শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫১ অপরাহ্ন

সংগ্রামী এক নারী- নাজমা শাহীন বেবী

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০২৩

বেবী বড় হয়েছিলেন মায়ের কাছে বাবার ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবার গল্প শুনতে শুনতে আর বাবার মুখে শুনতেন পাকিস্তানিরা কিভাবে বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। বাঙালিরা সেটা প্রতিহত করবার জন্য কিভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত ব্যাপার আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় নাজমা শাহীন বেবী রাজনীতি ও দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হন।

১৯৫৮ সালের ২৮শে ডিসেম্বর কুমিল্লার প্রগতিশীল সংস্কৃতিমনা পরিবারে বেবী জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর শৈশব কেটেছে ময়মনসিংহে। বাবা আবু যায়েদ সিকদার ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা করার পাশাপাশি ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। মা মেহেরুন্নেসা সিকদার গৃহিণী হলেও ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন সাংস্কৃতিক পরিবেশে। বাড়িতে ছেলে মেয়েদের জন্য গান এবং নাচের ওস্তাদ আসত ফলে বেবী এবং তার ভাই-বোনেরা বড় হয়ে উঠেছে একটি সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে। তৎকালীন ময়মনসিংহ শহরের প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সাথে তাঁর পিতার যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ততার ফলে যখন মোনায়েম খান ও তাঁর ছেলে খসরুর চক্রান্তে আনন্দমোহন কলেজ সরকারি কলেজে পরিণত হয়, তখন এর শিকার তাঁর পিতা। তাই কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্টারের চাকরি নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসেও বেবী খেয়াল করেছেন যে তখনও পিতার কাছে সবসময় জ্ঞানীগুণী লোকজনের আনাগোনা। বাড়িতে রাজনীতির পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য নিয়ে আলোচনে হতো।

বেবীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ময়মনসিংহের রাজবাড়ি স্কুল থেকে এবং পরবর্তীতে ঢাকা আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন যখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আজিমপুর গার্লস স্কুলের ছাত্রীরা ফরিদ উদ্দিন স্কুল ও ওয়েস্ট এন্ড স্কুলের ছাত্রদের সাথে একত্রিত হয়ে ফরিদ উদ্দিন স্কুলের মাঠে একটি সভা করে বিশাল মিছিল সহ ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিটিংয়ে একাত্মতা ঘোষণা করে। সেই মিছিলে বেবী অংশগ্রহণ করে সক্রিয়ভাবে গণআন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন এবং পরবর্তী সময় সকল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

বেবীরা তখন থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা ফুলার রোডের ১৭/এ ফ্ল্যাটে। বাবীর বাবা তখন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর কলেজ পরিদর্শক। আমরা ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই ঐ ফ্ল্যাটটিতে বসবাস করে আসছিলেন।

মার্চ মাস ছিল উত্তাল আর ঘটনাবহুল। ইয়াহিয়া সরকার ১ মার্চ পার্লামেন্ট অধিবেশন বাতিল করে দিল অর্থাৎ সংসদ বসলে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে, পাকিস্তান তা বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করছিলো।

তারমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দিবে না পাকিস্তানের শোষক গোষ্ঠী। জনগনের ভোটের রায়কে তাঁরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালো। তার প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ল এবং সারাদিন চলল মিছিল প্রতিবাদ। সারাদেশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।

২ মার্চ সকালে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ডাকা সমাবেশে সারা শহরের স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা স্বতস্ফুর্তভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলাতে জড় হতে থাকে। যদিও বেবীদের বাসা তখন বটতলার কাছে ফুলার রোডে কিন্তু তাঁরা ছিলেন আজিমপুর স্কুলে। স্কুল থেকে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে বেবীর বড় বোন লুৎফা হাসীন রোজী তাঁদের নিয়ে বটতলার জমায়েতে যোগ দিয়েছিলেন। তিল ধারনের ঠাঁই ছিল না। সবসময় বটতলায় টেবিলের উপর দাড়িয়ে নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা দিত কিন্তু সেদিন কলা ভবনের সামনের পুরো জায়গা ভরে গেছে, সামনের রাস্তা আর মলচত্বরের দিকের অংশেও সমাবেশে আসা লোকেলোকারন্য হয়েছিল। তাই কলাভবনের পোর্টিকোর উপরে উঠে নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা দেবার সিদ্ধান্ত হলো। ছেলেরা উঠে গেলেন কিন্তু একমাত্র মহিলা বক্তা রাফিয়া আক্তার ডলি উঠতে পারছিলেন না। মেয়েরা নীচ থেকে তাঁকে ঠেলে ধরেছিল আর উপর থেকে আ স ম আবদুর রব হাত ধরে এত উঁচু পোর্টিকোতে অবস্থান নিতে সক্ষম হতে সাহায্য করেছিলেন। সমগ্র সমাবেশ উত্তেজনায় টান টান, সবাই নেতাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা গোগ্রাসে শ্রবন করছে। এর মাঝে ঢাকা কলেজ থেকে মিছিল আসলো যাদের কাছে একটি পতাকা ছিল, যা ইতোপূর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ উদযাপিত ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুর বাহিনীর মার্চ পাষ্টে পতাকা হিসেবে তৈরী করা হয়েছিল। যা ছিল বোটল গ্রীন সবুজের রক্ত লাল সূর্যের উপর সোনালী বাংলাদেশের মানচিত্র। কিন্তু পরবর্তীতে আ স ম আবদুর রব পতাকাটি বাংলাদেশের পতাকা হিসাবে তুলে ধরলেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভা ঘোষনা দেয়া হলো।

প্রতিটি সেকেন্ড ঘটনা বহুল। এরপর শুরু হলো ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভা, বসল তৎকালীন ইকবাল হলের কেন্টিনে ৩ মার্চের ইশতেহার তৈরী আর পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচীর পরিকল্পনা। সকল পর্যায়ের ছাত্রনেতৃবৃন্দ সেখানে জমায়েত হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে ৩ মার্চ যে ইশতেহার পাঠ করা হয় যাতে পূর্বদিনে উড়ানো পতাকাকে জাতীয় পতাকা আর ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সঙ্গীতের ঘোষণা দেয়া হয়।

এদিকে, বঙ্গবন্ধুর গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান নিয়ে জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৭ মার্চ ঐতিহাসিক বক্তৃতায় এ জাতিকে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। ৮ তারিখ থেকেই ছাত্রলীগের মেয়েদের সামরিক প্রশিক্ষন শুরু হয় কলাভবনের ভিতর তৎকালীন ডাকসু অফিসের সামনে। পেয়ারু আর দুদু দুজন অবসরপ্রাপ্ত আর্মি ইনস্টাকটর ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। তৎকালীন ইউ ও টি সি যা এখন বিএনসিসি’র ডামি রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষন দেয়া হত। মমতাজ, ইকু, সাকী, ফোরকান, রাশেদা, রিনা, রোজীসহ সকল ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহর ছাত্রলীগের অনেক মেয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ট্রেনিং নিত বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে।

এমনি ট্রেনিং চলছিল মার্চের ২৫ তারিখ। এর পরের গল্পটা আমরা নাজমা শাহীন বাবীর মুখে শুনি, “সেদিন দুদুভাই আমাদের বলল আজ আমরা একটা শত্রু ক্যাম্প দখল করে কিভাবে বাংলাদেশের পতাকা তুলব তার মহড়া দিব। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ আমরা ডামি রাইফেল নিয়ে স্ক্র্যাল করে কলা ভবনের ছাদে উঠলাম যেন একটি শত্রু ক্যাম্প দখল করছি। কলাভবনের ছাদে উঠে খুব আস্তে আস্তে স্ক্রল করে কলা ভবনের গেটের উপর যে গম্বুজ ছিল তাতে একটা ফ্ল্যাগ স্টান্ট ছিল তাতে বাংলাদেশের পতাকা লাগানোর জন্য আমরা স্ক্রল করে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ট পর্যন্ত গেলাম। যা খুবই বিপজ্জনক ছিল, কিন্তু আমরা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ডামি রাইফেল উচিয়ে উল্লাস করছিলাম, তখনই এক বিরল দৃশ্য দেখলাম যা আজও মনে উজ্জল নক্ষেত্রের মত আমার অন্তরকে আলোকিত করে চলছে।

তখন অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ বন্ধ ছিল লোকজন খুব কম ছিল। কিন্তু নীচে দেখলাম একটি রিকশা তার পাদানি আর সীট ভর্তি অনেক বই আর রিকশার পাশে পাশে হেটে যাচ্ছেন এক ব্যাক্তি, যিনি ধুতি আর কোট পরা। তিনি আর কেউ নন ড. জি সি দেব, অধ্যাপক দর্শন বিভাগ। যে দৃশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ কল্পনা করা যায় না। একজন শিক্ষক ১৫-২০টা বই লাইব্রেরি থেকে নিয়ে যাচ্ছেন বাসায় বসে পড়ার জন্য।

সেদিন আমরা দুবোন খুবই উত্তেজিত। ফুলার রোডের বাসায় ফিরে আসলাম দুপুরে। রাতে খাবার পর আমার বান্ধবী ফ্লোরা ডাকলো হাঁটার জন্য, ওরা আমাদের সামনের ১৮নং ফ্ল্যাটে থাকতো। সেইসময় আমাদের মায়েরাও রাতে হাটতে নামতে এবং যে গুড়ি দুটোতে শিক্ষকরা সন্ধ্যায় আড্ডা দিতেন, সেখানে মায়েরা রাতে বসতেন। আমি আর ফ্লোরা ইকবাল হল লাগোয়া সিলিপারের উপর বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম অধ্যাপক আহমদ শরীফ ১৮ নাম্বার থেকে বের হয়ে দৌড়ে ১৭ নাম্বার বিল্ডিং এ ঢুকলেন। একটু পর বাবাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে আসলেন। উনারা দুজন কি নিয়ে যেন আলোচনা করলেন এবং এক পর্যায় বাবা আমাদের দুজনকে ডাকলেন। বললেন মাদের যেয়ে বলতে উনারা যেন যার যার বাড়ী ফিরে যান। আমরা ভীষন সাংঘাতিক কিছু একটা আচ্ করে দৌড়ে গেলাম।

বাবারা দারোয়ানকে ডেকে কি নির্দেশ যেন দিলেন এবং মোমিন ভাই আর বাবুল ভাইকে সামনে পেয়ে তাদের ইকবাল (জহুরুল হক) হলে পাঠালেন তারা যেন হল ছেড়ে চলে যায়। আরো কিছুক্ষন উনারা জরুরী কিছু আলোচনা শেষে বাসায় ফিরে আসলেন। জানতে পারলাম পাকিস্তান আর্মি ক্যান্টমেন্ট থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এদিকে আসছে। অধ্যাপক আহমদ শরীফ চাচার ছোট শালী জানিয়েছেন পাকিস্তানী আর্মি ট্যাংঙ্ক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়র দিকে আসছে।

বাবা আমাদের বললেন, গুলি শুরু হলে কোনরকম উকি ঝুঁকি দিবে না, কারণ আমাদের ফ্ল্যাটটি ছিল একদম ইকবাল হলের দিকে। আরো বললেন স্ক্রল করে মাঝখানে ড্রয়িং রুমে চলে আসতে। দুবোন উত্তেজনায় টান টান হয়ে শুয়ে আছি। হঠাৎ গুলি শুরু হলো, আমরা স্ক্রল করে ড্রয়িং রুমে চলে আসলাম। বাবা অন্য ঘর থেকে মা এবং অন্যান্য ভাই-বোনদের নিয়ে আসলো। আমরা প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম কখন গোলাগুলি বন্ধ হবে!

আমরা দুবোন ভাবছিলাম পরদিন প্রশিক্ষনে যেয়ে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করবো কিন্তু সে সকাল আর আসে নাই। প্রথমদিকে মনে হয়েছিল পাকিস্তান আর্মি কিছুক্ষন গোলাগুলি করে চলে যাবে। কিন্তু যখন ফজরের আজান দিল তখন ট্রেসার লাইট ছুড়তে দেখে বাবা বললেন ওরা এখন কোন ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছে ‘ওরা হয়তো চলে যাবে’। কিন্তু দেখা গেল ওরা গেল তো নাই বরং গোলাগুলির মাত্রা আরো বেড়ে গেল। কোথাও কোন শব্দ নেই আছে শুধু বুকের ভিতর হিম করে দেবার মত গুলির শব্দ।

সকালে বাবা আশপাশের পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে পাশের বাসার ডা. কেতাবুদ্দিন সাহেবের সাথে কথা বললেন, দোতালায় আমাদের উপরে খন্দকার চাচার সাথে এবং অন্যান্য ফ্ল্যাটের সবার সাথে পরামর্শ করে দোতালার বামদিকে ড. নাঘবি ছিলেন যারা মার্চ মাসের শুরুতেই পশ্চিম পাকিস্তান চলে গেছিল, কিন্তু কাজের ছেলে ছিল, তার সাথে কথা বলে আমাদের সব পরিবার বিশেষ করে যারা ইকবাল হলের দিকে ছিলাম তারা ১৭/ডি নাম্বার ফ্ল্যাটে যেয়ে আশ্রয় নিলাম। উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানীদের বাসায় আক্রমণ করবে না এমন একটা ধারনা থেকে।

সকাল ৮:০০ টার দিকে দেখা গেল ফুলার রোডের প্রধান গেটের কাছে আর্মিদের জীপ এবং তাদের হাটাহাটি করতে দেখা গেল। একটি জীপে ডা. মুর্তাজাকেও দেখা গেল। যা দেখে সবাই আরো আতঙ্কিত হয়ে গেছিলাম। অন্যদিকে পিছনদিকের জানালা দিয়ে দেখা গেল ইকবাল হলের ক্যান্টিনের সামনে চিশতী শাহ হেলালুর রহমান, দর্শন বিভাগের ছাত্র ইকবাল হলের দোতলায় থাকতো এবং আজাদ পত্রিকার সাংবাদিক ছিল। তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে আর চিশতী ভাই চিৎকার করছে ‘রোজী-বেবী আমাকে বাঁচা’। সাথে অধ্যাপক কমরুদ্দিন, আইনের শিক্ষক উনাকেও দেখা গেল, কিন্তু কিছুক্ষন পর আর্মি উনাকে ছেড়ে দিলেন এবং উনি আমাদের পাড়ায় উনার পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরে আসলেন।

আমাদের ১৭নং বিল্ডিং আর তার পিছনে ১৬ নং বিল্ডিং এর মাঝখানের একটু ফাঁকা জায়গা আছে। হঠাৎ দেখি রোজী আপা আমাদের বাসায় কাজের ছেলেটাকে দিয়ে ঐখানে গর্ত করাচ্ছে। তাই দেখে বাবা নীচে নেমে রোজী আপার সাথে কথা বলল ‘কেন ও গর্ত করাচ্ছে?’ পরে অবশ্য জেনেছি যে, বোমা বানানোর জন্য ছাত্রলীগের নেতারা ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরী থেকে সোরা/বারুদসহ রসদ এনে আমাদের স্টোর রুমে রেখেছিল। রোজী আপা যখন দেখতে পেল আর্মি পাড়ায় ঢুকে গেছে যদি আমাদের বাসায় এগুলি পায় তাহলে তো সবাইকে মেরে ফেলবে! তাই ও ভয়ে কিভাবে এগুলি সরাবে ভেবে গর্ত খুড়াছিল ওর মধ্যে ফেলে মাটি চাপা দিবে চিন্তা করে। যাইহোক জানাজানি হওয়ার আগেই বাবা ওঁকে থামালো যেন বড় কোন দুর্ঘটনা না ঘটে।

সকাল থেকেই ইকবাল হলের বিভিন্ন রুমে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল এবং সেই রুমগুলি পুড়ছিল। ভয় আর অনিশ্চয়তায় দুরু দুরু বক্ষে আমাদের অপেক্ষার পালা কখন আর্মি আমাদের বিল্ডিং পর্যন্ত চলে আসবে। হয় আমাদের ধরে নিয়ে যাবে না হয় মেরে ফেলবে! এমনি করে সারাদিন কাটলো, দুপুরে আমরা তিনতলায় ড. আবদুর রহমান সাহেবের বাসায় খেলাম এবং উনাদের বাসায় থাকা ঠিক হলো। বিকেলে হঠাৎ দেখতে পেলাম আমাদের বিল্ডিং এর পাশ থেকে ধূয়া বের হচ্ছে। একটু পর বুঝতে পারলাম পাশে ব্রিটিশ কাউন্সিলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। মনে হতে লাগলো আগুনের লেলিহান শিখা হয়তো খুব শীঘ্রই আমাদের গ্রাস করবে। আমাদের বিল্ডিং-এ আগুন লেগে গেলে কি করবো সেই ভয়ে কুকড়ে ছিলাম।

এরমধ্যে ঘোষনা হলো ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিবে। টেবিলের নীচে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে অন্ধকারের মধ্যে আমরা কবরের নিস্তব্ধতায়, সময় যেন কাটতে চায় না। এক একটা গুলির আওয়াজ যেন বক্ষ বিদীর্ন করে দিচ্ছিল। রাত ৮:০০ টায় সবাই খেয়ে শুয়ে পড়ল- ছেলেরা সব ড্রয়িং রুমে আর মেয়েরা সব বেড রুমে। টেবিলের নীচে টিমটিমে হ্যারিকেন জ্বেলে খুব কম আওয়াজ দিয়ে রোজী আপা, মিসেস রহমান আর আমি ইয়াহিয়ার ভাষন শুনতে শুরু করলাম। হঠাৎ গুলি হলো, মনে হলো যেন তিনতলার জানালার পাশে আওয়াজ হলো, আমাদের বুকে ধরফরানি শুরু করে দিল।

ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করলো আর আমরা যারা মুক্তিকামী মানুষ সবাই বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে পাকিস্তানের শত্রæ হিসেবে চিহ্নিত হলাম!”

এরপরে বেবীর পরিবার সকলের সাথে ঢাকা থেকে জিনজিরা হয়ে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় চলে যান। দেশের বাড়িতে দু মাস থাকার পর জুন মাসের দিকে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। এদিকে অগাস্ট মাসে মুজিব বাহিনী প্রথম ব্যাচ ট্রেনিং শেষে ঢাকায় ফিরে আসে এবং তাঁদের সাথে যোগাযোগ করে। অগাস্ট মাসের শেষ দিকে বেবী এবং তার বড় বোন রোজী ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এই পর্যায়ে রফিকুল ইসলাম নামে তৎকালীন ছাত্রলীগের এক কর্মীর সাথে তাঁরা দুই বোন মা-বাবাকে না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য পালিয়ে প্রথমে কামরাঙ্গীর চর চলে যান। সেখানে গিয়ে খবর পান মা-বাবা তাঁদের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করছেন। এই পর্যায়ে তাঁরা কামরাঙ্গীরচর ছেড়ে ডেমরা রূপসী গ্রামে যান। সেখানে তখন মুক্তিযোদ্ধা খসরুর নেতৃত্বে নারীদের একটি গ্রুপ ছিল, কিন্তু তাঁরা ওই গ্রুপের সাথে দেখা করার আগেই পাকিস্তানি আর্মি ওই গ্রাম আক্রমণ করে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। তখন তাঁরা বাধ্য হয়ে তারাবো গ্রামে চলে যান এবং খোঁজখবর নিয়ে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করে শাদীপুর গ্রামে ওই গ্রুপটির সাথে মিলিত হন। এসময় তাঁরা দুবোন ট্রেনিং নিয়েছেন কিভাবে স্টেন গান, থ্রি নট থ্র্? এসএমজি এবং গ্রেনেড অপারেট করতে হয়।

সে সময় গোপীবাগে শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যান এলাকার মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে ধরিয়ে দিত এবং অল্পবয়সী মেয়েদের আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে অত্যাচার করত। মুক্তিবাহিনীর দল সিদ্ধান্ত নেয় শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যান কে ধরে আনা হবে। আলোচনা শেষে অ্যাকশনের জন্য বড় বোন রোজীকে অ্যাকশনের সদস্য হিসেবে নেয়া হয় কিন্তু বেবী বয়সে ছোট ছিলেন বলে তাঁকে রেখে যাওয়া হয়। মাঝরাতে তাঁরা সফলভাবে অ্যাকশন সম্পন্ন করে ফিরে এলেন সেই কুখ্যাত শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যান কে সাথে নিয়ে। তাকে দুদিন ক্যাম্পে আটকে রেখে তার কাছ থেকে সব তথ্য বের করে নেয়া হয়। অতঃপর সিদ্ধান্ত হয় বহু মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে দেয়ার জন্য এবং বহু মা বোনের ইজ্জত লুন্ঠনের জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। এ কুখ্যাত রাজাকারের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় বেবীর বড় বোন লুৎফা হাসান রোজীকে। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নৌকা করে সে রাজাকার কে শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বেবীর বড় বোন বেয়োনেট চার্জ করে থাকে হত্যা করে। বেবীর স্মৃতিতে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যে, দশম শ্রেণীর ছাত্রী থাকা অবস্থায় তার বড় বোন ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের ঋণ একটি রাজাকারকে বধ করে শোধ করার চেষ্টা করেছে।

সেপ্টেম্বর মাসে তারাবো থেকে নৌকা যুগে মেঘনা নদী পার হয়ে বেবীরা কসবা এলাকা দিয়ে সি এন্ড বি রোড অতিক্রম করে আগরতলা পৌঁছান। আগরতলা পৌঁছেই তিনি লেম্বুছড়া ক্যাম্পে ওঠেন এবং সেখান থেকে সামরিক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে শুরু করেন। ওই ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন ক্যাপ্টেন কে বি সিংহ। কিন্তু মাত্র তিন দিন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের পর সেখানকার প্রশিক্ষণ সমাপ্ত একটি পুরুষ দলের সাথে আর্মস ও এমোনেসন নিয়ে ডেমরার বেস ক্যাম্পে চলে আসেন এবং তার বড় বোন রোজী শিলিগুড়িতে মুজিব বাহিনীর উত্তরবঙ্গের হেডকোয়ার্টার্সে চলে যান। বেবী দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি।

দেশের স্বাধীন হওয়ার পর বেবী যথারীতি আজিমপুর গার্লস স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৬ সালে বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণ রসায়ন বিভাগে পড়ালেখা শুরু করেন। তিনি ১৯৮২ সালে স্নাতকোত্তর শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং ১৯৯৬ সালে জাপানের কাগোশিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া ও খাদ্য বিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও ছিলেন। এছাড়াও তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার অনারারে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৭৯ সালের ১৭ই জুন বেবী বিয়ে করেন রফিকুল ইসলামকে। একাত্তরে দুজন একসাথেই দেশ ছেড়েছেন এবং যুদ্ধ করেছেন। রফিকুল ইসলাম নিজে একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই যুগলের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পরিবার প্রগতিশীল হওয়াতে পেশাগত জীবনে কখনো কোনো সমস্যায় তাঁদের পড়তে হয়নি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com