বিশ্বের বিত্তশালী কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে মহাকাশে পর্যটন ব্যবসা শুরু করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্র্যানসন সম্প্রতি তার কোম্পানি ভার্জিন গ্যালাকটিকের ইউনিটি রকেটে চড়ে মহাকাশের দ্বারপ্রান্ত থেকে ঘুরে এসেছেন। অনলাইন সুপারমার্কেট অ্যামাজনের মালিক জেফ বেজোসও প্রতিষ্ঠা করেছেন স্পেস কোম্পানি ব্লু অরিজিন। এমাসেই তাদের নিজস্ব রকেটে করে তার মহাকাশে যাওয়ার কথা রয়েছে। আরেক প্রযুক্তি ব্যবসায়ী ইলন মাস্কও মহাকাশে যাওয়ার জন্য তার স্পেস এক্স কোম্পানি থেকে কম খরচে মহাকাশে যাওয়ার রকেট তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মহাকাশ জয় করার স্বপ্ন মানুষের বহু দিনের। অনেক নভোচারী ইতোমধ্যে পৃথিবীর বাইরে থেকে ঘুরে এসেছেন। সাতজন ধনী ব্যক্তি বেড়াতে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনেও। এখনও পর্যন্ত মোট ৫৮০ জন মহাকাশে গেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমার আর আপনার মতো সাধারণ মানুষজনও কি মহাশূন্যে বেড়াতে যেতে পারবো?
এই প্রশ্নটি জোরালো হয়েছে স্যার রিচার্ড ব্র্যানসনের মহাকাশে উঁকি দিয়ে আসার পর। তিনি নিজেও বলেছেন, এরকম অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনে একবারই হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো থেকে আরো পাঁচজন আরোহীকে নিয়ে মহাকাশ অভিমুখে উড়ে যান রিচার্ড ব্র্যানসন। তার রকেটের গতি ছিল ঘণ্টায় তিন হাজার কিলোমিটার। এক পর্যায়ে তারা কয়েক মিনিট ধরে ভরশূণ্যতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এসময় তাদেরকে রকেটে ভেতরে ভেসে বেড়াতে দেখা যায়।
সেখান থেকে শিশুদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “পৃথিবীর শিশুরা শোন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। এখন আমি বড় হয়েছি, এবং একটি মহাকাশ যানে বসে আছি। নিচের দিকে তাকিয়ে আমরা আমাদের সুন্দর পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছি। আগামী প্রজন্মের স্বাপ্নিকদের বলছি, আমরা যদি এটা করতে পারি, তাহলে ভেবে দেখ যে তোমরা কী করতে পারবে!”
পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু করে ৫৩ মাইল উপরে গিয়ে রিচার্ড ব্র্যানসনের মাটিতে ফিরে আসতে সময় লেগেছে এক ঘণ্টার কিছু বেশি।
ছবির উৎস,VIRGIN GALACTIC
রিচার্ড ব্র্যানসন গিয়েছিলেন যেখানে মহাকাশ এবং বায়ুমণ্ডলের সীমান্ত সেখানে। এই জায়গাটি কারমেন এলাকা নামে পরিচিত। এখান থেকেই মহাকাশের শুরু।
ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক এন্ড এটমোসফেয়ারিক এডমিনিস্ট্রেশন বা নোয়া-র সংজ্ঞা অনুসারে পৃথিবী থেকে ৬২ মাইল উপরে কারমেন রেখা এবং তার পরেই মহাকাশের শুরু।
সেই হিসাবে রিচার্ড ব্র্যানসন মহাকাশে যাননি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী ও মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসার সংজ্ঞা অনুযায়ী মহাকাশের শুরু ৫০ মাইল উপরে।
নাসার মহাকাশ বিজ্ঞানী ড. অমিতাভ ঘোষ বলছেন, “এই দুটো হচ্ছে পৃথিবী ও মহাকাশের সীমান্তের সংজ্ঞা। কিন্তু কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল সেটা বলা কঠিন।”
“মূলত তিনি গিয়েছিলেন বায়ুমণ্ডল যেখানে শেষ হয়েছে সেই জায়গাতে। বায়ুমণ্ডল তো হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায় নি। সেটা শেষ হয়ে ধীরে ধীরে। সেখান থেকেই মহাকাশের শুরু,” বলেন তিনি।
ভার্জিন গ্যালাকটিক মহাকাশে বাণিজ্যিক ভ্রমণ চালু করার জন্য চেষ্টা শুরু করে ২০০৪ সালে। এর মধ্যে একবার রকেটে বিস্ফোরণের পর সেই চেষ্টা থেমে যায়। কিন্তু ১৭ বছর পরে এসে সেই স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে গেল তারা।
রিচার্ড ব্র্যানসন বলেন এই পরীক্ষামূলক ফ্লাইটের মধ্য দিয়ে মহাকাশে পর্যটনের এক নতুন যুগের সূচনা ঘটবে।
অমিতাভ ঘোষ বলছেন, “বর্তমানে মহাকাশ বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এটাকে বলতে পারেন তারা একটি স্পেস ইন্ডাস্ট্রি বা মহাকাশ শিল্প তৈরি করার চেষ্টা করছে।”
ছবির উৎস,VIRGIN GALACTIC
তিনি বলেন, “রিচার্ড ব্র্যানসন যেখানে গেছেন সেটা তো মহাকাশের অগভীর অংশ। সেখান থেকে মহাকাশ শুরু হয়েছে মাত্র। তিনি গেছেন ৫০ মাইল দূরে। পৃথিবীর একটু উপরে। তো সেটাকে কি আমরা মহাকাশ পর্যটন বলবো!”
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস পৃথিবী থেকে আড়াইশো মাইল উপরে। আর চাঁদ দুই লাখ মাইলেরও বেশি দূরে।
তবে এরকম আঙ্গুলে গোনা দুই একজন বিত্তশালী ব্যক্তির মহাকাশে যাওয়াকে পর্যটন বলতে রাজি নন নাসার এই বিজ্ঞানী।
তিনি বলেন,”তখনই আমি সেটাকে মহাকাশ পর্যটন বলবো যখন একজন সাধারণ কাস্টমার টিকেট কিনে সেখানে যাবেন। এছাড়াও একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে সেখানে যেতে হবে। দু’একজন বিশেষ ব্যক্তি মহাকাশে গেলেই তো সেটাকে পর্যটন বলা যাবে না। তবে আমি বলবো যে আমরা এখন সেদিকেই আমরা অগ্রসর হচ্ছি।”
বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণে ভার্জিন গ্যালাকটিকে উদ্যোগ নেওয়ার ১৭ বছর পর তারা পরীক্ষামূলকভাবে মহাকাশের কাছাকাছি যেতে সক্ষম হলো।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে যানবাহন।
ড. ঘোষ বলেন, “ধরুন, আপনি ট্রেনে করে কোথাও যাচ্ছেন। তখন শুধুমাত্র মেকানিক্যাল কিছু ফ্রিকশন বা সংঘর্ষের মতো বাধা অতিক্রম করতে পারলেই ট্রেনটা চলতে শুরু করবে। কিন্তু মহাকাশে যেতে হলে আপনাকে খুব দ্রুত গতিতে যেতে হবে যেটাকে বলা হয়ে এসকেপ ভেলোসিটি যা অর্জন করা খুব কঠিন এবং ব্যয়বহুল।”
একটা বলকে যদি এতো জোরে উপরের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয় যে সেটা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না তখন সেটাকে বলা হয় এসকেপ ভেলোসিটি। পৃথিবীতে এই গতি হচ্ছে সেকেন্ডে প্রায় সাত মাইল।
ছবির উৎস,GETTY IMAGES
এতো জোরে কোন কিছু ছুঁড়তে গেলে প্রচণ্ড শক্তির প্রয়োজন। এজন্য যে পরিমাণ জ্বালানী দরকার তার মূল্যও অনেক। এছাড়াও পৃথিবীর কক্ষপথে বা মহাকাশের যেখানে যাওয়া হবে সেখানে এই জ্বালানী সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে।
“যদি আমরা মঙ্গলে যাই এবং সেখানে জ্বালানি পাওয়া যায় তাহলে সেখান থেকে জ্বালানি নিয়ে আমরা পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবো,” বলেন তিনি।
আরো একটি সমস্যা হচ্ছে, মহাকাশে যে রকেটই পাঠানো হচ্ছে, স্পেস এক্স-এর অতি সাম্প্রতিক কিছু মহাকাশযান বাদ দিয়ে, সেটা তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে সেটা আর দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
“আপনি ভাবুন যে ট্রেনে করে কোথাও গেলেন এবং তার পর ট্রেনটা ধ্বংস হয়ে গেল। আপনার ফিরে আসার জন্য আরেকটা ট্রেন বানাতে হবে। তখন তো ট্রেন যাত্রার খরচও অনেক বেড়ে যাবে,” বলেন ড. ঘোষ।
নাসার বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ মনে করেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এসব অবকাঠামো তৈরি হয়ে যাবে।
“ইলন মাস্ক একটা মহাকাশযান তৈরিতে কাজ করছেন যার নাম স্টারশিপ। এর পরীক্ষা নিরীক্ষাও চলছে। এর মধ্যে অনেকগুলো পরীক্ষা হয়ে গেছে। এই মহাকাশ যানে করে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার একটা পরিকল্পনা আছে।”
তিনি বলেন, যদি এসব অবকাঠামো তৈরি করা যায় তাহলে মহাকাশে পর্যটন শুরু করা সম্ভব। প্রথমত যদি এরকম একটা যান তৈরি করা যায় যা দিয়ে মহাকাশে গিয়ে ফেরত আসার পর, সেটি রক্ষণাবেক্ষণের পর ওই একই যান দিয়ে আবার মহাকাশে যাওয়া যায়, দ্বিতীয়ত পৃথিবীর বাইরে কক্ষপথে বা কোথাও জ্বালানি তৈরি করা যায় তাহলেই এই পর্যটন সম্ভব।
অমিতাভ ঘোষ মনে করেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যেই এসব হয়ে যাবে আর তখন সত্যিকারের মহাকাশ পর্যটন শুরু হবে।
ব্লু অরিজিনের কয়েকশ টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে যার দাম দুই লাখ মার্কিন ডলার। ভার্জিন গ্যালাকটিকও ছ’শোর মতো টিকেট অগ্রিম বিক্রি করেছে আড়াই লাখ ডলার দরে।
তাহলে কি মহাকাশে শুধু বিত্তশালীরাই যেতে পারবেন? আপাতত এর উত্তর: হ্যাঁ শুধু ধনীরাই যেতে পারবেন।
ছবির উৎস,GETTY IMAGES
নাসার বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ বলেন, “দেখুন কতজন মানুষ বাংলাদেশ থেকে ইংল্যান্ডে বেড়াতে যেতে পারেন? যাদের অর্থ আছে তারাই পারেন। মহাকাশে গেলে হয়তো আরো একটু বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে।”
তবে তিনি মনে করেন এই খরচ নামিয়ে আনা সম্ভব।
“মোটামুটি ১০ বছর পর ৫০ হাজার ডলারে মানুষ হয়তো চাঁদে যেতে পারবে। এবং এই পরিমাণ অর্থ খরচ করার মতো মানুষ এই পৃথিবীতে অনেকেই আছেন।”
পর্যটক হিসেবে কোথাও বেড়াতে গেলে আমরা প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করি। নদী নালা পাহাড় পর্বত দেখি। সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাই। শহরের লোকজন বাড়িঘর স্থাপত্য সংস্কৃতি এসব দেখতে পারি। কিন্তু মহাকাশে দেখার কী আছে?
পৃথিবী থেকে আমরা এর দিগন্ত দেখতে পাই না। যে কারণে আগে মানুষ বিশ্বাস করতো যে পৃথিবীর পৃষ্ঠ ফ্ল্যাট বা সমান।
অমিতাভ ঘোষ বলেন, “পৃথিবীটা যে গোল সেটা আমরা ৫০ থেকে ৭০ মাইল উপরে গেলেই দেখতে পাবো। তার বৃত্তাকার রেখা তখন স্পষ্ট দেখা যায়।”
এছাড়াও পৃথিবী থেকে আমরা আকাশের রঙ দেখি নীল। কিন্তু আকাশ নীল নয়। পৃথিবীতে যে আলো এসে পড়ে তার সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের মিশ্রণে সেই নীল রঙ তৈরি হয়।
ছবির উৎস,SPACEX
“যেই মূহুর্তে আপনি বায়ুমণ্ডলের উপরে চলে যাবেন ঠিক তখনই দেখতে পাবেন যে আকাশ হচ্ছে কালো।”
এছাড়াও কেউ যদি চাঁদের বুকে হাঁটেন তিনি সেখানে পাহাড় ও ভূমি দেখতে পাবেন, যেখানে কোন ধরনের সবুজ নেই, পানি নেই এক ফোটাও- এর সবটাই তার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।
আর ওজনশূন্যতা অনুভব করতে পারা তো দারুণ এক ব্যাপার।
“সেখানে আপনি খুব সহজেই হাঁটতে পারবেন, লাফ দিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যেতে পারবেন, পারবেন ভেসে বেড়াতে। কোনো কিছুর সাথেই তো এসবের তুলনা হয় না,” বলেন নাসার বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ।
বিবিসি বাংলা