ব্যাবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও সরকারি কর্মকান্ডে প্রধানত ইংরেজিই ব্যবহৃত হয়।
৪। দেশটিতে ৪২.৫ শতাংশ বৌদ্ধ, ১৪.৯ শতাংশ মুসলিম, ১৪.৬ শতাংশ খ্রিস্টান এবং ৪ শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠীর বাস। বাকিরা অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী।
৫। সিঙ্গাপুরের এক হাজার ডলারের নোটের পিছনে দেশের জাতীয় সঙ্গীত লেখা থাকে। সিঙ্গাপুরের জাতীয় সঙ্গীত হল মালয় ভাষায়, “মাজুলা সিঙ্গাপুর” বা সিঙ্গাপুর এগিয়ে চলো।
৬। সিঙ্গাপুরের নাগরিকরা বেশিরভাগ কথার শেষে ‘লা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এই যেমন ‘ওকে’কে বলেন ‘ওকে-লা’, “থ্যাঙ্কউ” বলার সময় বলেন ‘থ্যাঙ্কউ-লা’।
৭। এই দেশে পাঁচ বা তার বেশি লোকজনের ক্ষেত্রে কোথাও জড়ো হতে গেলে পুলিসের নানা কড়া নিয়মাবলি মানতে হয়।
৮। সিঙ্গাপুরকে বলা হয় সিংহের শহর বা লায়ন সিটি। অথচ বাস্তবে গোটা সিঙ্গাপুরে একটাও সিংহ নেই।
৯। সিঙ্গাপুরে মাত্র একটাই দল রয়েছে। দলটির নাম ‘পিপলস অ্যাকশন পার্টি’। ১৯৫৯ সাল থেকে ‘পিপলস অ্যাকশন পার্টি’ দেশের ক্ষমতায় রয়েছে। ভোট পরিচালনা করে এই দলই।
১০। সমকামিতা এখানে বেআইনি তবে জুয়া খেলা এই দেশে বৈধ। ২০১০ সালে পাবলিক টয়েলটে ২৮ বছরের যুবকের সঙ্গে ওরাল সেক্স করার অপরাধে ৩ হাজার ডলার জরিমানা হয় ৪০ বছরের এক পুরুষের।
Source: pixabay.com
১১। ১৯০৫ সাল থেকে মোট ৬ বার টাইম জোন পরিবর্তন করে সিঙ্গাপুর। ১৯৮২ সালে সিঙ্গাপুর শেষবার তাদের টাইম জোন পরিবর্তন করে। এখন সিঙ্গাপুরের টাইম জিএমটি-র থেকে আট ঘণ্টা এগিয়ে।
১২। সিঙ্গাপুরের নাগরিকরা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততম হাঁটা মানুষ। ১০.৫৫ সেকেন্ডে সিঙ্গাপুরিয়ানরা হাঁটে ১৮ মিটার, মানে ঘণ্টায় ৬.১৫ কিলোমিটার। সেখানে ভারতীয়দের হাঁটার গতি ঘণ্টায় গড়ে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার।
১৩। ২০০৫ সালে এই দেশে জুয়া খেলাকে বৈধতা প্রদান করা হয়।
১৪। নিজের ঘরের মধ্যে নগ্ন থাকলেও আইনত শাস্তি হতে পারে সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের। কারণ আইন অনুযায়ী নগ্ন অবস্থায় কেউ দেখে ফেললেই যিনি নগ্ন ছিলেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যাবে।
Source: pixabay.com
১৫। সিঙ্গাপুরে সেক্স টয় বা অশ্লীল ম্যাগাজিন কেনা বেচার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেক্স টয় বা অশ্লীল ম্যাগাজিন কিনলে বা বেচলে ৩ মাসের জেল ও মোটা টাকার জরিমানা হয়।
১৬। আত্মহত্যার চেষ্টা করা সিঙ্গাপুরে আইন বিরুদ্ধ কাজ। পেনাল কোডের ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে মানুষদের জেল হয় সিঙ্গাপুরে।
১৭। এখানে ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফির উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইন্টারনেটে গান বা সিনেমা ডাউনলোড করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
১৮। সিঙ্গাপুরের ডাক নাম ফাইন সিটি বা জরিমানার শহর। কারণ বিভিন্ন ছোট ছোট কারণে এখানে জরিমানার ব্যবস্থা আছে।
১৯। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হওয়া জায়গা গুলির মধ্যে অন্যতম হল সিঙ্গাপুর। বছরে গড়ে ১৭১ বার বাজ পড়ে এই শহরে।
২০। ১৯৯২ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে চুইংগাম নিষিদ্ধ। কারণ চুইংগামে পথচারীদের অসুবিধা হয়।
২১। কোটিপতি বাসিন্দার শতকরা হারের নিরিখে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে সিঙ্গাপুর। দেশের ৬ জন গৃহস্থালির মধ্যে একজন এক মিলিয়ন ডলারের মালিক।
২২। সিঙ্গাপুরে সরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সায় চিকিৎসা হয়। সরকারি স্কুলে শিশুদের পড়ার খরচ লাগে না।
২৩। সিঙ্গাপুরের চিড়িয়াখানায় কোনও খাঁচা নেই। পশুপাখিদের কার্যত উন্মুক্ত রাখা হয়। রাতে চিড়িয়াখান খোলা থাকে, নাইট সাফারির ব্যবস্থা আছে।
২৪। সব শিশু ও কিশোর-কিশোরীকে স্কুলে পাঠানো মা-বাবার জন্য বাধ্যতামূলক—এই আইন না মানলে জেলে যেতে হবে মা-বাবাকে। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালগুলো বিশ্বসেরা; বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও পলিটেকনিকগুলোর মান প্রতীচ্যের সঙ্গে তুলনীয়।
২৫। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিচারে সিঙ্গাপুরের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। তবু সিঙ্গাপুরকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিংবা রাজনৈতিকভাবে মুক্ত সমাজ বলা যাবে না।
২৬। সিঙ্গাপুরের মুদ্রার নাম হচ্ছে সিঙ্গাপুরি ডলার। ১ সিঙ্গাপুরি ডলার সমান প্রায় ৬১ টাকা।
২৭। দেশটির মোট জিডিপি প্রায় ৩৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবং মাথাপিছু আয় প্রায় ৬৫,৬২৭ মার্কিন ডলার।