শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৮:৩৬ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

সমুদ্র অর্থনীতি বদলে দিতে পারে বাংলাদেশকে

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

করোনা দেশের অর্থনীতিতে যে ক্ষত সৃষ্টি করে যাচ্ছে, তা থেকে উত্তরণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সমুদ্র অর্থনীতি। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, শুধু সমুদ্র অর্থনীতিকে যদি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কক্সবাজার হবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সমুদ্র সৈকত এবং পর্যটন কেন্দ্র। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময়। রবিবার (২৯ আগস্ট) গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজ উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদনির্ভর। আর অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে থাকে।

এদিকে বাংলাদেশের সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’র তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্র থেকে মাছ ধরে শুধু বিদেশে রফতানি করেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। এ ছাড়া নতুন ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুধু সমুদ্র অর্থনীতিকে যদি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশে অর্থনীতিতে এক ধরনের বিপ্লব ঘটে যেতে পারে।’ তার মতে, শুধু সামদ্রিক মাছ ও শৈবাল রফতানি করে বাংলাদেশ বছরে এক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ আয় করতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, ‘সুনীল অর্থনীতি হলো— অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নততর জীবিকা সংস্থান এবং কাজের লক্ষ্যে সামুদ্রিক প্রতিবেশের উন্নয়ন। বিভিন্ন তথ্যমতে, বিশ্বের ৪৩০ কোটিরও বেশি মানুষকে ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে।

বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে— সামুদ্রিক অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে, এসডিজি-১৪ লক্ষ্যটি টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। সামুদ্রিকসম্পদ খাদ্য এবং জ্বালানি সরবরাহ করে থাকে, যা মানবজীবনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ৭১০ কি.মি. সুদীর্ঘ উপকূলরেখা রয়েছে। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের শতকরা ১৯.৪ ভাগই আসে সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন থেকে। এছাড়া, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পর্যটকদের গড়ে শতকরা ৮১ ভাগ কক্সবাজার ভ্রমণ করে থাকেন। বাংলাদেশের সমুদ্রজুড়ে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূল এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখ করেছে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একটি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল চিহ্নিত হয়েছে। ইতোমধ্যে, বাংলাদেশ নতুন সামুদ্রিকসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে সুনীল অর্থনীতির উন্নতি সাধন করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার সমুদ্র অর্থনীতির ওপরে  কিছু সংখ্যক পরামর্শ এবং কর্মশালা গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি-১৪ সম্পর্কিত অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশ মহাসাগর, সমুদ্র এবং সামুদ্রিকসম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এছাড়া একটি সমৃদ্ধশালী এবং টেকসই সুনীল অর্থনীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ১২টি কার্যকলাপ উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে অন্যান্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মৎস্য চাষ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, মানবসম্পদ, ট্রান্সশিপমেন্ট, পর্যটন এবং জলবায়ু পরিবর্তন। এছাড়া, ২০১৭ সালে সুনীল অর্থনীতি সম্পর্কিত উদ্যোগগুলোর সঙ্গে বিভাগীয় মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় সাধনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্লু ইকোনমিক সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপকভাবে অবদান রাখার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সুনীল অর্থনীতির ২৬টি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে মৎস্য চাষ, সামুদ্রিক বাণিজ্য এবং শিপিং, জ্বালানি, পর্যটন, উপকূলীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা, উপকূলীয় নিরাপত্তা এবং সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য নজরদারি অন্তর্ভুক্ত।

নৌ পরিবহন: বাংলাদেশের বৈদেশিক মালবাহী বাণিজ্যের বেশিরভাগই সমুদ্রপথে সম্পন্ন হয় (২০১৮), যা দেশের মোট বহির্বাণিজ্যের শতকরা ৯০ ভাগ। সেজন্য, ভবিষ্যতে আমাদের অর্থনীতি বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপরে প্রচণ্ডভাবে নির্ভর করবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ধারণা করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিপুল পরিমাণ মালামাল-শুল্ক দেশের অভ্যন্তরে রাখার উদ্দেশ্যে স্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলোকে প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে, যাতে করে তারা বিদ্যমান জাহাজের বহরের সঙ্গে আরও জাহাজ সংযুক্ত করতে পারে। এছাড়া, সমুদ্র উপকূলীয়  জাহাজ চলাচল, সমুদ্রবন্দরগুলো, যাত্রীবাহী খেয়া পারাপার সেবা, অভ্যন্তরীণ জলপথ পরিবহন, জাহাজ প্রস্তুতকরণ এবং জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পগুলো আমাদের দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আরও গুরুত্ব বহন করতে পারে।

মৎস্য সম্পদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের মতে শামুক, শেলফিশ, কাঁকড়া, হাঙ্গর, অক্টোপাস এবং অন্যান্য প্রাণী ছাড়াও শুধুমাত্র মাছেরই ৫০০ প্রজাতি বিদ্যমান। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগরে সহজলভ্য মোট ৮ মিলিয়ন টন মাছের মধ্যে আহরণ করা হয় মাত্র ০.৭০ মিলিয়ন টন মাছ। উল্লেখ করা যায় যে, পৃথিবীর সকল মানুষের আমিষের চাহিদার শতকরা ১৫ ভাগ আসে সামুদ্রিকসম্পদ থেকে। এছাড়া অসংখ্য মানুষ তাদের জীবিকা এবং খাদ্যের চাহিদার জন্য যেহেতু সামুদ্রিকসম্পদের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু সামুদ্রিকসম্পদ রক্ষার্থে আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

তেল এবং গ্যাস: বাংলাদেশের উপকূলীয় গ্যাস সম্ভাবনার প্রকৃত পরিমাণ এখনও জানা সম্ভব হয়নি। দেশের সমুদ্রের অভ্যন্তরেও গ্যাস মজুত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের স্থল সীমানায় কিছু গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে এবং মায়ানমারের মতো বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় আরও গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশের গ্যাসের মোট মজুতের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়া, তেল এবং গ্যাস, লবণ, নবায়নযোগ্য সামুদ্রিকসম্পদ (অসমোসিস) এবং বায়োমাস, বিবিধ খনন (বালু, নুড়ি ইত্যাদি) এবং সমুদ্রজাত সম্পদগুলো অন্যান্য সামুদ্রিকসম্পদের মতো আরও  গুরুত্ব পাওয়া প্রয়োজন। ফলে, এ সকল সম্ভাবনাময় খাত আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

পর্যটন খাত: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী উপকূলীয় পর্যটন, পর্যটন বাজারের বৃহত্তম অংশ এবং বিশ্বের জিডিপির শতকরা ৫ ভাগ এবং মোট কর্মসংস্থানের শতকরা ৬-৭ ভাগ। ১৫০টি দেশে এটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রথম পাঁচটি খাতের মধ্যে একটি। স্বল্পোন্নত দেশসগুলোর অর্ধাংশের ক্ষেত্রে এটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান খাত। উপকূলীয় ট্যুরিজমের মধ্যে রয়েছে (ক) সৈকতভিত্তিক বিনোদন এবং পর্যটন, (খ) সমুদ্রের কাছে পর্যটন কার্যক্রম এবং (গ) ইয়টিং এবং মেরিনাসহ নটিকাল বোটিং। টেকসই পর্যটন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস করতে পারে। অতএব, বাংলাদেশ পর্যটন খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারে, যা জিডিপি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

তথ্যমতে, এদেশের ৭৫টি বহিঃদ্বীপ রয়েছে, যা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় পর্যটন খাতে ব্যবহার করা সম্ভব। যথাযথ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এসব সম্পদ গবেষণা এবং ব্যবহার সম্ভব হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব।

ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমায় সুনির্দিষ্ট এলাকা লাভে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান এবং সামুদ্রিকসম্পদের সুরক্ষার মধ্যে টেকসই ভারসাম্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে সামুদ্রিক সম্পদসহ বিশাল সমুদ্র অঞ্চলকে কাজে লাগাতে সুনীল অর্থনীতির বিকাশে নজর দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখ করেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ সামুদ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকল্পে আরও ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ জলজ মৎস্য পালন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা, লবণ উৎপাদন এবং বন্দর সুবিধাসহ মাত্র কিছু সংখ্যক সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্র উম্মোচন করতে পেরেছে। তাছাড়া এ সব খাতের অধিকাংশই গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসরণ করছে। সুতরাং এখনও বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতির বিপুল সংখ্যক খাত উম্মোচন, উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন রক্ষা, পরিবেশগত পরিবর্তন মোকাবিলা, কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে আবদান রাখতে আরও  উদ্ভাবনী প্রযুক্তি প্রবর্তনের সুযোগ এবং প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com