প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি শত শত পর্যটকের পদভারে মুখর থাকে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ খ্যাত এই দ্বীপ। এমন নীল আকাশ আর সাগরের স্বচ্ছ ঢেউ খেলা করে সেন্টমার্টিনের সৈকতে। তীরে বাঁধা নৌকা, নান্দনিক নারিকেল গাছের সারি- সব মিলে এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের হাতছানি প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। ব্যস্ত জীবনে একটু প্রশান্তি পেতে প্রতিদিন এখানে ভিড় জমায় ভ্রমণপিপাসু মানুষ। কিন্তু পর্যটকের তুলনায় দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, হোটেল-মোটেল, রেস্তোঁরা আর পরিবহনে বাড়তি ভাড়া নেয়ার। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে অনেকের। পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়সারা কথিত সিদ্ধান্তে আরো ফুঁসে উঠেছে দ্বীপবাসী। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নামেমাত্র সাইনবোর্ড ঝুলানো সতর্কতা দেখা গেলেও বাস্তবে তা উল্টো। বিশেষ করে সমুদ্র সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ বলা হলেও কার্যত কিছুই মানা হচ্ছে না।
অপরদিকে বিগত বছরের যে একমাত্র সড়ক তা এখনো আগের মত। এই সড়ক দিয়ে হাজার হাজার পর্যটকের যাতায়াতে কঠিন হয়ে যায়। এরকম অহরহ দুর্ঘটনাও হয়েছে। এছাড়া দ্বীপে গ্রামীণ এলাকায় পাকা সড়কের বেহাল অবস্থাও চলমান রয়েছে। আবার কয়েক বছর ধরে প্রভাবশালীরা অবাধে হোটেল ও রিসোর্ট তৈরি করছেন। অধিকাংশ ব্যবসাও বহিরাগত ব্যবসায়ীদের হাতে।
দেখা গেছে, দ্বীপের প্রায় বসতবাড়ি এখন রিসোর্ট করে ভাড়া দিচ্ছেন স্থানীয়রা। এখন বলাচলে স্বপ্নের দ্বীপ এখন কনক্রীটের সেন্টমার্টিন। দ্বীপের স্থানীয় মানুষ এসব ভাড়া দিয়ে টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বসবাস করছেন। তবুও সংকটে থাকে রুমের। প্রতিদিন পর্যটকের চাপে হাঁপিয়ে উঠছে সবাই।
এদিকে সেন্টমার্টিনে সৌর বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ৪২ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। স্থানীয়রা মনে করছেন, এরকম অতিরিক্ত টাকা আদায় একমাত্র দ্বীপেই আদায় করছে। বারবার সরকারের মন্ত্রী-সচিব ও এমপিরা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে নানান অভিযোগ শুনেন। পরবর্তীতে সৌর বিদ্যুতের দাম কমাতেও জেটি, সড়কের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করবেন বলে আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না।
সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি বলেন, সেন্টমার্টিনকে উন্নয়নের রুল মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি তার সহধর্মীনিসহ নানান পদক্ষেপ নিয়েছেন। দ্রুত দ্বীপের সড়ক-উপসড়কের কাজ, ভ্যানচালকদের অফিস, পর্যটকদের নিরাপত্তা এবং সবশেষ সেন্টমার্টিনকে পৌরসভা উন্নীত করতে বিভিন্ন দপ্তরে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
তবে সার্বিক বিবেচনায়, ট্যুরিস্ট পুলিশের দাবি, সব সময়ই পর্যটকদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তাবলয় থাকে সেন্টমার্টিনে।
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা, যা জোয়ারে তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। ভাটার সময় এই দ্বীপের আয়তন ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত হয়ে থাকে। দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তূপ আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়।
স্থানীয়ভাবে পেজালা (অ্যালগি) নামে পরিচিত একধরনের সামুদ্রিক শৈবাল সেন্টমার্টিনে প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে, তবে লাল পেজালা বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয়।
এ ছাড়াও রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে সপঞ্জ, শিলকাঁকড়া, সন্ন্যাসী শিলকাঁকড়া ও লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল কোরাল, রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ ও উড়ক্কু মাছ ইত্যাদি। এসবের কারণে অনেক পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করেন। বিশেষ করে শীত মৌসুমে পর্যটকের উপস্থিত বাড়ে সেন্টমার্টিনে।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দ্বীপের মানুষ এখন নিজ বাড়িকে রিসোর্ট তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছেন। এভাবে হলে তো পুরো দ্বীপ বিল্ডিং হয়ে যাবে। দ্রুত ক্ষতির সম্মুখীন স্থানীয় মানুষ। এ বছর প্রায় ১৮০ থেকে ২০০ বাড়িঘর রিসোর্ট করেছে। এসব রিসোর্টে ছোট ছোট রুম করে ভাড়া দিচ্ছেন।
তবে দ্বীপবাসীর অভিযোগ, সেন্টমার্টিনের স্থানীয়রা কোন দালান-হোটেল মোটেল করতে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন দপ্তরের অনুমতি লাগে। তারপর মালামাল আনতে ক্রয়কৃত জিনিসের ৪/৫ গুন টাকা দিতে হয় সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু বহিরাগত প্রভাবশালীরা বড় বড় হোটেল-রিসোর্ট করতে কোন অনুমতি লাগে না। তারাই মূলত দ্বীপকে কনক্রিটের দ্বীপ বানাচ্ছে।
কেয়ারি ট্যুরস অ্যান্ড লিমিটেড-এর কক্সবাজারস্থ ইনচার্জ নুর মোহাম্মদ ছিদ্দিকী বলেন, শীত মৌসুম এলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সেন্টমার্টিনে ঢল নামে এবং প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বাড়ছেই। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার ও শনিবারে পর্যটকের সংখ্যা বেশি থাকে। অনেকেই জাহাজের টিকেটও পায় না। সরকারি বন্ধের দিনে প্রায় তিন থেকে চার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে ভ্রমণে যায়। প্রতি বছর দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন দ্বীপে বেড়াতে আসে। তারা সেন্টমার্টিনের প্রাকৃতিক পরিবেশ উপলব্ধি করে। কোনো কোনো পর্যটক ধারণা করেন, সেন্টমার্টিন বিশ্বের সেরা দ্বীপগুলোর মধ্যেই অন্যতম। কিন্তু সেই তুলনায় দৃশ্যমান পর্যটকবান্ধব কোন উন্নয়ন হয়নি।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, দ্বীপের মানুষ সবসময় পর্যটকবান্ধব। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও দেশি-বিদেশি পর্যটকরা নিরাপদে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ করতে পারছেন। প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমে ৭-৮টি জাহাজযোগে প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৫ হাজারের বেশি পর্যটক এ দ্বীপ ভ্রমণে আসেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপে দূর দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকরা তাদের ইচ্ছেমতো ঘুরে আনন্দের মধ্যেই নিরাপদে বাড়ি ফিরছেন। এমন কি তাদের এখানে থাকাকালে কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। তবে দ্বীপবাসীর মানোন্নয়নে এখনো কোন উন্নয়ন হয়নি। বিশেষ করে বর্তমানে কুকুরের উপদ্রব, বেহাল জেটির বেহাল অবস্থা রয়ে গেছে।
এদিকে পর্যটকদের যাতায়াত সীমিত করার পাশাপাশি প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে নিয়ন্ত্রিত পর্যটক চাই বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন কক্সবাজারের ‘ইনভায়রনমেন্ট পিপলস’ নামে পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ। বলেন, অতিরিক্ত পর্যটক দ্বীপের ভারসাম্যের জন্য হুমকি এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে বলে পরিবেশ সমীক্ষায় উঠে আসে। আমরা চাই সীমিত পর্যটক আসা-যাওয়া। তারপর দ্বীপের পরিবেশ অন্তত কিছুটা রক্ষা পাবে।
ইয়ুথ অ্যানভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, সরকার দ্বীপে পর্যটকের যাতায়াত সীমিত করা চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন যাতায়াতের জন্য জেলা প্রশাসন সাতটি জাহাজের অনুমোদন কীভাবে দেয়?
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা হোটেল সী-প্রবালের পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, দ্বীপে মৌসুম এলে পর্যটক আসে। কিন্তু কোন উন্নয়ন হয় না। এভাবে হেলেদুলে চলছে দ্বীপের জীবনমাত্রা।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পারভেজ চৌধুরী বলেন, দ্বীপকে রক্ষা ও সামগ্রিক উন্নয়ন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার ও দায়িত্বরত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত বসে দ্বীপের ক্ষতি হয়, এমন কাজ থেকে দূরে থাকতে মনিটরিং করা হচ্ছে। সেন্টমার্টিনের পরিবেশ রক্ষা ও পর্যটন সীমিতকরণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদনও পাঠানো হয়েছে।
বিশ্বাস ফজলুল হক
সম্পাদক
চলো যাই
অনলাইন ট্রাভেল ম্যাগাজিন