শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৮:৩৬ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

সমুদ্রের বুকে ডুবতে থাকা অপরূপ দেশ টুভালু

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১

টুভালু ; চারদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের জলরাশির উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে এক নৈসর্গিক দ্বীপদেশ। ৯টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দেশটি ওশেনিয়ার অস্ট্রেলিয়া ও হাওয়াই এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। যার ৮টি দ্বীপেই মানুষের বসতি আছে। দেশটির মাতৃভাষায় টুভালু’র অর্থ হচ্ছে ‘আট জাতির একত্রে বসবাস’।

২৬ বর্গ কিলোমিটারের এই দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। আয়তনে বিশ্বের চতুর্থ ছোট দেশ এটি। এমন একটি দেশ টুভালু, যার মধ্য দিয়ে হাঁঠলে দু’পাশেই সমুদ্র দেখা যায়। তবে চমৎকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ এ দেশটি রয়েছে এক চরম ঝুঁকিতে। জলবায়ুর বিরুপ পরিবর্তনের ফলে একদিন বিলীন হয়ে যেতে পারে টুভালু।

বৃটিশ কলোনির শাসনে থাকা এলিস আইল্যান্ড নামধারী এই দ্বীপ অঞ্চলটি টুভালু রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৭৮ সালের ১ অক্টোবর। টুভালুয়ানরা প্রাচীন শতাব্দীতে ছিলো পোশাক প্রস্তুতকারী। জাতিগতভাবে এই দেশের বাসিন্দারা পলিনেশিয়ান। টুভালুতে বসতি শুরু হয়েছিলো প্রায় ৩ হাজার বছর আগে। দেশটির প্রাচীন গুহাগুলোতে যেসব প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়, তা থেকে বোঝা যায় কয়েক হাজার বছর আগেও মানববসতি ছিলো এখানে।

স্প্যানিশ নাবিক আলভারো ডি মেন্দানা ১৫৬৮ সালে সর্বপ্রথম এ দ্বীপটির সন্ধান পান। তবে চারদিকে প্রবালের প্রাচীর থাকায় এখানে নোঙর করতে পারেননি তিনি। ১৮৬২ থেকে ১৮৬৪ সালের মধ্যে পেরুভিয়ান দাসদের একটি দল টুভালু দ্বীপে অবস্থান নেয়। যারা এখানে বসবাস শুরু করে। পরে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে টুভালু ব্রিটেনের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী সামরিক ঘাঁটি হিসেবে এই দ্বীপদেশকে ব্যবহার করে। ১৯৭৪ সালে এখানে জাতিগত সহিংসতা দেখা দিলে ‘কিরিবাতি’ ও ‘টুভালু’ দু’টি আলাদা দেশ গঠিত হয়।

টুভালু’র রাজধানীর নাম ফুনাফুটি। এখানে মুদ্রা হিসেবে টুভালুয়ান ডলার ও অস্ট্রেলিয়ান ডলার ব্যবহৃত হয়। দেশটিতে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। সংসদীয় গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে সরকার ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান বৃটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তিনি কখনো টুভালুতে যান না। একজন গভর্নর জেনারেল তার প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে অবস্থান করেন। পার্লামেন্টের সদস্যদের মধ্যে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

দেশটির আটটি দ্বীপেই আদালত আছে। এমনকি আছে হাইকোর্টও। এখানে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ছাড়া আর কোনো সশস্ত্র বাহিনী নেই। সমুদ্র উপকূল পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে এক বাহিনী, যা পুলিশ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও উপকূলে উদ্ধারকাজ করাই তাদের দায়িত্ব। ৬টি প্রবালপ্রাচীর ও ৩টি প্রবাল দ্বীপবেষ্টিত এই দেশের সব দ্বীপে রয়েছেন একজন করে প্রধান ব্যক্তি, যার আওতায় পরিচালিত হয় প্রতিটি দ্বীপ। টুভালুতে শুধুমাত্র তাইওয়ান ছাড়া আর কোনো বিদেশি দূতাবাস নেই। দেশটি জাতিসংঘের সদস্য ছাড়াও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকেরও সদস্যরাষ্ট্র।

এখানে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। আয়ের প্রধান উৎস বৈদেশিক সাহায্য। সরকারি চাকরিজীবীরাই একমাত্র নিয়মিত বেতনভুক্ত। কৃষি ফার্ম এবং মাছ ধরা এখানকার প্রাথমিক স্তরের অর্থনৈতিক কাজ। বংশানুক্রমে একেক পেশায় নিয়োজিত থেকে নিজেদের সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রাখছে টুভালুয়ানরা। কেউ মাছ ধরা, কেউ নির্মাণ কাজে, কেউবা হস্তশিল্প তৈরীর কাজ করেন। এখানকার জনগণের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬০০ ডলার। প্রতিটি দ্বীপে সরকারি দোকান রয়েছে। দোকানগুলোতে সস্তায় সব জিনিস পাওয়া যায়। ঝড়-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দ্বীপগুলোতে রয়েছে শেল্টার সেন্টারও। এ দেশে পর্যটনের তেমন সুব্যবস্থা না থাকলেও এর প্রাকৃতিক উপভোগ্য সৌন্দর্য দেখতে কিছুটা হলেও পর্যটক যান টুভালুতে। বিমানবন্দর আছে, তবে প্রতি দুই দিন পর পর একটি বিমানই চলাচল করে। বিমানে যাতায়াত করেন মূলত বৈদেশিক এনজিও কর্মীরা।

টুভালুর জাতীয় ভাষা হলো টুভালুয়ান। আর দ্বিতীয় ভাষা হলো ইংরেজী। ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে টুভালু’র সরকার বেশ উদার। দেশটির প্রায় বেশিরভাগ নাগরিক খ্রিস্টান ধর্মালম্বী হলেও ধর্মীয় অনুশাসনের কোনো বাড়াবাড়ি নেই এখানে। যে কেউ চাইলে ধর্ম পরিবর্তন করতে পারে, কিংবা যে কোনো ধর্মে বিশ্বাস রাখতে পারে। বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষা চর্চায় না অংশগ্রহণ করার অধিকার রয়েছে সকলের। দেশটির জনসংখ্যার ০.৪ শতাংশ মুসলমান। শিক্ষার প্রতিও টুভালু সরকার বেশ উদার। তাই বিনা পয়সায় চলে শিক্ষা কার্যক্রম। এছাড়া ৬-১৫ বছর বয়স পর্যন্ত সকলের স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক। আর তাই প্রাথমিক শিক্ষিত লোকের সংখ্যাও ১০০ শতাংশ।

টুভালুয়ানদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি বেশ বৈচিত্র্যময়। এখানে বেশিরভাগ বাড়ি কাঠের তৈরি। টুভালুর নারীদের সুনাম রয়েছে নিপুণ হস্তশিল্পের জন্য। শামুক-ঝিনুকের খোলস দিয়ে বাহারি মালা ও ঘর সাজানোর জিনিস তৈরির পাশাপাশি কার্পেট, পাপোস, ক্রোচেট তৈরি করেন স্থানীয় নারীরা। টুভালুয়ানদের নিত্যদিনের জীবনযাপনে তাদের সংস্কৃতির পরিচয় খুব সহজেই ফুটে ওঠে। নৌকা, মাছ ধরার হুকেও তারা তাদের ঐতিহ্যগত নকশা ব্যবহার করে। নারীদের পোশাক ও অলঙ্কারে পাওয়া যায় জাতিগত ঐতিহ্যের ছাপ। বিভিন্ন উৎসবে টুভালুবাসীদের নাচ-গানের সুর দু’পাশের সমুদ্রকে আরো রাঙিয়ে তোলে।

টুভালুয়ানদের খাদ্যাভাসের মধ্যে নারিকেল খুবই জনপ্রিয়। পশুর দুধের চেয়ে নারিকেল দুধ এখানে বেশি খাওয়া হয়। এছাড়া সমুদ্রবেষ্টিত দেশ হওয়াতে সামুদ্রিক মাছ তো আছেই সঙ্গে ব্রেডফ্রুট, কলা, পুলাকা, কচুশাক, শুয়োর, সামুদ্রিক পাখি খায় এখানকার মানুষেরা। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্করাও খেলাধুলা ভালোবাসেন। ঐতিহ্যবাহী এক খেলা ‘কিলিকিটি’ অনেকটা ক্রিকেটের মতই খেলেন এখানকার বাসিন্দারা। আর স্থানীয় ভাষায় ‘আনো’ যা ভলিবলের মত নিয়মেই খেলতে হয়। এছাড়া ফুটবল, রাগবি, টেনিস, ব্যাডমিন্টনসহ অনেক খেলাই এখানে জনপ্রিয়।

টুভালুর ৯টির মধ্যে চারটি দ্বীপ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কিছুটা উঁচুতে, আর বাকি পাঁচটি দ্বীপ প্রবালবেষ্টিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ দেশের সর্বোচ্চ স্থানের উচ্চতা মাত্র ১৫ ফুট। মালদ্বীপের পর টুভালুর উচ্চতাই সবচেয়ে কম। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ার ফলে দেশটি হুমকির সম্মুখীন। আন্তর্জাতিক জলবায়ু সংস্থাগুলোর রিপোর্টের তথ্যমতে, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। ফলে সারা বিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১.১ মিটার বাড়বে। ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত টুভালুবেষ্টিত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৫.১ মিলিমিটার করে বেড়েছে। যা একইসময়ে সারা পৃথিবীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের যে উচ্চতা বেড়েছে তার চেয়ে ৩ গুণ বেশি। এরইমধ্যে উপকূলীয় ভাঙনে টুভালুর কিছু অংশ সমুদ্রে ডুবে গেছে। লবণাক্ত পানির কারণে শস্য উৎপাদন ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে এখানে।

সমুদ্রের বুকে বিলীন হওয়ার হুমকির মুখে থাকা এই দ্বীপদেশটি থেকে ইতিমধ্যে অনেকেই অন্য দেশে চলে গেছেন।  যদি এরকমটাই চলতে থাকে, তাহলে অসাধারণ সৌন্দর্য্যেঘেরা টুভালু একসময় ইতিহাসে পরিণত হবে। মানুষের মুখে মুখে রয়ে যাবে….একটা সময় টুভালু ছিলো।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com