শিলংবাস রবীন্দ্রমনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল; স্বাপ্নিক কবিকে রোমান্টিক করেছিল আরো বেশি। তাই স্থানটির আবেদনই আলাদা। তা না হলে ৬৮ বছর বয়সের কোনো মানুষ ‘শেষের কবিতা’র মতো উপন্যাস লিখতে পারেন? শিলংয়ে গেলে সবাই বুঝি লাবণ্য বা অমিত হয়ে যায়!
দার্জিলিং আর শিলং আবহাওয়া ও ভূমিরেখায় প্রায় একই রকমের। তার পরও দার্জিলিং বাদ দিয়ে শিলং কেন? একটি কারণ, ‘দার্জিলিংয়ে জনতা আছে, মানুষ নেই।’ অমিতও শিলংয়ে ‘মানুষ’ পেয়ে গিয়েছিল, পাহাড়ি রাস্তায় না-ঘটা এক ‘দুর্ঘটনা’য়। ওই মানুষটি লাবণ্য; গাড়ি থেকে লাবণ্য নেমে এসেছিল : ‘সে যেন ফুটে উঠল একটি বিদ্যুৎরেখায় আঁকা সুস্পষ্ট ছবি—চারদিকের সমস্ত হতে স্বতন্ত্র।’
সিলেটের তামাবিল-ডাউকির সুন্দর পিচঢালা রাস্তা ধরে যে কেউ গাড়িতে শিলংয়ের দিকে এগিয়ে গেলে পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঠে যাওয়া রাস্তায় চলতে চলতে একদিকে রোমাঞ্চ, অন্যদিকে ‘সদ্য-মৃত্যু আশঙ্কা’ তিনি অনুভব করবেন নিশ্চয়। বাংলাদেশের সমতল ভূমি থেকে শিলং অভিমুখে ধীরে ধীরে পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে থাকার সময় মেঘ এসে জড়িয়ে ধরবে। মেঘে সাঁতার কাটার আনন্দ আর ভয়ে বুকটা করবে দুরুদুরু। সিলেট থেকে ঘণ্টা চারেকের পথ শিলং পুলিশ বাজার পয়েন্ট (শিলং শহরের কেন্দ্র)। ঘুরে-ফিরে দেখলে বোঝা যাবে, রবীন্দ্রনাথের চেনা শিলংয়ের সঙ্গে আজকের শিলংয়ের খুব একটা পার্থক্য নেই। শুধু সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। নিশ্চিত হয়েছে বিদ্যুৎ, অঢেল হয়েছে সুপেয় পানীয় জল, বেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থাপিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় আর পাহাড়ি কয়লা তো অনিঃশেষ। পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে ছবির মতো তৈরি একটা শহর। ঝাঁকড়া চুলের যুবকের মতো বেশির ভাগ পাহাড়ই দাঁড়িয়ে আছে দেওদার-পাইন আর পাহাড়ি বৃক্ষের সারি মাথায় নিয়ে। শিলং পিকে উঠে পুরো শহরটাই দুই চোখের সামনে আনা যায়। পাহাড়ের বুক থেকে গলে পড়া রুপালি জলের ঝর্ণা আর চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিপাত!
অবর্ণনীয় এর সৌন্দর্য, মোহময় আবেশ। অমিত ঠিক করেছিল, চেরাপুঞ্জির গিরিশৃঙ্গে ডাকবাংলোতে নববর্ষার মেঘদলের সঙ্গে মেঘদূত জমিয়ে তুলবে। এখনো সেই মেঘ আর গিরিশৃঙ্গ যে কাউকে অমিত বানাতে পারে, লাবণ্যও। তবে রবীন্দ্রনাথ কখনোই বর্ষায় শিলংয়ে থাকেননি; অবকাশযাপনকারী বা পর্যটকেরা শীত বা বর্ষাকালে এখানে খুব একটা থাকে না। রবীন্দ্রনাথ থেকেছেন এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। শিলংয়ে যাওয়ার জন্য ওই সময়টাই সেরা। এই মাসগুলোতে বাংলাদেশে চলে গ্রীষ্মের দাবদাহ। আমাদের তপ্ত ও স্বেদসিক্ত শরীর এ সময় ঠাণ্ডার আলতো পরশে জুড়িয়ে দিতে পারে শিলং। মজার বিষয় হলো, ওখানকার দামি হোটেলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলেও কোনো হোটেলেই বৈদ্যুতিক পাখা নেই। বছরে কখনো পাখার প্রয়োজনই হয় না।
শিলংয়ে কবির ঠিকানা ছিল রিবংয়ের ব্রুকসাইড বাংলো। টানা দুমাস ছিলেন তিনি ওই বাড়িতে। রচনা করেছিলেন অন্যধারার উপন্যাস শেষের কবিতা। সামনে সর্পিল রাস্তা, দুধারে পাইন, ইউক্যালিপটাস আর দেবদারু। দূর থেকেই দেখা যায় বিরাট স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। পেছনে গাড়িবারান্দায় ঘেরা থামওয়ালা বাড়ি, মাথায় ঢালু ছাদ, এদেশে যাকে বলে অসম টাইপ বাড়ি। বাড়িটি এখন কেন্দ্রীয় সরকারের সংগ্রহশালা, যদিও খানকতক ছবি, আসবাব ইত্যাদি ছাড়া তেমন কিছু নেই। তবুও মনে হয়, পর্দার ফাঁকে উঁকি দিলেই দেখব সোফায় লম্বা হয়ে আছেন বাবার সঙ্গে শিলংয়ে আসা রথীন্দ্রনাথ, ফায়ার প্লেসের ধারে কী যেন করছেন প্রতিমা দেবী; আর কবি ব্যস্ত তাঁর জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্মৃতিচারণায়।
অনেক বাঙালি পরিবারের দেখা মিলবে, যাদের পূর্বপুরুষ এই সুন্দর স্নিগ্ধ পরিবেশের মায়ায় বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন। ‘শেষের কবিতা’র ভাষায় : ‘এখানে চাঞ্চল্যটাই স্থির হয়ে জমে জমে ওঠে—ঝর্ণা বাধা পেয়ে যেমন সরোবর হয়ে দাঁড়ায়।’ অসম্ভব সুন্দর এ শহর; পাহাড়-প্রকৃতি যেন আপন কোলে মাতৃ-মমতায় জড়িয়ে রেখেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, কেন রবীন্দ্রনাথ বেছে বেছে শিলং পাহাড়ে গিয়েছিলেন; কেন গিয়েছিল তাঁর অমিত!