একটা সময় ছিল, যখন সিঙ্গাপুর মানেই ছিল জেলে বসতির এক ছোট্ট দ্বীপ, যার মাথাপিছু আয় ছিল বিশ্বের সর্বনিম্নের তালিকায়। অথচ আজ? সিঙ্গাপুর মানেই ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন রাস্তা, আকাশচুম্বী ভবন, নির্ভরযোগ্য আইন-শৃঙ্খলা আর সুশৃঙ্খল জীবনযাপন।
আমি যখন সিঙ্গাপুরে ভ্রমণে যাই, তখন চোখে দেখা এই অনন্য পরিবেশের পেছনে থাকা রহস্য খুঁজতে শুরু করি। কীভাবে এত ছোট একটি দেশ এমন বিস্ময়কর সাফল্যের মুখ দেখল?
চিন্তা করতে করতে আমি চারটি গুরুত্বপূর্ণ ‘রহস্য’ খুঁজে পাই—যা আজ সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের অন্যতম উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
১। স্বপ্ন দেখা যায় যেখানে—বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য
সিঙ্গাপুরে ব্যবসা শুরু করা যেনো স্বপ্ন দেখা এবং সেটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো সহজ! এখানে নেই লভ্যাংশের উপর কর, নেই উত্তরাধিকার বা উপহারের উপর কর—এমনকি সোনা-রুপার কেনাবেচাতেও নেই কোনো ট্যাক্স।
ভাবুন একবার, আপনি একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির কর্পোরেট প্রধান, আপনার হাতে রয়েছে মিলিয়ন ডলারের বাজেট—আপনি কোথায় অফিস খুলবেন? এক দেশ যেখানে করের হার ৩০%, অন্যদিকে সিঙ্গাপুর যেখানে প্রায় শূন্য!
এমন বাধাহীন, উদার আর করপথমুক্ত অর্থনৈতিক পরিবেশই সিঙ্গাপুরকে করে তুলেছে বিনিয়োগকারীদের প্রিয় ঠিকানা।
২। রাষ্ট্র চালায় যখন যোগ্যরা—সরকারি খাতের দক্ষতা
সিঙ্গাপুরের সরকারি চাকরি মানে শুধু সম্মান নয়, বরং উচ্চ দক্ষতার প্রতীক। এখানে মেধাবী তরুণরা সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিদেশে যান, বিশ্বমানের শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং শর্ত অনুযায়ী ফিরে এসে দেশের প্রশাসনে কাজ করেন।
সরকার তাদের জন্য নির্ধারণ করেছে মোটা বেতন, পারফরম্যান্সভিত্তিক বোনাস এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা।
সিঙ্গাপুরে ‘সরকারি কর্মকর্তা’ মানে দায়িত্ববান, দক্ষ এবং সেবাপরায়ণ এক শ্রেণি—যাদের উপর রাষ্ট্রের ভরসা শতভাগ।
৩। পরিকল্পনার গায়ে লেগে থাকা প্রতিশ্রুতি—মহাপরিকল্পনা
এখানে কিছুই হয় না হঠাৎ করে। শহরের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ভবন এমনকি গাছগুলোর অবস্থানও এসেছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে।
১০–১৫ বছরের মাঝারি মেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে। আর প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সেই পরিকল্পনার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
Gardens by the Bay-এর মতো প্রকল্প শুধু একটি পার্ক নয়, এটি পরিকল্পনার সৌন্দর্য ও দূরদর্শিতার প্রতীক—যেখানে প্রযুক্তি, প্রকৃতি ও পর্যটন মিলেছে এক সুতোয়।
৪। রাজনীতিতে যখন থাকে ধারাবাহিকতা—স্থিতিশীল নেতৃত্ব
১৯৫৪ সালে ছাত্র আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া ‘পিপলস অ্যাকশন পার্টি’ আজও সিঙ্গাপুরের প্রধান রাজনৈতিক দল।
দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ইউ টানা তিন দশক দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল দূরদর্শিতা, হাতে ছিল কঠোর শৃঙ্খলা।
তিনি বলেছিলেন, “I always tried to be correct, not politically correct.”
এই স্থিতিশীল নেতৃত্বই সিঙ্গাপুরকে তৃতীয় বিশ্ব থেকে প্রথম বিশ্বে নিয়ে আসে—যেখানে জনগণ জানে, তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ঝুঁকির শিকার নয়।
সিঙ্গাপুর শুধুই একটি পর্যটনস্থল নয়—এটি এক জীবন্ত পাঠশালা।
পরিকল্পনা, শৃঙ্খলা, দক্ষতা ও নেতৃত্ব—এই চারটি শক্তির সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে এই অর্থনৈতিক অলৌকিকতা।
আমরা যদি শুধু বিদেশ ঘুরে এসে ছবি তোলা বা শপিং করায় সীমাবদ্ধ না থাকি, বরং এই জাতিগুলোর শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব, স্বচ্ছতা আর পরিকল্পনার পাঠ গ্রহণ করি—তবে হয়তো আমাদের দেশেও একদিন তৈরি হবে এমন একটি গল্প, যা শুনে বিশ্বের অন্যরা বলবে:
“বাংলাদেশ—এক বিস্ময়ের নাম
Like this:
Like Loading...