গত পনেরো দিন ধরে সারা বাংলাদেশ জুড়ে ছাত্র-আন্দোলন চলছে। সে-আন্দোলন প্রতিরোধ করতে আওয়ামী সরকার সেনাবাহিনী নামিয়ে ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ফেলেছে। গণমাধ্যমের হিসেবেই মৃতের সংখ্যা দুই শয়ের বেশি। সত্যি সংখ্যাটি জানতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। দূর থেকে যেটুকু জেনেছি ক্ষোভে দুঃখে ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। বার বার মনে হয়েছে যে রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই দলটি, সেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা এতোটা নির্দয়, এতোটা অবিবেচক, এতোটা ভয়ঙ্কর কীভাবে হন? সেই কষ্ট থেকে আমার আজকের লেখা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারসহ নিহত হন। এই মর্মান্তিক ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিহত হন স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রগণ্য অন্য কাণ্ডারীগণও। বাংলাদেশের জন্য সেটি ছিল অচিন্তিতপূর্ব ঘটনা।
সেনাশাসনের অন্তিম সময়ে ১৯৯০ সালে সারাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিল ছাত্র-জনতার তীব্র এক আন্দোলন। বিশ্ববেহায়া এরশাদকে হটাতে সারা জাতি মেতে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা হলো। সবাই নিশ্চিত ছিল আওয়ামী লীগ জিতবে। কিন্তু জিতলো বিএনপি৷
সেই পরাজয় থেকে আওয়ামী লীগ শিখলো না যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই যথেষ্ট নয়।
১৯৯৬ সালে জিতলো আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী মানুষেরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলো দলটির উলঙ্গ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং পেশীশক্তির রাজত্ব। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতা শততম ধর্ষণ উদযাপন করলো। সেই কাজ দলটির কোনো নেতা কর্মীকে লজ্জিত করেছিল কি না জানি না। কিন্তু মাথা নত হয়েছিল পুরো জাতির।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগ হারলো৷ বিএনপি-জামাতের সন্ত্রাস হয়ে উঠেছিল মানুষের দৈনন্দিন ব্যাপার। সেই অনাচার থেকে মুক্তি পেতে দেশের মানুষের চলে গেল আট বছর। শেখ হাসিনা আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। মনে হলো ধীরে চলা নীতিতে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলছেন তিনি। মনে হচ্ছিল সুশিক্ষা নিয়েই মাঠে নেমেছেন। কিন্তু সেই মনোভাব ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। ইতিহাসের শিক্ষা থেকে সরে গেলেন।
২০১৩ সালে শুরু হলো গণজাগরণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জারিত লক্ষ লক্ষ মানুষের এমন ইতিবাচক অবস্থান দেশের মানুষ আগে দেখেনি। কিন্তু শেখ হাসিনার কাছে তা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। গণজাগরণকে জিরো বানাতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন তিনি। মানুষ বুঝতে পারলো তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের নিজের দল ছাড়া অন্য কাউকেও প্রশ্রয় দিতে নারাজ। গণজাগরণকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন তিনি।
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ আবার জিতলো। কিন্তু শেখ হাসিনা ও তাঁর দল শিখলো না যে শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই যথেষ্ট নয়, সাথে থাকতে হবে সততা। আর তখনই মানুষ তাদের সাথে থাকে। তারা মানুষকে পাশে পেতে সততার সাধনায় নিয়োজিত হলেন না। বরং তাবেদারকে পুরস্কার দেওয়া, সমালোচককে তিরস্কার করার নেশায় মেতে উঠলো দলটির নেতৃবৃন্দ। অসীম দুর্নীতির খেলায় মেতে উঠলো দলটির সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী। ২০১৯ এর নির্বাচন হলো। শুরু হলো বিরোধী দলছাড়া নির্বাচনের খেলা। আওয়ামী লীগ এই খেলায় নিজেকে ক্রমে ক্রমে দক্ষ করে তুলতে লাগলো। হাজার হাজার কোটি টাকা নয়ছয় হয়ে চললো প্রতিদিন। মানুষের আস্থা অর্জনের দিকে তখন তাদের সামান্য মনোযোগ নেই।
গত জানুয়ারিতে পঞ্চম বারের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। একটানা চারবার। সারা পৃথিবীতে অভাবিতপূর্ব উদাহরণ তিনি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন দল নির্বাচন করেছে কেউ জানে না। তার দলের এমপিরা কে কয়টা ভোট পেয়েছিল কেউ জানে না৷ সারা দেশে প্রতিবাদের কোনো মানুষ ছিল না। দেশের বাইরে কোনো দেশ, সংস্থা আঙুল তুললো না। এভাবে প্রধানমন্ত্রী হতে পারলে কার মনে হবে না যে তার চাওয়াই চূড়ান্ত? কার মনে ইগো গিজগিজ করবে না? চারপাশের তাবেদারদের উপস্থিতি শাসককে স্বৈরাচারে রূপ দিল।
গত কয়েকবছর ধরে দেশে যে দুর্নীতি চলছে তার দায় কি তিনি এড়াতে পারেন? ভাবলে আমার বিস্ময় লাগে যে, একজন প্রধানমন্ত্রী বলছেন তাঁর পিয়ন চার শ কোটি টাকার মালিক; হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। আচ্ছা তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই কথা নিজ মুখে বলতে তাঁর লজ্জা করলো না? তিনি তো দুর্নীতি ঠেকাতে ব্যর্থতার কারণে পদত্যাগ করে কথাটা বলতে পারতেন?
বঙ্গবন্ধু ও চারনেতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কুড়ি বছর পর যে সরকার তিনি গঠন করেছিলেন তা তিনি ধরে রাখতে পারেননি শুধু দুর্নীতিবাজদের কারণে৷ কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে যেমনটি হয়! এবারেও তাঁর সরকার দুর্নীতির শাপে জর্জরিত। স্বজনপ্রীতি এখন দেশের প্রধান চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনি ও তার দলের তাবেদার৷
গত জানুয়ারির লোকদেখানো নির্বাচনের পর তিনি এবং তাঁর পরিষদেরা ভাবতে শুরু করেছিলেন তিনারা যা করবেন সেটাই চূড়ান্ত। সেটি যে ভুল ছিল সেটা তারা বুঝতে পারেননি। আর তাই প্রতিবাদের আওয়াজ শুনেই বন্দুকের নল তাক করতে দেরি করেনি সামান্যটুকুও। কিন্তু মাথায় রাখেননি গত দেড় দশক ধরে কতোটা ক্ষোভ জমে আছে কোটি কোটি বাংলাদেশির মনে।
আর এভাবেই পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্ট শাসক হিসেবে নিজেদের নাম লিখিয়ে ফেললেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটি। এবার তাদের বিদায় নেবার সময়। রাষ্ট্র কে চালাবেন, সেই দায়িত্ব রাষ্ট্রের মূল মালিক সেই জনগণের উপর ছেড়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের নয় কী?