খাগড়াছড়িকে টাটা জানিয়ে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছে গাড়ি ব্রেক করল। একজন গিয়ে সবার নাম-ঠিকানা লিখিয়ে এল। নিরিবিলি পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি চলছে। যত এগিয়ে যাই, সামনের পাহাড় যেন ততই দূরে সরে যায়। যাচ্ছি আর থামছি। চারপাশের মায়াময় প্রকৃতি আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে।
কাচালং নদী পেরিয়ে মাচালং বাজারে খানিকটা বিরতি। কচি ডাবের পানি পান করি। বাজারে অপেক্ষায় থাকা কংলাক পাড়ার হেডম্যানকে সঙ্গে নিয়ে আবারও ছোটা শুরু। সাজেকে পৌঁছার ঠিক ৫ কিলোমিটার আগে প্রকৃতি আমাদের সৌন্দর্যের নাগপাশে বেঁধে ফেলে। আমরা গাড়ি ব্রেক না করে আর পারি না। একসময় মনে হলো, আকাশটাকে যেন ধরতে যাচ্ছি। তবে ধরার আগেই পৌঁছে যাই সাজেকের প্রথম পাড়া রুইলুইতে। প্রথম দেখাতেই চোখ কপালে। জনপ্রতি ২০ টাকা টিকিট কেটে ঢুকে পড়ি ভেতরে। কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক—এই দুয়ের মিশ্রণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাজেকে এনে দিয়েছে এক অন্য রকম ভালো লাগার অনুভূতি।
রাতে আমাদের থাকার ঠাঁই হয় সাজেক ক্লাব হাউসে। কাঁধের ঝোলা রেখে বের হই সাজেক দর্শনে। কখন খেতে আসব—জানতে চাইলে রসুইঘর থেকে খবর আসে, ঘুরতে থাকেন মনের সুখে! মুগ্ধ নয়নে সাজেকের রূপ দেখি এবং বিগত সময়ের স্মৃতি হাতড়ে ফিরি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৭০০ ফুট উচ্চতার সাজেক ভ্যালি এখন দেশের অন্যতম দর্শনীয় পর্যটনকেন্দ্র। খোলা চোখে হেলিপ্যাডে দাঁড়িয়ে দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত সাজেকের চারপাশের ঢেউখেলানো পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখা যায়। যে কেউ এই রূপে আচ্ছন্ন হবে। বসন্ত শেষে কচি পাতা গাছে গাছে। এ এক শিহরণ জাগানো ছবি। পাহাড়ের গায়ে পিচঢালা পথ গিয়ে শেষ হয়েছে বিজিবি ক্যাম্পে গিয়ে। দুর্গম সাজেক আজ যেন শৌখিন ভ্রমণপিয়াসীদের মেলায় পরিণত হয়েছে।
সাজেকের মোহনীয় রূপের ঘোরে ক্ষুধা যেন পালিয়ে ছিল কংলাক পাড়ার দিকে। বিকেল ৪টা পেরিয়েছে। ক্ষুধাকে পাকড়াও করার জন্য ছুটি কংলাকের পথে। জিপে মাত্র ১০ মিনিটের পথ। এরপর ১৫ মিনিটের চড়াই-উতরাই। শুধু সাজেক ভ্যালি নয়, পুরো রাঙামাটি জেলায় সবচেয়ে উঁচু পাহাড় সিপ্পু। এর উচ্চতা প্রায় ২ হাজার ৮০০ ফুট।
ছবি: দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ
কংক্রিটের আলিঙ্গনে নিজেকে জড়ায়নি বলে কংলাকের প্রকৃতি যেন আরও সুন্দর। পাহাড়ের চূড়া থেকে ঢেউখেলানো পাহাড়ের বুকে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি কমলাবাগান যে কাউকে পুলকিত করবে। এখানে রয়েছে প্রাচীন সেগুন ও বটবৃক্ষ। সাজেকের রুইলুই ও কংলাক পাড়ায় ৯৬ পরিবারের বসতি। তাদের বেশির ভাগ লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের। প্রতিটি বাড়ি সাজানো-গোছানো। বাড়ির আঙিনায় ফুটেছে রংবেরঙের ফুল। সাজেকের হেডম্যান লাল থ্যাঙ্গগা লুসাইর সঙ্গে কথা বলে অনেক কিছু জানা গেল। রুইলুই ও কংলাক—এ দুই পাড়ার বাসিন্দাদের অধিকাংশই ইংরেজিতে পারদর্শী। অত্যন্ত বিনয়ী এসব মানুষ এককথায় বন্ধুবৎসল। পুরো বিকেল কংলাক পাড়ার সিপ্পু পাহাড়ের চূড়ায় কাটিয়ে ঘোর সন্ধ্যায় ফিরি ক্লাব হাউসে।
শুরু হয় খানাপিনা। কয়েক ঘণ্টা ধরে অতি কষ্টে রান্না করা খাবার শেষ হতে লাগে মাত্র কয়েক মিনিট। রাতে হবে বারবিকিউ। রাত ৯টা বাজতেই শুরু হয় আয়োজন। সবাই আনন্দে প্রাণ খুলে নাচল বেশ। সূর্যোদয় দেখতে উঠতে হবে সেই ভোর সাড়ে ৪টায়। মনে হতেই ঘুম পেয়ে গেল।
ছবি: দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ
ভোর ৫টা। সাজেকের ভোরের আকাশ মায়াবিনী। আজ মেঘ-বৃষ্টি কিংবা কুয়াশা নেই। সম্ভবত কপাল ভালো বলে। আমরা তাকিয়ে রয়েছি পূর্ব দিগন্তে। সাড়ে ৫টার আগে আকাশে সূর্যের লালিমা দেখা গেল। কিন্তু মিজোরাম পাহাড় ডিঙিয়ে সূর্য মামা উঠতে পারছে না। আরও মিনিট বিশেক পর দেখা গেল সূর্যোদয়। ধীরলয়ে বিশাল মিজোরাম পাহাড়টা নিচে রেখে অনেকখানি আকাশে উঠে গেল সূর্য। সেই সূর্যোদয় বর্ণনা করার শব্দ আমার ভান্ডারে নেই।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা বাজার। সেখান থেকে চান্দের গাড়িতে সাজেক ভ্যালি।
কোথায় থাকবেন
কম টাকায় বিশাল বহর নিয়ে থাকতে চাইলে সাজেক ক্লাব হাউস, মেঘপুঞ্জিসহ বেশ কিছু কটেজ রয়েছে সেখানে। এ ছাড়া রয়েছে সেনাবাহিনী পরিচালিত সাজেক রিসোর্ট ও বিজিবি পরিচালিত রুন্ময় কটেজ। সব কটেজে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সেখানে কিছু ভালো রেস্টুরেন্টও রয়েছে।