অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দেশ মালদ্বীপ পর্যটনের জন্য সারা বিশ্বে সুপরিচিত। সুন্দর দ্বীপ, মনোমুগ্ধকর সৈকত ও পাঁচতারকা রিসোর্ট থাকায় দেশটি বিলাসবহুলভাবে ছুটি কাটানোর জন্য আদর্শ। সাদা বালির সৈকত, স্বচ্ছ পানি ও নীল আকাশের জন্যও মালদ্বীপের খ্যাতি আছে। সারা বিশ্বে ‘সমুদ্রস্বর্গ’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের।
এশিয়ার সবচেয়ে ছোট ও পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু দেশ মালদ্বীপ। প্রায় শতভাগ মুসলিমের দেশ মালদ্বীপে গত ১৯ মার্চ পবিত্র রমজানের দিনে ভ্রমণে গিয়েছি। সাড়ে তিন ঘণ্টার বিমানপথ পাড়ি দিয়ে মালদ্বীপের লাগোয়া দ্বীপ হুলু মালেতে ‘ভেলানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে’ গিয়ে নামলাম। সাগর ছুঁয়েই রানওয়ে।
বিমানের জানালা দিয়ে যখন সাগরের নীল জলরাশি ও ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপ দেখা যাচ্ছিল, তখন মনে মনে ভাবতে লাগলাম, ‘বিমান নামবে কোথায়’? তারপর সাগরের পানি ছুঁইছুঁই অবস্থায় মালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করল। ইমিগ্রেশন লাইন বড়, কিন্তু ছাড়া পেতে সময় লাগল খুবই কম।
অনলাইনে পাওয়া সেই স্লিপ দেখাতেই সিল পড়লো পাসপোর্টে। বিমানবন্দর থেকে বের হতে যাওয়ার সময় প্রধান ফটকে আমাদের বুকিং করা হোটেলের নাম সংবলিত প্লেকার্ড হাতে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার দাঁড়ানো দেখে আমরা বুঝতে পারলাম তিনি আমাদের রিসিভ করতে এসেছেন।
হুলু মালে দ্বীপের থ্রি ইন হোটেলে আমাদের বুকিং করা রুমে গিয়ে লাগেজ রেখে বিকালবেলা সমুদ্রপাড়ে ঘুরতে গেলাম। সমুদ্র তীরে বিভিন্ন ধর্মের-বর্ণের মানুষের নির্বিশেষে যে যার কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। সন্ধ্যায় সৈকতের তীরে বসে মুসলিমরা ইফতারি করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ঢেউয়ের গর্জন ও বাতাস গায়ে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে ইফতার করার জন্য আমরাও একটি বাঙালি রেস্টুরেন্ট থেকে ইফতার এনে সমুদ্রপাড়ে একটি টি-টেবিলে বসে পড়লাম। সৈকতের তীরে জায়গায় জায়গায় রাখা চেয়ার, বেঞ্চ, দোলনা পাতা। ওপরে ছাউনি দেওয়া। এগুলো পর্যটকদের ব্যবহারের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কোনো ভাড়া দিতে হয় না।
সন্ধ্যায় সমুদ্র তীরে বসে মুসলিমরা ইফতারি করছেন, পাশেই জলকেলিতে ব্যস্ত স্বল্পবসনার নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীরা। কারও সঙ্গে কারও কোনো বিবাদ কিংবা অহেতুক ধর্মীয় উপদেশ দানের উত্তেজনা, মাতম দেখিনি। বিপরীতমুখী চরিত্রের এই সম্প্রীতির সম্পর্কের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি।
ইফতার শেষে হোটেলে পৌঁছে বিশ্রাম করতে লাগলাম। হোটেলের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পুরো সমুদ্র দেখা যায়। রাতে সমুদ্রের নীলজলের ঢেউ তীরে আচড়ে পড়ছে। ঢেউয়ের গর্জন ও দমকা বাতাসে অন্যরকম একটি অনুভূতি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানেক সেই দৃশ্য উপভোগ করলাম।
রাত ২টা বাজতেই আমরা সেহরি খাওয়ার জন্য বের হলাম। হুলু মালে দ্বীপে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট আছে। রেস্টুরেন্টগুলোর মালিক বাঙালিরা, স্টাফরাও বাংলাদেশি। ১০-১৫ মিনিট হেঁটে গিয়ে আমরা একটি বাঙালি রেস্টুরেন্টে সেহরি খেলাম। দেশি স্বাদের সব তরকারি সেখানে পেলাম।
রাত সাড়ে ৩টায় হোটেলে এসে ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন সকাল আটটা হতেই ঘুম থেকে উঠে আমরা সমুদ্র তীরে ঘুরতে বের হলাম। বলা বাহুল্য, দেশের ভেতরে অথবা দেশের বাইরে কোথাও ঘুরতে গেলে ঘুমের কথা চিন্তা করলে ঘুরতে পারবেন না।
যায় হোক, সকালবেলা হুলু মালে দ্বীপের সড়কে গিয়ে দেখি সব মানুষই ব্যস্ত। নিজ নিজ কর্মস্থলে স্কুটি দিয়ে নারী ও পুরুষরা যাচ্ছেন। মালদ্বীপে স্কুটির পরিমাণ বেশি। দেখে মনে হয়, এটা বুঝি স্কুটির শহর! হাজার হাজার স্কুটি। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সবাই স্কুটি চালায়।
তবে গাড়ির কোনো হর্ন নেই, সড়কে যানজট নেই। রাস্তা পারাপারকারীরা জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করছেন। জেব্রার কাছাকাছি এসে স্কুটি ও ট্যাক্সিগুলো গতি কমিয়ে দিচ্ছে। এসব দৃশ্য দেশে অবাক হলাম। ভাবতে লাগলাম, সমুদ্রদ্বীপের একটি দেশ থেকে আমরা কত পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশের শহর এলাকা বাদ দিলাম, গ্রামগঞ্জের বাজারে যানবাহনের হর্নের যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ।
এক বাংলাদেশি প্রবাসী ভাইয়ের সহযোগিতায় হুলু মালে থেকে একটি স্পিডবোট ভাড়া করে আমরা মালদ্বীপের বৃহত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর মাফুশি দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হলাম। যাত্রাপথে মালদ্বীপের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। প্রায় ৫০ মিনিট স্পিডবোট চড়ে নীল জলরাশি ও দ্বীপের পর দ্বীপ পেরিয়ে মাফুশি দ্বীপে পৌঁছে গেলাম।