সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন

সিঙ্গাপুর থেকে কেন অর্থ পাচারকারীরা চলে যাচ্ছেন

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৩

সিঙ্গাপুরকে এশিয়ার ‘বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট’ বলা হয়। আবার কর ফাঁকির ‘অভয়ারণ্য’ বলে কুখ্যাতি আছে। পাচার করা টাকা লুকিয়ে রাখার জন্য সিঙ্গাপুর অনেকেরই পছন্দের জায়গা। সেই সিঙ্গাপুর অনেকের জন্যই রহস্যময় আচরণ করেছে বলা যায়। অনেকেই এখন আর সিঙ্গাপুরকে কর ফাঁকির অভয়ারণ্য মনে করতে পারছেন না। ফলে অর্থ পাচারকারী অনেকেই সিঙ্গাপুর থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে চাচ্ছেন। অনেকে চলেও গেছেন। অর্থ পাচারকারীদের নতুন গন্তব্য দুবাই ও সাইপ্রাসের মতো এলাকা, যেখানে অর্থ লুকিয়ে রাখা সম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সিঙ্গাপুর থেকে অর্থ পাচারকারীরা চলে যাচ্ছেন।

কেন সিঙ্গাপুর কঠোর হচ্ছে

অর্থের অবৈধ ব্যবহার সারা বিশ্বের জন্যই বড় মাথাব্যথা। জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে অবৈধ অর্থপ্রবাহের পরিমাণ আট শ বিলিয়ন থেকে দুই ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৫ শতাংশ। এক বিলিয়ন হচ্ছে এক শ কোটি এবং এক ট্রিলিয়ন হচ্ছে এক হাজার বিলিয়ন। আবার দেখা যাচ্ছে, সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির যে আকার, তার তুলনায় দেশটির আফশোর তহবিল বহুগুণ বেশি। যেমন মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের (এমএএস) তথ্য হচ্ছে, সিঙ্গাপুরের জিডিপি হচ্ছে ৬৪০ বিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার (৪৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। আর দেশটি ৪ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ ব্যবস্থাপনা করে, যার ৮০ শতাংশ অর্থই সিঙ্গাপুরের বাইরে থেকে আসে।

বারাক ওবামা
বারাক ওবামা

বারাক ওবামা ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফরেন অ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স অ্যাক্ট (এফএটিসিএ)’ নামের গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন পাস করেছিলেন। এটি মূলত মার্কিন নাগরিকদের কর ফাঁকি বন্ধের আইন। আইন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নয়, এমন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানও মার্কিন নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। এই আইন না মানলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কেউ ব্যবসা করতে পারবেন না। এর পরেই আরও অনেক দেশ একই ধরনের আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়। আবার ২০১৪ সালে জি-২০ ও ওইসিডিভুক্ত ৪৭টি দেশ এই লক্ষ্যে তথ্য আদান-প্রদানের একটি অভিন্ন প্রক্রিয়া বা ‘কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড’-এর একটি কাঠামো গড়ে তোলে। মূলত এটি একটি স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময় কাঠামো বা অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন ব্যবস্থা। ২০১৭ সাল থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। এসবের ফলে সুইস ব্যাংকসহ অন্যরাও তথ্য দিতে বাধ্য হচ্ছে। পাশাপাশি কর ফাঁকি যারা দেয়, তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বিশ্বজুড়ে ব্যাংকগুলোকে মোটা অঙ্কের জরিমানাও দিতে হচ্ছে।

মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। দুর্নীতির দায়ে তাঁকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। দুর্নীতির দায়ে তাঁকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।ফাইল ছবি রয়টার্স

সিঙ্গাপুর অবশ্য নড়েচড়ে বসে মালয়েশিয়ার কুখ্যাত ওয়ান মালয়েশিয়ান ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ বা ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির পর থেকে। ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে এই রাষ্ট্রীয় তহবিল গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এই তহবিল থেকে হাওয়া হয়ে যায় সাড়ে চার শ কোটি ডলার। সেই অর্থ গেছে কয়েক ব্যক্তির পকেটে। এর মধ্যে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকও ছিলেন। চীনা বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী লো তায়েক ঝোকে বলা হয় এই কেলেঙ্কারির হোতা। ২০১৩ সালের বিখ্যাত হলিউড সিনেমা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর দ্য উলফ অব ওয়ালস্ট্রিট এর অন্যতম লগ্নিকারী ছিলেন তায়েক ঝো এবং নাজিব রাজাকের সৎপুত্র রিজা আজিজ।

এই সিনেমার অর্থের উৎস খুঁজে বের করতে গিয়েই সাংবাদিকেরা এই কেলেঙ্কারির রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছিলেন। মূলত ছয়টি দেশের ব্যাংক–ব্যবস্থা ব্যবহার করেই এই অর্থ পাচার করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সিঙ্গাপুর। ফলে বদনামের ভাগী হওয়া ছাড়াও আন্তর্জাতিক মহলেও চাপের মধ্যে পড়ে যায় সিঙ্গাপুর। এরপরে নিজেদের নিষ্কলুষ করতে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে দেশটি। কিন্তু তত দিনে কর ফাঁকির অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছে দেশটি। এ থেকে বের হতে কিছু একটা করার চেষ্টা ছিল তাদের।

এই যদি হয় অবস্থা, তাতে সিঙ্গাপুর থেকে যে অনেকেই পালাতে চাইবেন, সেটি তো সত্যিই।

এর পরেই ২০১৬ সালে গঠন করা হয় দ্য ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স। ২০১৮ সালে পাস করা হয় অ্যান্টি–মানি লন্ডারিং অ্যান্ড টেররিজম ফাইন্যান্সিং আইন। তাতেও কাজ হচ্ছিল না। ফলে আরও কঠোর আইনের দিকে যায় দেশটি। এরপর ২০২৩ সালে সিঙ্গাপুর আরও কঠোরভাবে ‘নিউ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং অ্যান্ড টেররিজম ফাইন্যান্সিং’ আইনটি পাস করে। এটি ২০২৩ সালের ২৮ জুন থেকে কার্যকর করা হয়েছে। আর এরপরই ভয় পেয়েছেন সিঙ্গাপুরে থাকা বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচারকারীরা, যাঁরা দেশটিতে নামে–বেনামে কোম্পানি খুলেছিলেন বা কিনেছিলেন হোটেল, গাড়ি, বাড়িসহ নানা ধরনের সম্পত্তি।

কী আছে নতুন আইনে

ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছিল ২০১৬ সালে। তখন দুটি রিয়েল এস্টেট এজেন্টকে জরিমানা করা হয়েছিল সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য না জানানোর জন্য। এর মধ্যে একটি ছিল ২ কোটি ৩৮ লাখ সিঙ্গাপুর ডলারে সান্তোসা কোভে একটি বাংলো এবং আরেকটি ছিল নতুন কনডেমোনিয়ম ইউনিট বিক্রিসংক্রান্ত। এমন দুজন ব্যক্তির কাছে তা বিক্রি করা হয়েছিল, যাঁরা পরে অপরাধী প্রমাণিত হয়েছেন। এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে কারণেই নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষার পরে নতুন এই আইন।

নতুন আইন অনুযায়ী গত ২৮ জুন থেকে দেশটির রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের নতুন কিছু বিধিমালা মানতে হচ্ছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারকে গ্রাহকের যথাযথ পর্যালোচনা (কাস্টমার ডিউ ডিজিলেন্স-সিডিডি) করতে হবে, সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য জানাতে হবে এবং লেনদেনের রেকর্ড পাঁচ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে। অর্থাৎ অবশ্যই ক্রেতা কে, কোন দেশের নাগরিক এবং অর্থের উৎস যাচাই করতে হবে।

যিনি কিনবেন তাঁর প্রকৃত পরিচয় থাকতে হবে। অজ্ঞাত, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বা ছদ্মনামের কারও কাছে কোনো সম্পত্তি বিক্রি করা যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে জরিমানার পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ এক লাখ সিঙ্গাপুর ডলার। আর যদি কেউ স্বেচ্ছায় বা জেনেশুনে এসব কাজে সম্পৃক্ত থাকেন, তাহলে জেল তো হবেই, ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল থাকবে সর্বোচ্চ ১২ মাস পর্যন্ত। সব মিলিয়ে কাজটি কীভাবে হবে, তার একটি গাইডলাইনও প্রকাশ করা হয়েছে। ৫৩ পৃষ্ঠার গাইডলাইনের নাম হচ্ছে ‘গাইডলাইনস ফর ডেভেলপার অন অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কাউন্টার টেররিজম ফাইন্যান্সিং’। এমনকি এই আইন পাস হওয়ার আগে লেনদেন হলে সে ক্ষেত্রেও নতুন এই বিধিমালা প্রযোজ্য হবে।

আসছে কসমিক

দ্য মনেটরি অথরিটি অব সিঙ্গাপুর (এমএএস) হচ্ছে মূলত দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা আরও ছয়টি বড় ও প্রধান ব্যাংকের সঙ্গে মিলে কসমিক নামে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। কসমিক হচ্ছে, ‘কলাবরেটিভ শেয়ারিং অব মানি লন্ডারিং/টেররিজম ফাইন্যান্সিং ইনফরমেশন অ্যান্ড কেসেস’। সিঙ্গাপুরের যে ছয়টি প্রধান ব্যাংকে এই কসমিক ব্যবহার করবে, তারা হলো ডিবিএস গ্রুপ হোল্ডিংস, ওভারসিজ চায়নিজ ব্যাংকিং করপোরেশন (ওসিবিসি), ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংক (ইউওবি), স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (এসসিবি), সিটিব্যাংক ও এইচএসবিসি।

কসমিকের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, ব্যাংকের আর্থিক অপরাধের ঝুঁকি কমানো। মূলত তিনটি কাজ করবে তারা। যেমন বৈধ ব্যক্তির অপব্যবহার বা শেল কোম্পানির অপব্যবহার, অবৈধ কাজে বাণিজ্য অর্থায়নের অপব্যবহার এবং যেকোনো ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র (পারমাণবিক, রাসায়নিক) তৈরির উপাদান উৎপাদন, মজুত বা সরবরাহ বন্ধ করতে এর অর্থায়ন বন্ধ করা। কসমিকের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পরের মধ্যে তথ্য আদান–প্রদান করবে এবং আর্থিক অপরাধ ঘটার সুযোগ আছে, এমন বিষয়গুলো চিহ্নিত করবে। কোনো ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন দেখলে তা তারা জানাবে।

সিঙ্গাপুরের সংসদ গত ৯ মে এ বিষয়ে একটি আইন পাস করে। আইনের নাম ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অ্যান্ড মার্কেটস (সংশোধন) বিল ২০২৩। নতুন আইনে যাঁরা অফশোর বা শেল কোম্পানির আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন, তাঁদের চিহ্নিত করা হবে। ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এই কসমিক চালু হবে। সুতরাং যাঁরা অন্যের নামে সেখানে সম্পত্তি করেছেন এবং পাচার করা অর্থ নামে-বেনামে ব্যাংকে লেনদেন করছেন, তাঁরা বড় বিপাকে পড়বেন কসমিক চালু হলে।

গত মঙ্গলবারের অভিযান

গত মঙ্গলবার বিদেশ থেকে পাচার করে আনা প্রায় ১০০ কোটি ডলারের অর্থসম্পদ জব্দ করেছে সিঙ্গাপুর পুলিশ। সিঙ্গাপুর পুলিশ ফোর্স (এসপিএফ) পরিচালিত এই অভিযানকে দেশটির ইতিহাসে মানি লন্ডারিংবিরোধী সবচেয়ে বড় অভিযানগুলোর একটি বলা হচ্ছে। অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নারীসহ ১০ জনকে। এ ছাড়া আরও ১২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। আর আটজন সন্দেহভাজন পলাতক। এই ব্যক্তিরা ধনী এলাকার বাসিন্দা। তাঁরা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। বিলাসী জীবন যাপন করতেন। সিঙ্গাপুরের পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবারের অভিযানে ৯৪টি জমি এবং ৫০টি গাড়ির নামে নিষেধাজ্ঞা আদেশ জারি করা হয়েছে।

এর অর্থ হলো, মালিকেরা এসব জমি ও গাড়ি বিক্রি করতে পারবেন না। এসব জমি ও গাড়ির মোট মূল্য ৮১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বেশি। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ মদের বোতল জব্দ করা হয়েছে। অভিযানে ৩৫টির বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। এসব অ্যাকাউন্টে ১১ কোটি ডলারের বেশি অর্থ জমা রয়েছে। এ ছাড়া জব্দের তালিকায় রয়েছে অনলাইনে সম্পদ থাকার ১১টি নথি, ২টি সোনার বার, ২৫০টির বেশি দামি ব্যাগ ও ঘড়ি, ১২০টির বেশি মুঠোফোন ও কম্পিউটার, ২৭০টির বেশি দামি অলংকার। জব্দ করা অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের বেশি।

এমএএস এই ঘটনার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দিয়েছে। সেখানে তারা বলেছে, অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য সিঙ্গাপুরের আর্থিক খাতের অপব্যবহার তারা আর সহ্য করবে না। অভিযানটি পরিচালনা করেছে দেশটির কমার্শিয়াল অ্যাফেয়ার্স বিভাগ। মূলত তাদের অর্থের লেনদেন যে সন্দেহজনক সেই তথ্য এমএসকে সরবরাহ করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি গোয়েন্দা তথ্যও ছিল। মিথ্যা তথ্য ও জাল কাগজ ব্যবহার করে ব্যাংক হিসাব খুলে লেনদেন করা হয়েছিল।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com