শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩৩ অপরাহ্ন
Uncategorized

সাগরপথে ইউরোপে পাড়ি দেয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশিরা

  • আপডেট সময় রবিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২১

বাংলাদেশে কোন যুদ্ধ চলছে না। তেমন কোনো অস্থিরতাও নেই। তারপরও দেশের মানব পাচার বাড়ছে। জীবনের ঝুকি নিয়ে সাগরপথে ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছেন বাংলাদেশিরা। তাদের ভাগ্য ভালো হলে প্রাণ নিয়ে ইউরোপে পৌঁছাচ্ছে, নয়তো মৃত্যু। আবার ইউরোপে পৌঁছতে পারলেও মিলছে না আশ্রয়।

এমন অনিশ্চিত মরণযাত্রা জেনেও লিবিয়া থেকে ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালি অভিমুখে যাত্রা করছে বাংলাদেশিরা। উন্নত জীবনের স্বপ্নে তারা নিজেদের সঁপে দিচ্ছে আন্তর্দেশীয় মানব পাচারকারী চক্রের হাতে।

বিশ্বগণমাধ্যম, অভিবাসী সংস্থা ও মানবাধিকার এনজিওগুলোর তথ্য বলছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে পাড়ি দেয়ার ঘটনায় প্রথম দিকের দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এমনকি বাংলাদেশ থেকে অন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত বা রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশে চলে যাচ্ছেন অনেকে। এর পেছনে কারণ কী?

এই সমস্যা সমাধানে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ইউরোপে অবৈধ অভিবাসীদের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশ। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম প্রকাশ করেছে যে, ২০০৯ সাল থেকে ৬২ হাজার ৫৮৩ জন বাংলাদেশি ৯টি ভিন্ন রুট ব্যবহার করে অনিয়মিতভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছে এবং এই বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ৩ হাজার ৩৩২ জন বাংলাদেশি বিপজ্জনক সমুদ্রপথ দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে।

ব্র্যাক একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর উন্নয়নমূলক সংস্থা। অভিবাসন ও এর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে সংস্থাটি। ইউরোপিয়ান বর্ডার অ্যান্ড কোস্ট গার্ড, ফ্রন্টেক্সের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্র্যাক জানিয়েছে, অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি (৩৭ হাজার ১৯৪ জন) কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরীয় পথ ব্যবহার করেছেন। ১৭ হাজার ৬৩৯ জন পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় রুট ব্যবহার করেছেন এবং পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় রুট দিয়ে ২০০৯ থেকে মে ২০২১ এর মধ্যে প্রবেশ করেছে ৮৫৭ জন।

ব্র্যাকের মতে, যারা এই ধরনের সমুদ্র যাত্রায় নিজেদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলেন তাদের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশে চলতি বছরের শুরুর দিকে ভূমধ্যসাগর থেকে ১৬০ জনেরও বেশি বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়েছিল। তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তারা বাড়ি ফিরতে চায় কিনা, কিন্তু কেউ রাজি হয়নি।ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল থেকে উদ্ধার হওয়া কিছু বাংলাদেশি বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কাছে বলেন, ইউরোপে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখানোর মিথ্যা আশায় পাচারকারীরা তাদের প্রলুব্ধ করেছিল।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এই বছর ভূমধ্যসাগরে ৯৩৭ জন মৃত্যুর রেকর্ড করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বাংলাদেশের।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন অনুসারে, প্রতি বছর আনুমানিক সাত লাখ বাংলাদেশি যারা বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হতে পছন্দ করেন, তারা এই ঝুঁকির মুখোমুখি হন। বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পাচারের কাজকে ‘মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন’ এবং ‘জঘন্য অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

বাংলাদেশে কোন যুদ্ধ চলছে না। কিন্তু মানব পাচারের উচ্চ ঘটনা বা বাংলাদেশ থেকে অন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত বা রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশে চলে যাওয়ার কারণ কী? এর পেছনে তাদের কেমন খরচ হয়?

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি যুবক এই বিপজ্জনক ভ্রমণের জন্য ১০ লাখ থেকে ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করেছে। এত খরচ ও ঝুঁকি নেয়ার পেছনে কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যখন তারা দেখে যে তাদের আত্মীয় বা পরিচিতরা ইউরোপীয় দেশে চলে গেছে এবং উন্নত জীবন উপভোগ করছে তখন তারাও ঝুঁকি নিতে তৈরি হয়ে যান। তারাও সামাজিক উন্নতির আশায় জীবনের ঝুঁকি নেন।

ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইউরোপগামী একজন অভিবাসী গড়ে ১০ লাখ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকার মতো ব্যয় করেছেন। যেখানে মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসীদের এই খরচ হয় এক থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত।

ইউরোপে ভয়াবহ যাত্রার এমন দুটি রুট হলো বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান-তুরস্ক-গ্রিস এবং বাংলাদেশ-দুবাই-বাহরাইন-তুরস্ক-লিবিয়া-ইতালি। শরিফুল হাসান বলেন, গত দুই বছরে প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি ভিজিট ভিসায় দুবাই গেছেন। পরবর্তীকালে, তাদের অনেকেই অনিয়মিতভাবে ইউরোপে অভিবাসনের পথ বেছে নিয়েছেন।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) ডিসপ্লেসমেন্ট ট্র্যাকিং ম্যাট্রিক্স (ডিটিএম) অনুসারে, ২০২০ সালে ৪ হাজার ৫১০ অননুমোদিত বাংলাদেশি সমুদ্র এবং স্থলপথে ইউরোপে এসে ইতালি, মাল্টা, স্পেন বা গ্রীসে প্রবেশ করেছে। একই বছরে ৮ হাজার ৮৪৪ জন বাংলাদেশিকে ইউরোপগামী অভিবাসীদের পশ্চিমাঞ্চলীয় বলকান দেশগুলির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় শনাক্ত করা হয়েছিল।

জাতিসংঘের মতে, বিশ্বব্যাপী পাচারের শিকারদের অর্ধেক যৌন শোষণের জন্য পাচার হয় এবং অন্যদের 38% বাধ্যতামূলক শ্রমের কারণে। জাতিসংঘ খুঁজে পেয়েছে যে, নারীরা এখনও প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তুতে রয়েছেন, পাচারকৃতদের মধ্যে ৪৬% নারী এবং ১৯% মেয়ে।

ভূমধ্যসাগরে চোরাচালান রোধে ইতালি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিবিয়ার কোস্টগার্ডকে সহায়তা করার জন্য ইতালি সরকার লিবিয়ায় টহল নৌকা পাঠাতে সম্মত হয়েছে। অভিবাসীদের নৌকা পাঠানো থেকে বিরত রাখতে স্থানীয় মিলিশিয়াদের সাথে আলোচনায় অংশ নিয়েছে।

অভিবাসীদের উদ্ধারে নিয়োজিত এনজিওগুলি ইতালিতে একটি নতুন আচরণবিধি চালু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে হালকা সংকেত পাঠানো এবং অন্য জাহাজে অভিবাসীদের স্থানান্তর নিষিদ্ধ করা। এনজিওগুলি ২০১৭ সাল থেকে তাদের নৌকাগুলি তীরে আনা অভিবাসীদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি তুলে নিয়েছে।

বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মানব পাচারকারী বা তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করেছে। গন্তব্য দেশগুলো অনিয়মিত অভিবাসীর প্রবেশ কমাতে চায়, তাই বিদেশে নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ তার নীতি কঠোর করেছে।

যারা আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশে গিয়েছে তাদের অধিকার রক্ষায় আইন রয়েছে। ১৯৮২ সালে, সরকার অভিবাসী শ্রমিকদের প্রস্থান পর্যবেক্ষণ ও তদারকির জন্য একটি অভিবাসন অধ্যাদেশ জারি করে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি ২০০৬ সালে অনুসরণ করা হয়েছিল যাতে শ্রমিকদের মানসম্মত কর্মসংস্থান বেছে নেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা যায়।

২০১১ সালে, বাংলাদেশ অভিবাসন ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান আইন গ্রহণ করে, যা অভিবাসীদের অধিকার রক্ষা করে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এর মধ্যে রয়েছে সংকটের সময়ে অভিবাসীদের জরুরি প্রত্যাবাসন, প্রতারণা রোধ এবং রিক্রুটিং এজেন্সির জবাবদিহিতা বৃদ্ধি।

যাইহোক, এই প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষাগুলো বাস্তবের চেয়ে কম কার্যকর হয়েছে। কারণ নিয়োগ নেটওয়ার্কগুলো ক্রমশ জটিল হয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরণার্থী ও অভিবাসীদের চলাচলের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দশ হাজারের বেশি অনিবন্ধিত এবং বেনামী এজেন্ট কাজ করছে। এজেন্টরা সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের কাজের সুযোগ, কর্মী এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অবহিত করে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে, আন্তর্জাতিক স্বপ্ন বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা যেকোন সময় অনেক বাংলাদেশির মধ্যে হ্রাস পাবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম, বিশেষ করে যতক্ষণ পর্যন্ত চাকরিদাতাদের একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত না হবে। বেকার জনগোষ্ঠীকে আয়ের উপায় বের করে দিতে না পারলে এই যাত্রা বন্ধ করা বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে ইউরোপে পৌঁছতে পারলেও তাদের সেখানে স্থায়ী আশ্রয় মিলছে না। কারণ ইউরোপে আশ্রয় পাওয়ার যৌক্তিকতা তারা প্রমাণ করতে পারছে না। ফলে তাদের দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে। ইউরোপ থেকে ‘অনিয়মিত’ অভিবাসীদের ফেরাতে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) আছে। তার আওতায় অনিয়মিত অভিবাসীরা ফিরে আসছে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, অবৈধ অভিবাসনকে সরকার সমর্থন করে না। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিরা দেশকেই বিপদে ফেলছে এবং দেশের সুনাম নষ্ট করছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com